আরবী কফি, মরুভূমির ফল, মাছ আর শাকসব্জির কাঁচা বাজারের কথা বলা হয়নি এখনও। কিন্তু খাবার দাবারের গপ্পো আবার পরে একদিন হবে খন।
ইসলাম ধর্ম খুব বেশি বুঝিনা। তাই আমাদের দিকের মুসলিমদের সঙ্গে এদেশের মুসলিমদের ধর্মীয় আচারগত পার্থক্য তেমন বুঝতে পারিনা।এদের চেহারায় পয়সার চকচকানি আর দম্ভ আছে। বোরখার কাপড়ের কোয়ালিটি আর জারদৌসি কারুকার্য বহুমূল্যের এবং খুব অভিজাতদর্শন। এঁরা সুন্নি বলে এখানে মহরম হয়না। ছুটিও থাকেনা। এমনকি এখানে বসবাসকারী আমাদের দিকের শিয়া মুসলিমরাও মহরমের প্রসেশন বের করতে পারেননা।
পুরো রমজান মাস সমস্ত মসজিদে বিনামূল্যে ঢালাও ইফতারের ব্যবস্থা থাকে। ফল, জল, খেজুর, কোল্ডড্রিংক, স্যান্ডুইচ পেটভরা খাবার। সমস্ত পাবলিক প্লেস যেখানেই প্রেয়ার রুম আছে, সেখানেও এই ব্যবস্থা থাকে। ইফতারের জন্য সঙ্গে গুড় ছোলা বেঁধে কর্মস্থলে যেতে হয়না। এক মাস ধরে ইফতারের ব্যবস্থাটা এইভাবে হয়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের অনেকটাই সাশ্রয় হয়। এই সময় লোকসম্মুখে জল বা কিছু খাওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ।অমুসলিমরা বাড়িতে খান বা অফিসে কোন ফাঁকা ঘরে দরজা বন্ধ করে লাঞ্চ সারেন। তবে কাজের সময়সীমা দু ঘন্টা কমে যাওয়ায় তেমন অসুবিধাও হয়না।
এমনিতে তো তাপমাত্রা পঞ্চাশ ডিগ্রী ছুঁলে এবং গ্রীষ্মকালে দুপুর এগারোটা থেকে বিকেল চারটে বাইরের কাজ মানে ক্ষেতখামার, কনস্ট্রাকশন ইত্যাদির কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখানে কর্মজীবন ভোর থেকে শুরু হয়ে যায়।
এদের কোনও অনুষ্ঠানই উগ্র নয়। পাঁচবার আজান কানে লাগেনা। কারণ মাইক খুব জোরে নয়। এক মসজিদের আজানের সুর মিলিয়ে যাওয়ার আগেই যাতে আর এক মসজিদের আজান পথচলতি মানুষের কানে আসে, এইভাবে দূরত্ব মেপে মসজিদ বানানো।
ঈদের আগে চলে বিশাল সেল। সেই সময় শুধু কাপড়চোপড় গয়নাগাটি নয় ; খাবারদাবার, বাসনকোসন, মশলাপাতি, সাজগোজের জিনিস, ইলেক্ট্রনিক্স, বিছানাপত্তর সব কিছুই বেশ কম দামে পাওয়া যায়।
ঈদেও কোনও হৈচৈ নেই। রাস্তা ভর্ত্তি অগণিত মানুষের মুখে আনন্দ আর পরনের রত্নখচিত নানা ডিজাইনের বোরখাতেই উৎসবের মেজাজ ধরা পড়ে।
অন্যকে ইফতার খাওয়ানো একটা বিরাট পুণ্যের কাজ। আমাদের ঘনিষ্ঠ আজাদ ভাই প্রতিবার একদিন আমাদের ইফতার খাওয়ান। রমজান মাসে আমিও একদিন ওঁকে নিজের হাতে রেঁধে খাওয়াই। আমাদের ঘরে তাঁর জন্য জায়নামাজও রাখা আছে। ঈশ্বর তো সর্বত্র সব ভাবেই আরাধ্য।
কিছুদিন আগে হজে গিয়ে আজাদ ভাই আমার জন্য একটি তসবী নিয়ে এসেছেন। কিন্তু একশ আটটা বিড থাকলে নাহয় জপ করতে পারতাম ; তাই ঠাকুরের কাছে রেখে দিয়েছি। আমার হাতের ব্যথা দেখে সেদিন আজাদ ভাই এক বোতল জমজমের জল এনে দিলেন। ছেঁড়া শিরা তো গঙ্গা, জর্ডন বা জমজম কোনও জলই জুড়তে পারবেনা। তবু “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু ….” । আমিও নিত্যপূজা সেরে সেই জল খাই রোজ।
আজ একটা গল্প বলার কথা । এবার বলি ?
এখানে কেউ জন্মালে আগে মিউনিসিপ্যালিটি আরবীতে বার্থ সার্টিফিকেট দেবে, সেটা দেখে ট্রান্সলেটর ইংরিজিতে নাম ধাম তারিখ ট্রান্সলেট করবে। সেই ট্রান্সলেটেড কাগজ অথেন্টিক ট্রান্সলেশন বলে আর একটা সরকারী অফিস স্ট্যাম্প দেবে। সেই স্ট্যাম্পড ট্রানস্লেটেড কাগজের ভিত্তিতে ভারতীয় এম্ব্যাসি দেবে বার্থ সার্টিফিকেট। সেই বার্থ সার্টিফিকেট দিয়ে হবে তার পাসপোর্ট।
কর্তার এক তামিল সহকর্মী সদ্য পিতা হয়ে মহানন্দে স্থানীয় ব্যালেডিয়া (মিউনিসিপ্যালিটি) য় গেছেন সদ্যজাতা কন্যার বার্থ সার্টিফিকেট বের করতে। স্বামীস্ত্রী অনেক বইপত্তর ঘেঁটে বড়ো সাধ করে মেয়ের নাম ঠিক করেছেন বিশালাক্ষী। শুদ্ধ তামিল উচ্চারণে সেটা আবার ভিশালাক্-ষী।
যথারীতি কাউন্টারে বসে এক গম্ভীর কুয়েতি মহিলা। বাপমার নাম,তারিখ ,ঠিকানা সব লেখা হল। গোল বাধল জাতিকার নাম নিয়ে। কুয়েতি মহিলা কানে শুনে তো বুঝছেইনা, ইংরিজিতে বানান লিখে দিলেও আরবীতে তার বানান কি হবে কিছুতেই বুঝতে পারছেনা।দুজনের কথোপকথন এই প্রকার :
- ভদ্রলোক : ম্যাডাম, ভিশালাকষী
- কুয়েতি : ষুনু (কি) ??
- ভি শা লা ক ষী
- (নাকচোখ কুঁচকে ) অ্যাহ ? ষুনু ?
- ভি শা ল….
- (খসখস করে লিখে)
ফতিমা । খাল্লাস।
ভদ্রলোক আবার বোঝাতে গেলেন। কুয়েতি মহিলা চোখ পাকিয়ে তর্জনী তুলে গর্জে উঠল, “রো”।
ভদ্রলোক অবশ্য “রো” হয়ে চারমাস রোদে রোদে রোডে ঘুরে এফিডেফিট করে মেয়েকে ফতিমা থেকে বিশালাক্ষী করেই ছেড়েছেন ।
লেখক:
গার্গী চক্রবর্তী (ভারত)
চলবে……