সিরাজী এম আর মোস্তাকঃ বাংলাদেশে মাত্র দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা ও ৪১ জন বীরাঙ্গনার জন্য প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধা কোটানীতিই মূলত মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির একমাত্র কারণ। যতদিন এ অবৈধ কোটানীতি চালু থাকবে, ততদিন মুক্তিযুদ্ধের অমর শহীদদের সংখ্যাটি বিতর্কিতই থেকে যাবে। পৃথিবীর কোথাও এমন অবৈধ মুক্তিযোদ্ধা কোটানীতি নেই। সাধারণত বিজয়ের পর দেশের সবাই যোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত হয়। যারা যুদ্ধ করেন তাদের মধ্যে শহীদ, গাজী, আহত ও বন্দী সবই থাকে। এ যোদ্ধা ও শহীদদেরকে আলাদা করা আদৌ সমীচীন নয়। কারণ আগে যোদ্ধা, তারপর শহীদ। আর সকল যোদ্ধা কখনও শহীদ হয়না। বরং বিশাল যোদ্ধা সংখ্যার একাংশ বা কিয়দাংশ মাত্র শহীদ হয়ে থাকে। বেশীরভাগই হয় আহত, বন্দি বা গাজী। ১৯৭১ সালে তাই হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ অনুযায়ী, এদেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালি তাদের ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা এনেছিল। তারা সবাই ছিলেন এক একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধু মাত্র ৬৭৬ জন বিশিষ্ট যোদ্ধাকে বিশেষ খেতাব প্রদান করে অবশিষ্ট সকল নাগরিককে সুস্পষ্টভাবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদেরকে কখনো পার্থক্য করেননি।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এক শ্রেণীর অসাধু রাজনীতিবিদ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অতিশয় বাড়াবাড়ি শুরু করে। তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে। শুধু রাজনৈতিক স্বার্থে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিতর্কিত তালিকা প্রণয়ন করে। মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি করে। ‘৭১ এর সাড়ে সাত কোটি সংগ্রামী বাঙ্গালি ও তাদের ত্রিশ লাখ শহীদদেরকে বঙ্গবন্ধুর দেয়া মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করে। মাত্র প্রায় দুই লাখ ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। তালিকাভুক্তদের জন্য নানা সুবিধাসহ অবৈধ মুক্তিযোদ্ধা কোটা চালু করে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মহোদয়ও এ সকল অসাধু রাজনীতিবিদদের অন্যতম। তিনি মুক্তিযোদ্ধা কোটা সুবিধা বহুগুণে বৃদ্ধি করেছেন। বাংলাদেশে প্রচলিত দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ও কোটাকে আরো স্থায়ী করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানসহ নাতি-নাতনিদেরকেও কোটা সুবিধায় সংযুক্ত করেছেন। তিনি ২০০৯ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদেরকে ব্যাপক সুবিধা প্রদান নীতি গ্রহণ করেছেন। নীতিটি এরকম- ‘৭৫ এর পর এযাবতকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি বা চাকুরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে শতকরা ৩০ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পরিপালনে যতটুকু ভঙ্গ বা ঘাটতি হয়েছে, তা সম্পুর্ণ পুরণ করা।’ ফলে ইতিমধ্যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, বিসিএস ও অধিকাংশ সরকারী চাকুরীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধা কোটানীতি পরিপালন করা হয়েছে। এ অবৈধ নীতিটি কোটাভোগীদের পক্ষ থেকে খুবই প্রশংসিত হয়েছে।
এ অবৈধ মুক্তিযোদ্ধা কোটার ফলে স্পষ্ট হয়েছে যে, শুধুমাত্র তালিকাভুক্ত দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধাই দেশ স্বাধীন করেছেন। এতে অন্য কারো ভূমিকা নেই। খোদ বঙ্গবন্ধুও মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত নন। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুরও কোনো অবদান নেই। তিনি বাঙ্গালি জাতির জনক নন। এভাবে ৭১ এর সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালি, তাদের ত্রিশ লাখ শহীদ, দুই লাখ নারী, শরণার্থী, পাকিস্তানে অবরূদ্ধ বাঙ্গালি এবং দেশে অবস্থানরত যুদ্ধবিধ্বস্ত সংগ্রামী বাঙ্গালি কেউ তালিকাভুক্ত নন। মুক্তিযুদ্ধে এদের কেউ কোনো ভূমিকা রাখেননি।
স্বাধীনতার পর বাঙ্গালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনের সংখ্যাটি সুনির্দিষ্ট করেছিলেন। শুধুমাত্র অবৈধ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ও কোটার কারণেই উক্ত সুনির্দিষ্ট সংখ্যাটি চরম বিতর্কিত হয়েছে। তাই বঙ্গবন্ধুর ভাষ্যানুযায়ী শহীদ ও আত্মত্যাগীদের সংখ্যা ‘ত্রিশ লাখ’ না হয়ে যদি ‘তিন লাখ’ও হতো তবু তা বিতর্কিত হতো। কারণ, সে সংখ্যাটিও বর্তমান তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে বেশী। এতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা সংখ্যা কমপক্ষে পাঁচ লাখে দাড়াতো। আর ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের সংখ্যাটি সঠিক মানলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা সংখ্যা কমপক্ষে চৌত্রিশ লাখ হতো। অর্থাৎ বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা সংখ্যা এসমস্ত সংখ্যার কোনোটিতেই নেই। তা শুধু দুই লাখ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। তবে এবছর (২০১৫ সালে) মাত্র ৪১ জন বীরাঙ্গনা সংযুক্ত হয়েছে। এতে সুস্পষ্ট হয়েছে যে, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যাটি যেহেতু তালিকাভুক্ত যোদ্ধার অধিক, তাই উক্ত ‘ত্রিশ লাখ’ এবং ‘তিন লাখ’ কোনো সংখ্যাই সঠিক নয়। এ সংখ্যা বড়জোর ত্রিশ হাজার বা তিন হাজার হতে পারে।
মূলত যতোদিন বাংলাদেশে প্রচলিত অবৈধ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ও কোটা বাতিল না হবে, ততোদিন প্রকৃত যোদ্ধা ও শহীদদের সংখ্যাটি বিতর্কিতই থাকবে। এ প্রসঙ্গে আরো স্পষ্ট যে, ১৯৭১ সালে এদেশের সাড়ে সাত কোটি সংগ্রামী বাঙ্গালি ভারতীয় সেনাবাহিনীর পুর্ণ সহযোগীতা ছাড়া কখনোই দেশকে স্বাধীন করতে পারতেন না। আমাদের স্বাধীনতার জন্য হাজার হাজার ভারতীয় সেনাসদস্য যেমন যুদ্ধ করেছেন, তেমনি প্রাণও বিসর্জন দিয়েছেন। তাই এদেশের সাড়ে সাত কোটি বীর বাঙ্গালী ও ত্রিশ লাখ শহীদের সাথে হাজার হাজার ভারতীয় যোদ্ধা ও শহীদেরাও এক একজন মুক্তিযোদ্ধা বিশেষ। তাদেরকে বাদ দিয়ে মাত্র দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা ও ৪১ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা কোটাভুক্ত করা চরম বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। এ ধরণের বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই আমাদের মহান শহীদদের সংখ্যাটি বিতর্কিতই রয়ে গেছে। জার্মান চ্যাঞ্চেলর এডলফ হিটলার প্রায় ষাট লাখ ইহুদিকে হত্যা করেছিলেন। এ সংখ্যা নিয়েও বিতর্ক হয়েছিল। কিন্তু সেখানে বাংলাদেশের মতো এমন ঘৃণিত মুক্তিযোদ্ধা কোটানীতি চালু না থাকায় ষাট লাখ সংখ্যাটি সর্বসম্মতিক্রমে সঠিক হিসেবে গৃহীত হয়েছে। তেমনি বাংলাদেশেও যদি প্রচলিত অবৈধ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ও কোটা বাতিল করা হয়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও শহীদদের সংখ্যাটি সন্দেহাতীতভাবে সত্যরূপে গৃহীত হবে।
অতএব, প্রচলিত অবৈধ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ও কোটা নীতি বাতিল করে বাংলাদেশ-ভারত নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা পালনকারী সকল বীর শহীদ ও যোদ্ধাদেরকে এক একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করা উচিত। দেশের বর্তমান ষোল কোটি নাগরিক সবাইকে উক্ত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য হিসেবে ঘোষণা করা উচিত।
সিরাজী এম আর মোস্তাক, এ্যাডভোকেট, ঢাকা।