কুয়েত একটি ইসলামিক রাষ্ট্র, আমি নিজধর্মবিশ্বাসী ও পরধর্মে শ্রদ্ধাশীল।
কুয়েতের সামাজিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক ধর্মীয় অবস্থান আমার চোখ দিয়ে দেখুন।
বছর বারো আগে কর্তা যখন চাকরি নিয়ে চলে এলেন এই কুয়েতে, তখন সাদ্দাম হোসেনের কল্যাণেই শুধু কুয়েত নামটা জানতাম। প্রত্যক্ষে পরোক্ষে আত্মীয় পরিজন সবাই আমায় দুষলেন,আমার বড়ো টাকার খাঁই। তা তখন চার বছরের ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে মাসের শেষে টানাটানি হলে টাকার মূল্য হাড়ে হাড়ে টের পেতাম বৈকি। তবে কুয়েত নামক দেশটায় এলেই যে বিনা আয়াসে ঘরে বসে খেয়ে শুয়ে রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা অফুরন্ত টাকা মুঠো মুঠো তুলে নিয়ে ভারতের ব্যাঙ্কে ঠেসে ঢোকানো যায়, এটা জানা ছিলনা ; এখনও জানা নেই।
আগাপাশতলা শিক্ষক পরিবারের মেয়ে বলেই হোক বা খানিকটা নির্বিকার বলেই হোক কর্তার কাজকম্মের ধরণ ধারণ আমার ক্ষুদ্র মাথায় বিশেষ ঢোকেনা। আর মাথা খুঁড়লেও যা আমি কিছুতেই বুঝতে পারবনা, তা নিয়ে খামোখা মাথাব্যথা করবই বা কেন ! কর্তা তো সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য আনতে এই “মুসলমানের দেশে” জাত খোয়াতে একা চলে এলেন, আমি শিশুপুত্র নিয়ে একা রইলাম কলকাতার এক চিলতে ফ্ল্যাটে। শুরু হল এক অন্যরকম দাম্পত্য।
ছেলেকে আপন দেশের মূল্যবোধে বড় করা, এক সন্তান হিসেবে বাবামার প্রতি কর্তব্যপালন, একমাত্র ছেলের বউ হিসেবে বিধবা শাশুড়ির খেয়াল রাখা এসব ছোটখাট দায়িত্ব আমি পালন করতে লাগলাম। কর্তা রোজ রাতে ফোন করতেন। আর মাস ছয়েক পরেই দেশে গিয়ে ছেলেকে আর আমাকে এদেশে বেড়াতে নিয়ে এলেন।
আসার আগে কেউ বলল এখানে আমায় বোরখা পরতে হবে, কেউ বলল না জেনে গোমাংস তো অবশ্যই খেয়ে ফেলব আর তাতে মুসলমানরা বেজায় উৎফুল্ল হবে, এখানে মহিলাদের ন্যূনতম সম্মান নেই ; এমনকি কেউ আমায় জবরদস্তি নিকাহ করেও নিতে পারে। আসলে তাদেরই বা দোষ কি ! আজন্মের কূপজীবন তখনও ফেসবুক ইউটিউবের গুজব ছাড়াও আজকের মতই মন্ডুকবৎই ছিল।
সেবার এসে দেড় মাস ছিলাম। তারপর এই বারো বছরে বোধকরি বার চল্লিশ এদেশে এসেছি। না, কর্তার গলার পৈতে কেউ খোলায়নি, আজ অবধি আমায় বোরখা পরতে হয়নি , আর গোরুর মাংস এখানে লুকিয়ে খাইয়ে দেবার দরকার নেই ; হোটেল গুলোতে জনসমক্ষেই বিক্রি হয়। না চাইলে খামোখা খাওয়াবে কেন ! এদেশের নারীপুরুষ সবাই দেখতে এত সুন্দর যে আমায় দেখে নিকাহ করার সাধ পাগলাগারদে বসেও এদের হবেনা।
ছোট্ট একটা ঘটনা বলে এই সিরিজের আজকের পর্ব শেষ করি :
প্রথমবার এসে একদিন লুলু হাইপার মার্কেটের সামনে দুই হাতে জিনিসপত্রের ঝোলা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কর্তা ছেলেকে নিয়ে অদূরেই ট্যাক্সি ডাকতে গেছেন। হঠাৎ বিকট আওয়াজ। আমার হাত ধরে সজোরে হেঁচকা টান। কাউকে একটা চেপ্পে জড়িয়ে ধরে ভয়ে চোখ বুজে আমি ঠকঠক করে কাঁপছি। চারদিকে হৈচৈ। তারমধ্যেই আমার কানে আসছে পুরুষ কণ্ঠের সরি সরি আর কিছু অজানা ভাষায় দুর্বোধ্য শব্দ।
কর্তার গলায় থ্যাঙ্কু শুনে ধড়ে প্রাণ ফিরে পেয়ে আস্তে আস্তে চেয়ে দেখলাম এক দীর্ঘদেহী গৌরবর্ণ অপরূপ সুপুরুষ কে আমি জড়িয়ে ধরে, সাদা জোব্বা পরা মানুষটি আন্তরিকভাবে আমায় কিসব বোঝাচ্ছেন আর সরি বলছেন। কর্তা ততোধিক আন্তরিকভাবে ওনাকে থ্যাঙ্ক্যু বলছেন। হতভম্বের মত ট্যাক্সিতে উঠলাম।আমাদের ছড়িয়ে যাওয়া জিনিসগুলো সবাই হাতে হাতে তুলে দিলেন।
ট্যাক্সিতে বসে জানলাম আমার কিছুটা পিছনে জুস্ ভর্তি কাচের বোতল বোঝাই একটা বিরাট ট্রলি নিয়ে দোকানের এক কর্মচারী আসছিলেন। স্লোপিংয়ের জায়গায় ওনার হাত স্লিপ করে ট্রলি একাই গড়গড়িয়ে নেমে আসছিল। সেটা সোজা এসে আমায় ধাক্কা দিলে আমি মুখ থুবড়ে পড়তাম, আমার ওপর ট্রলি উল্টে বোতল পড়ে ভেঙে চুড়ে ……ইত্যাদি। হতে পারত অনেক কিছুই, কিন্তু আমি অক্ষত থেকে গেলাম ওই কুয়েতী ভদ্রলোক ঠিক সময় আমায় টেনে নিয়েছিলেন বলে।
তা ভদ্রলোক আমায় প্রাণে বাঁচিয়ে সরি বলছিলেন কেন ? এদেশে মহিলাদের অপমান করলে হাজতবাস নিশ্চিত, প্রাণদণ্ডও হতে পারে। সবটাই নির্ভর করবে সংশ্লিষ্ট মহিলার অভিযোগের গুরুত্বের ওপর। ভদ্রলোক অনিচ্ছাকৃতভাবে নেহাতই মানবিকতার খাতিরে আমায় ছুঁয়ে ফেলেছেন বলে আমি যেন পুলিশের কাছে না যাই, এই অনুরোধ করছিলেন।
লেখক:
গার্গী চক্রবর্তী (ভারত)
চলবে……