ধর্মীয় দর্শন ডেস্কঃ ১৪৩৬ হিজরী শেষ হয়ে ১৪৩৭ হিজরীর সূচনা হয়েছে। এই সমাপ্তি ও সূচনায় ‘বর্তমান’ যেমন আছে তেমনি আছে ‘অতীত’। অতীতের পথ ধরেই আমরা বর্তমানে উপনীত হয়েছি এবং আমরা যেহেতু ভবিষ্যতের দিকেই ধাবমান তাই ‘বর্তমান’ও অতীতের গর্ভে বিলীন হয়ে চলেছে। তবুও আমরা বর্তমান নিয়েই খুব ব্যস্ত। জীবনের সকল অঙ্গনে আমরা যেমন অতীতকে বিস্মৃত হয়েছি তেমনি ভবিষ্যত সম্পর্কেও উদাসীন রয়েছি। ফলে আমাদের ‘বর্তমান’ও ফলপ্রসূ হয়ে উঠছে না।
একটি নতুন বর্ষের সূচনা শুধু আগমন নয়, বিদায়ও। জীবনের সময়-সম্পদ থেকে একটি পূর্ণ বছর ব্যয় হয়ে গেল। তাই নতুন বছরের আগমন বিদায়েরই বার্তাবাহক। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বহু সম্পদে সম্পদশালী করেছেন। অর্থ-সম্পদ, জ্ঞান-সম্পদ ও সময়-সম্পদ এ সবই আল্লাহর দান। তবে একটি প্রকাশ্য পার্থক্য এই যে, অর্থ-সম্পদ, জ্ঞান-সম্পদ ও অন্য সকল সম্পদে বিয়োগ যেমন হয় তেমনি যোগও হয়। মানুষ যেমন অর্থ ব্যয় করে তেমনি উপার্জনও করে। তদ্রূপ প্রতিনিয়ত আমরা যেমন বিস্মৃত হই তেমনি নতুন নতুন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধও হই। পক্ষান্তরে সময়-সম্পদে শুধু বিয়োগ, কোনো যোগ নেই। আমাদের জীবন থেকে দিন-রাত, সপ্তাহ, মাস ও বছর শুধু বিয়োগই হচ্ছে, যোগ হচ্ছে না। এভাবে প্রত্যেকের জীবনে সেই অমোঘ মুহূর্তটি উপস্থিত হয়ে যাবে, যা আল্লাহ পাক নির্ধারণ করে রেখেছেন।
একটি নতুন বছরের আগমনের তাৎপর্য হল জীবনের নির্ধারিত সময় থেকে একটি পূর্ণ বছর বিয়োগ হয়ে যাওয়া। প্রশ্ন এই যে, বিয়োগ কি কোনো আনন্দ ও উৎসবের বার্তা বহন করে? তাই একজন মুমিনের জন্য এ মুহূর্তটি উৎসবের নয়, ভাবনা ও হিসেব মেলানোর। সময়-সম্পদের যে অংশ ব্যয় হয়ে গেল তা কি প্রয়োজনীয় ও লাভজনক ক্ষেত্রে ব্যয় হয়েছে না অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর খাতে? জীবনের মূলধন খরচ করে জীবনকে আমরা কতটুকু সমৃদ্ধ করেছি? ব্যস্ত জীবনের প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত, প্রতিটি সপ্তাহ, মাস, বছর এই মুহাসাবার(নিজ আমলের হিসেব গ্রহণ) বার্তা নিয়ে আসে।
আরেকটি বিষয় এই যে, পার্থিব সকল সম্পদের মতো সময়-সম্পদও আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দান। এর প্রকৃত মালিক আল্লাহ তাআলা। তিনিই সময়ের সৃষ্টিকর্তা। মানুষকে এই সম্পদ তিনি দান করেছেন তার আদেশ মোতাবেক ব্যয় করার জন্য। তাই প্রদত্ত সময়-সম্পদ ব্যয় করে মানুষ যখন তাঁর কাছে ফিরে যাবে তখন প্রতিটি মুহূর্তের হিসাব দিতে হবে। তাই একটি নতুন দিন, নতুন রাত, একটি নতুন সপ্তাহ, মাস ও বছরের আগমন আমাদেরকে সেই হিসাব-দিবস সম্পর্কে সচেতন করে। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনিই রাত ও দিনকে একে অপরের অনুগামী করেছেন, তাদের জন্য যারা উপদেশ গ্রহণ করতে চায় অথবা শোকর গোযারী করতে চায়।’
তাই দিবস ও রজনীর আগমন ও নির্গমন একটি বিশেষ বার্তা বহন করে। যা অনুধাবন করাই হল প্রকৃত বুদ্ধিমানের পরিচয়। অতএব ১৪৩৭ একটি নতুন হিজরী বর্ষের সূচনা। আর তা এসেছে পরিসমাপ্তির পথ বেয়ে। তাই এটি বিগত সময়ের মুহাসাবা (নিজ আমলের হিসেব গ্রহণ) ও সামনের জন্য নতুন সংকল্পে উজ্জীবিত হওয়ার সময়। অতীতের যে সময়টুকু আল্লাহ তাআলা মর্জি মোতাবেক অতিবাহিত করার তাওফীক হয়েছে তার জন্য শোকরগোযারী আর যা গাফলত-উদাসীনতা ও আল্লাহর নাফরমানীতে বরবাদ হয়েছে তার জন্য অনুশোচনা। এটাই হল মুমিনের করণীয়। তবে মুমিনের আত্মপর্যালোচনা বর্ষকেন্দ্রিক নয়, মাস বা সপ্তাহকেন্দ্রিকও নয়। মুমিন প্রতিদিন তার কর্মের হিসাব গ্রহণ করবে এবং গতকালের চেয়ে আগামীকালকে অধিক ফলপ্রসূ করার চেষ্টা করবে। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-‘সকল মানুষ প্রত্যুষে উপনীত হয় এবং নিজের সত্ত্বাকে বিক্রি করে। হয় আল্লাহর কাছে বিক্রিত হয়ে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করে। নতুবা শয়তানের কাছে বিক্রিত হয়ে নিজেকে ধ্বংস করে। (সহীহ মুসলিম ৩/১০০)
সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেছেন, ‘যখন তুমি সন্ধ্যায় উপনীত তখন প্রত্যুষের অপেক্ষা করো না। আর প্রত্যুষে করো না সন্ধ্যার অপেক্ষা। সুস্থতার সময়ই অসুস’তার কথা মনে রেখে কাজ কর। আর জীবন থেকেই সংগ্রহ কর মৃত্যুর পাথেয়। হে আল্লাহর বান্দা! তুমি জান না, আগামীকাল তোমার উপাধি কী হবে? (জীবিত না মৃত)। (জামে তিরযিমী ৫/৪৬৮)
সুতরাং আজ প্রত্যেক মুমিনের ভেবে দেখা উচিত, আমরা কোথায় চলেছি এবং কী আমাদের পরিণতি? আসুন আমরা সবাই আমাদের কর্মের মুহাসাবা (নিজ আমলের হিসেব গ্রহণ) করি। তাই নতুন বছরের আগমনে কোনো আনন্দ-উৎসবের অবকাশ নেই; বরং এটা বিগত সময়ের কর্ম পর্যালোচনা করে আগামীর জন্য নতুন সংকল্প ও প্রেরণায় উজ্জীবিত হওয়ার সময়। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন!
লেখকঃ
মোস্তফা কবীর সিদ্দিকী
সিনিয়র লেকচারার , ইসলামিক স্টাডিজ ডিপার্টমেন্ট,
সাউথইস্ট ইউনির্ভাসিটি।
ইমেইলঃ mostafakabir_seu@yahoo.com
অগ্রদৃষ্টি.কম // এমএসআই