বাংলাদেশের বৃহত্তম হাওর হাকালুকিতে বর্ষা শেষে পানির স্তর কমতে না কমতেই শুরু হয়েছে মৎস্য সম্পদ নিধনের এক ভয়াবহ প্রতিযোগিতা। প্রতিদিন, বিশেষ করে রাতের আধারে বেড়জাল, কারেন্ট জাল দিয়ে নির্বিচারে মা মাছ ও পোনা মাছ শিকার করা হচ্ছে। এতে ধ্বংস হচ্ছে এ দেশের অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য ভাণ্ডার। একসময়ের সমৃদ্ধ ‘মাদার ফিশারিজ’ এখন সংকটের মুখে বাংলাদেশের চারটি প্রধান ‘মাদার ফিশারিজ’ এর অন্যতম হলো হাকালুকি হাওর। ১৮,১১৫ হেক্টর আয়তনের এই জলাভূমি ২৭৬টি আন্তঃসংযুক্ত বিল নিয়ে গঠিত। এখানে উৎপাদিত মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হতো। ২০১৬ সালে প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়েছিল। মৎস্য বিভাগ দাবি করেছিল গত মৌসুমে উৎপাদন বেড়েছে ২০ শতাংশ। কিন্তু চলতি বছর সেই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি, প্রশাসনিক দুর্বলতা স্পষ্ট বাংলাদেশের প্রচলিত মৎস্য আইন অনুযায়ী ৩০ সেন্টিমিটারের নিচে বোয়াল-আইড়, ২৫ সেন্টিমিটারের নিচে কার্প জাতীয় মাছ, মা মাছ ও পোনা ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তারপরও বাস্তবে জেলেরা নিয়মের তোয়াক্কা করছেন না। সম্প্রতি কুলাউড়া উপজেলা প্রশাসন, মৎস্য বিভাগ ও পুলিশের টাস্কফোর্স যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে ৬ লাখ টাকার অবৈধ জাল উদ্ধার করে। আগেও দেড় লাখ টাকার জাল জব্দ ও হাজার মিটার কারেন্ট জাল পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু অবৈধ মাছ ধরা বন্ধ হয়নি। চিহ্নিত সংঘবদ্ধ চক্র প্রতিরাতে হাওরে বিশাল বেড়জাল দিয়ে মাছ শিকার করছে। এতে জলজ উদ্ভিদ নষ্ট হচ্ছে; হাওরের প্রতিবেশ ব্যাহত হচ্ছে। মাছ ধরা শেষে এসব মাছ ভ্যানে তুলে দেশের বিভিন্ন বাজারে পাঠানো হয়। অভিযোগ রয়েছে, কিছু প্রশাসনিক কর্মকর্তাও মাসোহারা নিয়ে এদের প্রশ্রয় দেন। বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা পরিবেশ কর্মী মিন্টু দেশোয়ার বলেন:“মা মাছ ও পোনা ধরা অব্যাহত থাকলে আগামী ১০ বছরে দেশীয় মিঠাপানির মাছ বিলুপ্তির মুখে পড়বে। শুধু অভিযান নয়, প্রয়োজন কঠোর শাস্তি ও হাওরপাড়ের জনগণের বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা।” জীবিকার সংকট, জেলেদের আকুতি প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার মানুষ হাকালুকি হাওরের ওপর নির্ভরশীল। তালিকাভুক্ত ১,৭১০ জন জেলে ছাড়াও অনেক অপ্রাতিষ্ঠানিক জেলে এ হাওরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। স্থানীয় জেলে সুমন মিয়া বলেন: “সরকার যদি সাহায্য করত, হয়তো বিকল্প পেশা নিতাম। কিন্তু এখন আমাদের জন্য মাছ ধরা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।” ভুকশিমুল ইউনিয়নের অপর এক জেলে বলেন: “পোনা ছেড়ে দিলে বড় হয়ে আবার কি আমাদের কাছে ফিরে আসবে? এখন যা পাই, তা-ই ধরতে হয়।” প্রশাসনের ভাষ্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কুলাউড়া উপজেলা উৎস কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ বলেন: “আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। কিন্তু এত বিশাল হাওর নজরদারি করতে লজিস্টিক সাপোর্ট ও জনবল কম। শুধু আইনি ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়, স্থানীয় মানুষদের সচেতন করতে হবে।” জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. নুরুননবী বলেন: “মৌলভীবাজারের সব হাওরে টাস্কফোর্স অভিযান চলছে। মা মাছ, পোনা ও নিষিদ্ধ জাল জব্দ করা হচ্ছে। খুব শিগগিরই জেলেদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে।” জীববৈচিত্র্যের অবনমন: হারিয়ে যাচ্ছে মিঠাপানির মাছ একসময় হাকালুকি হাওরে ছিল রুই, কাতলা, মৃগেল, কালো বাউস, আইড়, বোয়াল, শোল, গজার, পাঙ্গাস, পাবদা, মাগুর, সিং, কই, পুটি, টেংরা, রানি, মলা, বাঁচা সহ প্রায় সব দেশীয় মাছ। এখন অনেক প্রজাতিই বিলুপ্তির পথে। পাঙ্গাস, পাবদা, সিং, ঘনিয়া, রানি এখন চোখেই পড়ে না। এক সময়ের হাওরের ইলিশও আজ কেবল স্মৃতি। উপসংহার: এখনই না জাগলে কাল দেরি হয়ে যাবে হাকালুকি হাওর শুধু বাংলাদেশের নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি। এই হাওরের প্রাকৃতিক মৎস্য ভাণ্ডার যদি এইভাবে শেষ হতে থাকে, তা শুধু খাদ্য নিরাপত্তাকেই নয়, মানুষের জীবিকা, পরিবেশ ও অর্থনীতিকেও ভয়াবহভাবে বিপর্যস্ত করবে। প্রয়োজন টেকসই ব্যবস্থাপনা, জেলেদের বিকল্প পেশার সুযোগ, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা। এখনই ব্যবস্থা না নিলে বাংলাদেশের বৃহত্তম মিঠাপানির মাছের উৎস হারিয়ে যাবে ইতিহাসের পাতায়।
.........বিস্তারিত