সিরাজী এম আর মোস্তাকঃঃ বাংলাদেশে স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ ও আত্মত্যাগীর সংখ্যা নিয়ে বিতর্কের সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। যতদিন এ কারণটি বিদ্যমান থাকবে, ততদিন শহীদের সংখ্যাটি বিতর্কিত থাকবে। এডলফ হিটলার জার্মানে বসবাসরত প্রায় ষাট লাখ ইহুদিকে হত্যা করেছিলেন। এ সংখ্যা নিয়েও বিতর্ক হয়েছিল। সেখানে বাংলাদেশের মতো সুনির্দিষ্ট কারণ না থাকায় ষাট লাখ সংখ্যাটি অকাট্যরূপে গৃহীত হয়েছে। মূলত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শহীদ ও আত্মত্যাগীদের তালিকা করা যেমন অসাধ্য, তেমনি অমানবিক। একজন শহীদের মা জননী তার নিজ সন্তানের জন্য অন্য লাখো শহীদের চেয়ে বেশী কষ্ট অনুভব করেন। এজন্য শহীদদেরকে কোনো সংখ্যা দ্বারা সীমাবদ্ধ করা বা তাদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় পোষণ করা মোটেও সমীচীন নয়। তারা মহান ও চিরন্তন।
স্বাধীনতার পর বাঙ্গালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনের সংখ্যাটি অকাট্যরূপে ঘোষণা করেন। তিনি মাত্র ৬৭৬ জন বিশিষ্ট যোদ্ধাকে খেতাব প্রদান করে অবশিষ্ট সবাইকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদেরকে পার্থক্য করেননি। পাকি খুনিদের বিচারের উদ্দেশ্যে তিনি রাজাকারদের বিচার শুরু করেন। কিন্তু উদ্দেশ্য সফল না হওয়ায় তিনি বিচার বাতিল করেন এবং দেশ থেকে মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা বৈষম্য দূর করেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এক শ্রেণীর অসাধু রাজনীতিবিদ মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা নিয়ে অতিশয় বাড়াবাড়ি করেন। তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেন। রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে মুক্তিযোদ্ধাদের বিতর্কিত তালিকা প্রণয়ন করেন। মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি করেন। ‘৭১ এর সাড়ে সাত কোটি সংগ্রামী বাঙ্গালি ও তাদের ত্রিশ লাখ শহীদদেরকে বঙ্গবন্ধুর দেয়া মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করেন। তারা মাত্র দুই লাখ ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেন। এদের জন্য নানা সুবিধাসহ অবৈধ মুক্তিযোদ্ধা কোটা চালু করেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মহোদয় উক্ত সুবিধাধি বহুগুণে বৃদ্ধি করেছেন। তিনি বাংলাদেশে প্রচলিত উক্ত দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ও কোটা আরো স্থায়ী করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানসহ নাতি-নাতনিদেরকে কোটাসুবিধায় সংযুক্ত করেছেন। তিনি ২০০৯ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদেরকে ব্যাপক সুবিধা প্রদান নীতি গ্রহণ করেছেন। নীতিটি এরকম- ‘৭৫ এর পর এযাবতকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি বা চাকুরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে শতকরা ৩০ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পরিপালনে যতটুকু ভঙ্গ বা ঘাটতি হয়েছে, তা সম্পুর্ণ পুরণ করা।’ এতে ইতিমধ্যে বিসিএসসহ প্রায় অধিকাংশ চাকুরীতে শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধা কোটাতে নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। এ অবৈধ নীতিটি সুবিধাভোগীদের থেকে খুবই প্রশংসিত হয়েছে।
প্রচলিত অবৈধ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ও কোটাতে স্পষ্ট হয়েছে যে, শুধুমাত্র তালিকাভুক্ত দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধাই এককভাবে দেশ স্বাধীন করেছেন। এতে অন্য কারো ভূমিকা নেই। খোদ বঙ্গবন্ধুও মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত নন। অতএব, মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুরও কোনো অবদান নেই। এভাবে ৭১ এর সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালি, তাদের ত্রিশ লাখ শহীদ, দুই লাখ নারী, শরণার্থী, পাকিস্তানে অবরূদ্ধ বাঙ্গালি এবং দেশে অবস্থানরত যুদ্ধবিধ্বস্ত সংগ্রামী বাঙ্গালি কারো কোনো অবদান নেই।
প্রচলিত অবৈধ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ও কোটা নীতিই মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের সংখ্যা প্রসঙ্গে বিতর্কের একমাত্র কারণ। এতে শহীদেরা মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। ফলে তালিকাভুক্ত যোদ্ধা ও শহীদের সংখ্যায় বিস্তর ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীর কোথাও শহীদ ও সম্মুখ যোদ্ধার মাঝে এতো ব্যবধান নেই। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণামতে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও আত্মত্যাগীর সংখ্যাটি বত্রিশ লাখ সঠিক হলে, প্রকৃত যোদ্ধা অবশ্যই বেশী হবার কথা। কারণ, কোনো যুদ্ধে বা সংঘর্ষে সকল যোদ্ধা শহীদ হয়না। বরং যোদ্ধাদের একাংশ বা কিয়দাংশ মাত্র শহীদ হয়। বেশীরভাগ হয় গাজী বা বন্দী। তেমনি ‘৭১ এ ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ আত্মত্যাগী নারীর বিপরীতে মাত্র দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা ও ৪১ জন বীরাঙ্গনা কখনো সঠিক নয়। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা অবশ্যই বেশি।
অতএব, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও আত্মত্যাগীর সংখ্যাটিকে সকল সন্দেহ, সংশয় ও বিতর্কের উর্দ্ধে রাখতে প্রচলিত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ও কোটানীতি অবশ্যই বাতিল করা উচিত। বঙ্গবন্ধুকে এবং তার ঘোষণামতে ‘৭১ এর সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালি সবাইকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করা উচিত। বর্তমান ষোল কোটি নাগরিক সবাইকে উক্ত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারভুক্ত করা উচিত। সুতরাং যতোদিন বাংলাদেশে দুই লাখ বিতর্কিত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ও কোটা থাকবে, ততোদিন শহীদের সংখ্যাটি বিতর্কিত থাকবে।