বাংলাদেশে অনেক সময় ভুল চিকিৎসা, ডাক্তারের অবহেলা এবং গাফিলতির নানারকম অভিযোগে হাসপাতাল ভাঙচুর, কর্তব্যরতদের মারধরের ঘটনা ঘটছে কিন্তু এক্ষেত্রে যথাযথ নালিশ জানানোর জন্য যে সংস্থা রয়েছে সেখানে অভিযোগ করছেন খুবই কম সংখ্যক মানুষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে বাংলাদেশে মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল বা বিএমডিসি নামের এ সংস্থার কাছে ২০১০ সালের পর সাত বছরে এ পর্যন্ত মাত্র ৪৩টি অভিযোগ এসেছে। আর স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত এ সংস্থা এখন পর্যন্ত মাত্র একজন চিকিৎসকের নিবন্ধন বাতিল করেছে আর একজনের নিবন্ধন সাময়িক বাতিল করেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডাক্তার দায়মুক্তি পেয়েছেন এবং কিছু ক্ষেত্রে তিরস্কার বা সতর্ক করা হয়েছে।
বিএমডিসিতে অভিযোগকারীর একজন নাহিয়ান মুস্তাফা। তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তির পর অপারেশনের করা হয়। অপারেশনের পরে তার সন্তানের মৃত্যু হয়। তার অভিযোগ হাসপাতাল ও সেখানকার গাইনী চিকিৎসকের অবহেলা ও চিকিৎসায় গাফিলতির কারণে তার সন্তানের মৃত্যু হয়। মুস্তাফা বলেন, “আমার স্ত্রীকে অপারেশন করার জন্য যে চিকিৎসককে আমরা দায়িত্ব দিয়েছি তিনি সেটি না করে আরেকজনকে দিয়ে অপারেশন করান। এটি বড় গাফিলতি। এবং আমাদেরকে সেটি জানানোও হয়নি। এছাড়া তারা দুইরকম তথ্য দিয়েছে। এসব নিয়েই অভিযোগ করেছি।”
বিএমডিসিতে অভিযোগের পর তাদের কার্যক্রম সন্তোষজনক কিনা এ প্রশ্নে মুস্তাফা বলেন, “তদন্ত কমিটি কাজ করছে। কিন্তু এটা অনেক ধীর গতির।”
মুস্তাফা একজন সচেতন ব্যক্তি হিসেবে বিএমডিসিতে অভিযোগ দায়ের করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশে অনেক মানুষই এরকম সচেতন নন। আর এ প্রতিষ্ঠানের সারাদেশে কার্যালয় মাত্র একটি এবং সেটি ঢাকায় অবস্থিত। ভুল চিকিৎসার অভিযোগ নিয়ে এখানে নালিশ করা যায় এটি অনেকেই জানেন না। আবার জেনেও অনেকে এখানে প্রতিকার পাবেন বলে মনে করেন না।
ঢাকার মামুন নামে একজনের দাবি তিনি ভুল চিকিৎসার শিকার হয়েছেন। রোগ নির্ণয়ে ভুল করে তাকে দুই দফায় প্রায় দেড় বছর যক্ষ্মার ওষুধ দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় হাই অ্যান্টিবায়োটিক এবং ৬০টি যক্ষ্মার ইনজেকশন নেয়ার পরও সুস্থ না হয়ে বিদেশ গিয়ে তিনি জানতে পারেন তার যক্ষ্মা রোগই হয়নি। উল্টো যক্ষ্মার ইনজেকশন আর ওষুধের কারণে শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
তিনি বলেন, “জানানর পর দুঃখে আমার কান্না চলে এসেছিল। আমি এক বছর সাড়ে চার মাস ধরে ওষুধ খেয়েছি সাথে ৬০টা ইনজেকশন। এসব ওষুধ এমনিতেই ক্ষতিকর। এরপরেও যে বেঁচে আছি সেটা আল্লার ইচ্ছা।”
বাংলাদেশে ফিরে মামুন এখানকার চিকিৎসকের কাছে জানতে চেয়েছিলেন এমন কেন হলো, “আমার রোগ হয়েছে সারকিওডোসিস। এখানে বলা হলো টিবি। আগের ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি বললেন, যে আমরাতো টিবির টেস্ট করে একবারেই টিবি পেয়ে গেছি তাই টিবির চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। আর ওই রোগের পরীক্ষা নাকি বাংলাদেশে নেই।”
বিএমডিসি সম্পর্কে জানার পরও মামুন অভিযোগ করেননি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ডাক্তারের শাস্তি হবে একটু ভর্ৎসনা বা নরমাল সতর্ক করে ছেড়ে দেবে। কিন্তু আমার যে আর্থিক, মানসিক, পারিবারিক ক্ষতি এর ক্ষতিপূরণ কে দেবে? আর একজন ডাক্তারের বিরুদ্ধে আরেকজন ডাক্তার তদন্ত করে কী শাস্তি দেবে? আমিতো কোনো আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাব না। এজন্য আমি যাইনি।”
বিএমডিসির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, “রোগী না মারা গেলেও এরকম যদি মনে করেন যে তিনি ভুল চিকিৎসার শিকার বা তার আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন তাহলে অভিযোগ দিতে পারেন। আমরা তদন্ত করে যদি মনে করি যে চিকিৎসকের ভুল ছিল বা তার আরো সতর্ক হওয়া দরকার ছিল তাহলে আমরা তাকে সতর্ক করতে পারি। তীরষ্কার করতে পারি। সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে তার নিবন্ধন স্থায়ীভাবে বাতিল করতে পারি। তবে ক্ষতিপূরণের জন্য ভুক্তভোগী চাইলে আদালতে যেতে পারেন।”
মানুষকে জানানোর জন্য বিএমডিসি সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছেন বলেও জানান সহিদুল্লা। আস্থাহীনতার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চিকিৎসকের ভুল একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই ধরতে পারেন। এটাই সারা বিশ্বে নিয়ম।
এদিকে বাংলাদেশে চিকিৎসা সেবায় আস্থা না পেয়ে সামর্থ্যবান প্রচুর মানুষ অসুখ হলেই ভারত থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরে চলে যাচ্ছে। ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন,
“রোগীর স্বার্থ সংরক্ষণের আইনী ব্যবস্থা এখানে অত্যন্ত দুর্বল। এখানেতো প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা নাই বললেই চলে। কোর্টে গেলে হয়তো প্রচলিত আইনে কিছু ব্যবস্থা হতে পারে। কিন্তু এটা খুবই দীর্ঘসূত্রীতা এবং প্রমাণ করা খুবই কঠিন। ওনাদেরকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনা হোক এটা কিন্তু ডাক্তাররা চান না।”
বাংলাদেশে চিকিৎসকের সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজারের মতো। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের হিসেবেই বাংলাদেশে অনুমোদনহীন প্রায় ৩ হাজার ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও দুই হাজারের মতো ক্লিনিক চালু রয়েছে। দেশে ভুল চিকিৎসা আর গাফিলতির অভিযোগে তুলে বিভিন্ন সময় হাসপাতালে ভাঙচুর, আক্রমণের খবর আসছে। বিএমএ মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন,
“কোয়ালিটির স্কাই ইজ দ্য লিমিট। সেখানে আমরা কাজ করছি। কিভাবে মেডিকেল শিক্ষাকে আরো আধুনিক করা যায়, যুগোপযোগী করা যায়, বাস্তবমুখী করা যায়, কিভাবে চিকিৎসকদের রোগীদের হ্যান্ডলিং আরো ভালো করা যায়, রোগীদের সাথে আরো দায়িত্বশীল আচরণ করেন সেসব নিয়ে আমরা কাজ করছি এবং এখানে আমাদের আরো অনেক কাজ করতে হবে এটা সত্য। কিন্তু আপনি যদি আমার চেয়ারে এসে আমাকে আঘাত করে যান আমার কিন্তু আর কিছুই থাকে না।”
এদিকে মৌলভীবাজার জেলা সদরে হেলথ এইড নামে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কতিপয় ডাক্তারের চেম্বারে প্রবেশের জন্য অপেক্ষমাণ মানুষদের ভিড় দেখে স্বভাবতই ধারণা করা যেতে পারে উনারা চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগী।
কিন্তু এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল, কারণ দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানো ভদ্র পোশাকধারী সম্মানিত ব্যক্তিগণ হচ্ছেন বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানির মার্কেটিং রিপ্রেজেন্টেটিভ।
শহরটির সদর হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তারদের ব্যক্তিগত চেম্বারের এই অপ্রত্যাশিত চেহারা দেখে অনেকে মন্তব্য করেন, এই যদি হয় ডাক্তারদের চেম্বারে প্রবেশ পথের দৃশ্য, তাহলে ডাক্তারের কাছে সেবা নিতে আসা রোগীদের অবস্থা কী হবে?
অনেকে বলেন, ডাক্তারদের সেই চিরাচরিত বদনাম মুছতে কারো ভূমিকা খুব বড় করে উল্লেখ করার মতো নয়।
তবে দেশটিতে গুটিকয়েক নিরহংকার, নির্লোভ ও পরোপকারী ডাক্তার আছে বলেই কিছু চিকিৎসা সেবা মিলছে, তা না হলে হয়তো কষাইদের হাত থেকে কেউই রক্ষা পেতো না।