মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি : মানিকগঞ্জ ও রাজবাড়ি জেলার সীমান্ত এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা নদীতে এমভি মোস্তফা লঞ্চ ডুবির এক বছর পূর্ণ হলো আজ। গত বছরের এই দিনে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে এমভি নার্গিস-১ কার্গো জাহাজের ধাক্কায় প্রায় দুইশ’ যাত্রী নিয়ে পথিমধ্যে ডুবে যায় লঞ্চটি।
এতে যাত্রী ও লঞ্চ কর্মচারীদের মধ্যে ৮০ জনের লাশ উদ্ধার করা হলেও নিখোঁজ থাকেন চারজন। তাদের মধ্যে ৭৯ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
আর আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাফন করা হয় এক মধ্য বয়সী নারীর বেওয়ারিশ লাশ।
এই লঞ্চ দুর্ঘটনায় অনেক পরিবারই একমাত্র উপার্জনড়্গম বাবা, মা, ভাই, বোন হারিয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। এসব নিহত ও বিশেষ করে নিখোঁজদের স্বজনের কান্না আজো থামেনি।
উদ্ধারের পর এসব লাশ বাড়ি নিয়ে গিয়ে নিজ নিজ ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী দাফন, সমাধিস্থ ও অগ্নিদাহ করেছেন স্বজনরা। তাদের শেষ স্মৃতি চিহ্ন আঁকড়ে ধরে আছেন তারা।
কিন্তু নিখোঁজদের স্বজনেরা তা পারেননি। তারা আজো নিখোঁজদের খুঁজে বেড়ান পদ্মা নদী ও তীরবর্তী এলাকাগুলোতে। দুর্ঘটনায় প্রত্যেক নিহতের পরিবারকে এককালীন ১ লাখ ৫ হাজার টাকা এবং দাফন, সমাধিস্থ ও অগ্নিদাহ করতে আরো ২০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দিয়েছে নৌ-মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসন। কিন্তু পরবর্তীতে নিখোঁজদের উদ্ধারে কোনো তৎপরতা ও পরিবারগুলো কোন আর্থিক সহায়তা পাননি বলে স্বজনরা জানিয়েছে। এদিকে, এই দুর্ঘটনায় নৌ-মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনে গঠিত পৃথক তদন্ত কমিটি ইতিমধ্যেই আঘাতকারী কার্গো ও ডুবে যাওয়া লঞ্চের চালকদের দায়ী করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আর শিবালয় থানায় দায়ের করা পুলিশের মামলাটি বর্তমানে মানিকগঞ্জ গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) তদন্ত করছে। প্রত্যক্ষদর্শী ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, দুর্ঘটনার দিন দুপুর পৌনে ১২ টার দিকে পাটুরিয়া ঘাট থেকে প্রায় দুইশ’ যাত্রী নিয়ে এমভি মোস্তফা লঞ্চ দৌলতদিয়া ঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। পথিমধ্যে বাঘাবাড়িগামী সার বোঝাই কার্গো জাহাজ এমভি নার্গিস-১ বাম পাশ থেকে ধাক্কা দিলে লঞ্চটি ডুবে যায়।
এ সময় অনেক যাত্রী সাঁতরিয়ে কার্গো জাহাজে ও ট্রলারে ওঠে প্রাণে রক্ষা পান। এরপর নৌ-বাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল একে একে লাশ উদ্ধার করতে থাকেন। ওইদিন বিকেলে বিভিন্ন সংস্থার উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেন, প্রত্যেক নিহতের দাফনের জন্য ২০ হাজার টাকা ও নৌ-মন্ত্রণালয় থেকে পরিবারকে ১ লাখ ৫ হাজার করে এককালীন সহায়তা দেয়া হবে। দুর্ঘটনার পর থেকে নৌ-বাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল অভিযান চালিয়ে ৮০ জনের লাশ উদ্ধার করে। একই সঙ্গে এই লঞ্চ ভ্রমণ সঙ্গীর লাশ পাওয়া গেলেও সবমিলিয়ে নিখোঁজ থাকেন রাজরাড়ির পাংশা উপজেলার নাচনা গ্রামের মৃত সেকেন আলী শেখের স্ত্রী আজিরণ নেছা (৪৮), ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার আটকা হনিয়া গ্রামের মৃত গণি মোলস্নার ছেলে ইউনুছ মোল্লা (৫৬), নড়াইলের নড়াগাতি উপজেলার লোহারগাতি গ্রামের আইয়ুব আলীর স্ত্রী আনোয়ারা বেগম (৫৭) ও লোহাগড়া উপজেলার লঙ্কারচর গ্রামের মৃত হাসেম শেখের স্ত্রী সাহেদা বেগম (৫৫)।
এরই মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করেন জেলা প্রশাসন। এতেই দিশেহারা হয়ে পড়েন নিখোঁজের স্বজনরা। এরপর থেকে নিজেদের মতো করে নিখোঁজদের খোঁজ করতে থাকেন তারা।
নিখোঁজ আজিরণ নেছার ছেলে হাসান শেখ জানান, দুর্ঘটনার দিন তার মা আড়াই বছর বয়সী ভাগনি রিয়ামণিকে নিয়ে লঞ্চে বাড়ি ফিরছিলেন। দুর্ঘটনার দ্বিতীয় দিনে ভাগনির লাশ উদ্ধার করা হলেও মায়ের লাশ পাননি তারা। ট্রলার নিয়ে ভাটি এলাকায় গিয়েও স্বজনেরা লাশের সন্ধান করেছেন। কিন্তু কোনো খোঁজ মিলেনি। আজো পদ্মা নদী তীরবর্তী কোনো এলাকায় লাশ উদ্ধার হওয়ার খবর পেলে ছুটে যান সেখানে তারা। মায়ের লাশ না পেয়ে খালি হাতে ফিরে আসতে হয় তাদের। মায়ের লাশ নিজ বাড়ি দাফন করতে পারলে একটু সান্তনা পাওয়া যেত বলে আফসোস করেন হাসান। আরেক নিখোঁজ আনোয়ারা বেগমের মেয়ে বিউটি বেগম জানান, তার আট বছর বয়সী মেয়ে কেয়ামণিকে নিয়ে তার মা গ্রামের গাজীপুরের বাসা থেকে গ্রামের বাড়ি ফিরছিলেন। মেয়ের লাশ পেয়েও মায়ের লাশের কোনো সন্ধান মিলেনি।
মেয়ের লাশ দাফনের ২০ হাজার টাকা ও এককালীন ১ লাখ ৫ হাজার টাকা সহায়তা পেয়েছেন তিনি। কিন্তু নিখোঁজ মায়ের জন্য কিছু করা সম্ভব হয়নি বলে জানান বিউটি।
সাহেদার বেগমের ভাগনে নুর আলম জানান, তার খালা নিঃসন্তান ছিলেন। ওই লঞ্চে সাহেদা তার প্রতিবেশী ভাগনে মোস্তফাকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন।
দুর্ঘটনার পরেই মোস্তফা সাতরিয়ে প্রাণে রক্ষা পেলেও সাহেদার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিস এবং নদীতে ট্রলার নিয়েও খোঁজ করা হয়েছে তার খালাকে। কিন্তু কোনো সন্ধান মিলেনি।
একই কথা বলেছেন ইউনুছ মোল্লার ছেলে নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, তার বাবা ঢাকায় কাজ করতেন। লঞ্চে তিনি বাড়ি ফিরছিলেন। এরপর থেকেই তিনি নিখোঁজ রয়েছে।
ভাটি এলাকায় গিয়ে তার সন্ধান করা হয়েছে। কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। জেলা প্রশাসন ও পাটুরিয়ার নৌ-পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়েও তার খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। তাকে উদ্ধার কিংবা সন্ধানের বিষয়ে কেউ কিছু বলতে পারেননি। এই লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহতদের সঙ্গে নিখোঁজদের স্বজনরা নিজ নিজ ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী আজ প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেছেন বলে অনেকে জানিয়েছেন। শিবালয় থানার ভারপ্রাপ্ত (ওসি) রকিবুজ্জামান জানান, দুর্ঘটনার পরেই পুলিশ কার্গো জাহাজসহ মাস্টার ইকবাল হোসেন (৩২), লস্কর মো. শাহিনুর রহমান (২১), শহিদুল ইসলাম (২৪) ও মো. জহিরুল ইসলামকে (১৮) আটক করে। এ ঘটনায় পাটুরিয়া নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আবদুল মোক্তাদের থানায় একটি মামলা করেন।
ওই মামলায় কার্গোর মাস্টার ও লস্করদের আদালতে পাঠানো হয়। বর্তমানে ওই মামলাটি পুলিশের মানিকগঞ্জ গোয়েন্দা শাখা তদন্ত করছে। মানিকগঞ্জ গোয়েন্দা শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম জানান, নিহতের স্বজনদের বাড়ি বিভিন্ন জেলায় এ কারণে মামলার তদন্ত কাজ একটু বিলম্বিত হচ্ছে। দ্রুতই তদন্ত কাজ শেষ করা হবে। এদিকে, গত বছরের ১৫ মার্চ তদনত্ম কমিটির আহ্বায়ক নৌ-মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নূর-উর-রহমানসহ কমিটির সদস্যরা তদন্ত প্রতিবেদন নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান ও নৌ-সচিব শফিক আলম মেহেদীর কাছে জমা দেন। তদন্ত কমিটি আঘাতকারী কার্গো ও ডুবে যাওয়া লঞ্চের চালকদের দায়ী করে প্রতিবেদন জমা দেন। ওই তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এমভি মোস্তফা দুর্ঘটনায় আঘাতকারী জাহাজ এমভি নার্গিস-১ জাহাজের চালকের দায় বেশি। স্রোতের বিপরীতে থাকা সত্ত্বেও তিনি জাহাজের গতি কমাননি। অপরদিকে, মোস্তফার চালক অসতর্কভাবে জাহাজ চালিয়েছেন।
নৌযানগুলোর চালকরা অসতর্ক ও বেপরোয়া ছিলেন এবং নিরাপত্তাবিধি মেনে চলেননি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এই তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে নৌ-আদালতে দুর্ঘটনার মামলাটি পরিচালিত হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক রাশিদা ফেরদৌস জানান, ঘোষণা অনুযায়ী নৌ-মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসন প্রত্যেক নিহতের পরিবারকে সর্বমোট ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে।আর নিখোঁজের স্বজনরা কেউ এ বিষয়ে প্রশাসনকে জানাননি। তারা লিখিতভাবে জানালে অবশ্যই খোঁজ খবর নিয়ে পরিবারগুলোর জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হতো।