সিরাজী এম আর মোস্তাকঃ জাতীয় শোকের মাস আগষ্টে যে কজন মহান নেতাকে বেশি মনে পড়ে, তম্মদ্ধে খন্দকার মোশতাক অন্যতম। তিনি বাঙ্গালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। ১৫ই আগষ্টের (১৯৭৫) পর তিনি দেশের ক্ষমতা পেয়েও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে এক চুল সরেননি। অর্থাৎ জনাব খন্দকার মোশতাক আহমদ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সর্বশ্রেষ্ঠ ধারক ও বাহক। বাংলাদেশের আওয়ামী প্রজন্ম এ মহান নেতাকে মিথ্যা দোষারোপ করে থাকে। তাকে বঙ্গবন্ধু হত্যার অন্যতম ঘাতক মনে করে। তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে তার সকল অবদান ও স্বীকৃতি মুছে দিয়েছে। তিনি একজন নিগৃহিত বঙ্গসেনা।
খন্দকার মোশতাক আহমদ ১৯১৮ সালের ৫ মার্চ কুমিল্লা দাউদকান্দি উপজেলার দশপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রী লাভ করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ধার্মিক এবং নেতার প্রতি অত্যন্ত অনুগত ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনি সংগ্রামী ভূমিকা রেখেছেন। পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগের ছাত্র শাখার নেতৃত্ব থেকে যোগ দেন মূল মুসলীম লীগে। পরে ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে যোগ দেন ইষ্ট পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর একে একে তিনবার আটক হন এবং বঙ্গবন্ধুর সাহচর্য্য পান। ১৯৬৯ সালে প্রথম দিকে আটটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে আইয়ুব বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে তিনি পূর্ব পাকিস্তান শাখার আহবায়ক নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে আইয়ুব খান আহুত গোলটেবিল বৈঠকে তিনি আওয়ামী লীগ দলের সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধুর অধীনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে পাড়ি জমান এবং মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদীয় মন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তাই বঙ্গবন্ধু আজীবন তাকে নিজের কাছে আগলে রেখেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর বিদ্যুৎ, সেচ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও বাণিজ্যসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধু তার নিষ্ঠায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বাকশালের দায়িত্ব প্রদান করেন। অর্থাৎ শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তিনি বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর শাসন ব্যবস্থায় খন্দকার মোশতাক অসামান্য ভূমিকা রাখেন। স্বাধীনতার পর কতিপয় কুচক্রীর প্রভাবে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের পরিবর্তে বাংলাদেশের যুদ্ধবিধ্বস্থ অসহায় নাগরিকদেরকে দালাল আইনে বিচার শুরু করেন। বহু অসহায় বাঙ্গালীকে রাজাকার সাব্যস্ত করেন। একজনের ফাঁসিও কার্যকর করেন। তখন খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুকে বিপরীত পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, এদেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী সবাই এক একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে তাদের ত্রিশ লাখ প্রাণ বিসর্জন করেছেন এবং দুই লাখ নারী সম্ভম হারিয়েছেন। তারা কেউ দালাল, রাজাকার বা যুদ্ধাপরাধী নয়। শুধুমাত্র পাকি সেনারাই খুনী ও যুদ্ধাপরাধী। বঙ্গবন্ধু তার এ পরামর্শ গ্রহণ করেন এবং তাৎক্ষণিক (১৯৭৩ সালে) দালাল আইনে বিচার বন্ধ করেন। সবাইকে মুক্তি দেন। বিচারের সামান্য কাগজও বিনষ্ট করেন। কথিত দালালদেরকেও মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দেন। শহীদের সংখ্যা ‘ত্রিশ লাখ’ সুনির্দিষ্ট করেন। যোদ্ধা ও শহীদ নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি নাগরিককে মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা করেন। এতে স্বার্থান্বেষী মহল ক্ষিপ্ত হয়। বহু ত্যাগী নেতাও বঙ্গবন্ধুর সাহচর্য্য ত্যাগ করেন এবং তাকে হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। এভাবে ১৫ আগষ্ট, ১৯৭৫ রাতের আঁধারে একদল সেনাসদস্যের হাতে বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হন। উক্ত সেনা সদস্যদের তোপের মুখে খন্দকার মোশতাক ক্ষমতা গ্রহণে বাধ্য হন। (্এ্যান্থনী মাসকারানহাস- দি রেপ অব ব্লাড)।
ক্ষমতা গ্রহণের পর খন্দকার মোশতাক সবাইকে এক হবার আহবান জানান। অনেকে সাড়া দেন। অন্যদেরকে দুস্কৃতিকারীদের হাত থেকে রক্ষায় আটকের র্নিদেশ দেন। কিন্তু দুস্কৃতিকারীরা কারাপ্রকোষ্ঠ ভেদ করে ১৯৭৫ এর ৩রা নভেম্বর স্বাধীনতার দিকপাল জাতীয় চার নেতা তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন মনসুরকে হত্যা করে। এর একদিন পর খালেদ মোশারফের অভ্যূত্থানে তিনি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। তবু উক্ত হত্যার দায় তার ওপর পড়ে। তিনি ৬ নভেম্বর কারাগারে বন্দি হন। ১৯৭৬ সালে মুক্তি পান। এরপর বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ‘ডেমোক্রেটিক লীগ’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এতে ব্যর্থ হন। তারপর একাকীত্ব জীবন যাপন করেন। অবশেষে ১৯৯৬ সালের ৫ মার্চ তিনি ৭৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তার স্মৃতি অম্লান। তিনিই প্রথম ‘জয় বাংলা’র পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ চালু করেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ইসলামী প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশ ঘোষণা করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির কথা শুনে হু হু করে কাঁদছিলেন। আবেগ সংবরণ করতে না পেরে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষায় রণে ভঙ্গ দিয়ে আমেরিকা ও চীনের মাধ্যমে পাকিস্তানের সাথে সন্ধি করতে উদ্যত হন। পরে তাজউদ্দিনের বক্তব্যে উদ্ধুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখেন। পৃথিবীর সকল পরাশক্তিকে তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে আনেন। বিজয় সুনিশ্চিত করেন। (মঈদুল হাসান- মূলধারা ‘৭১)।
বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এ সহকর্মীর কোনো স্মৃতিফলক বাংলাদেশে নেই। তাই বঙ্গবন্ধু এবং দেশের সকল স্মৃতিফলক এ নিগৃহিত বঙ্গসেনার জন্য অস্ফুট স্বরে বিলাপ করছে। মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাসের ফলে আজ এ স্বর কেউ শুনছেনা। মূলত বাংলাদেশে যদি বঙ্গবন্ধুর মহান আদর্শ ও ঘোষণা অম্লান থাকতো, তাহলে খন্দকার মোশতাকের স্মৃতি ফুটে উঠতো। তখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কেউ বাড়াবাড়ি করতো না। দেশে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বৈষম্য থাকতো না। দেশের ষোল কোটি নাগরিক সবাই মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম বিবেচিত হতো। পাকিস্তানের ঘাতক বাহিনীর বিরূদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচার হতো। বাংলাদেশের যুদ্ধবিধ্বস্থ অসহায় নাগরিক এ লান্থণা পেতনা। পৃথিবীতে বাংলাদেশের ভাব মর্যাদা যুদ্ধাপরাধী নয়, মুক্তিযোদ্ধা ও বীরের জাতি স্বীকৃত হতো।
এ্যাডভোকেট, ঢাকা।
mrmostak786@gmail.com