জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে জীবনবাজি রেখে দেশ মাতৃকার টানে শত্রুর কবল থেকে দেশকে মুক্ত করতে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার পশ্চিম বাগধা গ্রামের সংখ্যালঘু লক্ষ্মীকান্ত মধুর ছেলে অজিত মধু। মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র তার সংগ্রহে থাকলেও স্বাধীনতার ৪৫ বছর পেরোলেও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের কতিপয় কর্মকর্তাদের দাবিকৃত টাকা দিতে না পারায় তালিকাভুক্ত হতে পারেননি রণাঙ্গণ কাঁপানো যোদ্ধা অজিত মধু (৬০)।
আফসোস আর দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে অজিত মধু জানান, পাকিস্তানী শত্রুর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য তার রয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যুব শিবির নিয়ন্ত্রণ পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক মো. ইউসুফ আলী (এমএনএ) স্বাক্ষরিত সনদ, ভারতে প্রশিক্ষণ নেয়া হাসনাবাদের টাকি ক্যাম্পের সনদ, প্রতাপপুর টাকি ক্যাম্পে মেজর এমএ জলিল স্বাক্ষরিত সনদ, ৯নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর এমএ জলিল স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সেস সনদ, একই সেক্টর কমান্ডার এমএ জলিলের রিকমান্ডেশন কার্ডসহ পাঁচটি সনদপত্র। একাধিক সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরত্বের ভূমিকা পালন করা অজিত মধু দীর্ঘ ৪৫ বছরেও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম লেখাতে পারেননি। অজিত মধু আরও বলেন, তালিকাভুক্তির জন্য তার কাছে বিশ হাজার টাকা দাবি করেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের কতিপয় নেতারা। তাদের দাবিকৃত টাকা দিয়ে তিনি নাম লেখাতে অস্বীকার করায় আজও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম ওঠেনি তার। তবে এজন্য তার কোন আফসোস নেই জানিয়ে বলেন, তালিকায় কোন দিন নাম না উঠলেও টাকা দিয়ে তিনি তালিকাভুক্ত হবেন না।
২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের ছুটিতে বাড়ি এসে ইতিহাসের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ভুক্ত যোদ্ধা অজিত মধু বলেন, ১৯৭১ সালে বরিশাল পলিটেকনিক কলেজের ছাত্র অবস্থায় দেশে যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। এরইমধ্যে জাতির জনকের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ শুনে নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে পারেন নি। স্ত্রী ও স্বজনদের কথা ভুলে দেশমাতৃকার টানে ওই বছরের আগস্ট মাসে একই বাগধা গ্রামের দেবদাস রায়, উত্তর বাগধা গ্রামের লাল মিয়া মোল্লা, সাবেক মাস্টার সুলতান আহমেদ, বর্তমান উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আইউব আলী মিয়াসহ ১১জনে প্রশিক্ষণের জন্য যশোরের গঙ্গারামপুর-মল্লিকপুর গিয়ে ক্যাম্প কমান্ডার ওয়াদুদের মাধ্যমে ভারতে যান তারা।
ভারতের হাসনাবাদের টাকি ক্যাম্পের ট্রেনিং সেন্টারে কমান্ডার কবির হোসেনের কাছে অস্ত্র প্রশিক্ষণসহ যুদ্ধের বিভিন্ন কলাকৌশল রপ্ত করেন তারা। প্রশিক্ষণের সময় ৯নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর এমএ জলিল প্রায়ই তাদের ক্যাম্পে যাতায়াত করতেন। সেখান থেকে আরও উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য ঊড়িষ্যা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যান। সেখানে ভারতীয় বশোংদ্ভুত একজন শিখ সম্প্রদায়ের কমান্ডারের কাছে প্রশিক্ষণ নেন তারা। প্রশিক্ষণ শেষে মল্লিকপুরের ক্যাম্প কমান্ডার ওয়াদুদ তার ক্যাম্পে অজিত মধুসহ ১৩জন প্রশিক্ষিত যোদ্ধাকে নিয়ে যান। পরবর্তীতে মল্লিকপুর থেকে তাদের ১৩জনকে পাঠিয়ে দেয়া হয় বরিশাল সদরে। বরিশালে এসে ক্যাপ্টেন বেগ ও ক্যাপ্টেন ওমরের নেতৃত্বে প্রতাপপুর থেকে বরিশাল সদরে বর্তমান ওয়াপদা এলাকার সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। যুদ্ধ জয়ের বিজয় পতাকা নিয়ে ২৫ ডিসেম্বর বাড়িতে ফিরে আসেন। পরবর্তীতে জীবিকার প্রয়োজনে চলে যান ঢাকায়। একসময় তিতাস গ্যাসের টেকনিশিয়ান পদে চাকুরী নেন। বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন সাভার অফিসে। বর্তমানে স্ত্রী, ৩ পুত্র ও ৩ কন্যার ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম অর্থনৈতিক দৈন্যদশার মধ্যে থাকার কথাও জানান এই যোদ্ধা।
সংখ্যালঘু মুক্তিযোদ্ধা অজিত মধুর স্কুল পড়–য়া পুত্র সুমন জানায়, দেশের জন্য সকল জাতি ও ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে কাজ করা সত্বেও দেশ স্বাধীনের পরে ‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক’ হওয়ার কারণে আমাদের বি ত করা হয়েছে। এভাবে তাদের এলাকায় আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা এখনও তালিকাভুক্ত হতে পারেননি বলেও তিনি জানান। অজিত মধুর স্ত্রী সুকৃতি মধু বলেন, গত ১১ বছর পূর্বে তার স্বামীর নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্তির জন্য স্থানীয় উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের নেতৃবৃন্দের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ব্যর্থ হয়েছি। গত দু’বছর পূর্বে স্বামীর সহযোদ্ধা বর্তমান উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আইউব আলী মিয়ার কাছে একাধিকবার ধর্ণা দিয়েও কোন কাজ হয়নি। কমান্ডের কতিপয় নেতারা নাম তালিকাভুক্তির জন্য ২০ হাজার টাকা লাগবে বলে তাদের জানিয়ে দেন। তাদের দাবিকৃত টাকা দিতে না পারায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও আজও তার স্বামীর নাম তালিকাভুক্ত হয়নি।
নিরুপায় হয়ে আগৈলঝাড়া উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার কাছে ছুটে যান এ দম্পতি। সমাজসেবা কর্মকর্তা সুশান্ত বালা জানান, অজিত মধুর সকল কাগজপত্র দেখে তার আবেদনের সুপারিশ করে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। তবে তদবিরের অভাবে এখনওা কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ ব্যক্তিগত উদ্যোগেই তিনি অনলাইনে আবেদন করেছেন বলেও উল্লেখ করেন। টাকা চাওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে আগৈলঝাড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আইউব আলী মিয়া বলেন, অজিত মধু একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। অনলাইন আবেদনের যাচাই বাছাইয়ের পর তিনি তালিকাভুক্ত হতে পারবেন।