মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া আমার জীবনের কোন আশাই অপূর্ণ রাখেননি আমার মা বাবা যখন যা চেয়েছি তাই পেয়েছি। কারন আমি মা বাবার একমাত্র ছেলে। আমার বড় পাঁচ বোন। আমাকে মাথায় রাখেনি উকুনে খাবে, মাটিতে রাখেনি পিঁপড়ায় খাবে।
অতি আদরে আমি বাদর হয়ে গেলাম। নিজেকে ছাড়া কিছুই বুঝতাম না। অন্যরা কি খেল বা পড়ল এসব আমি কখনোই চিন্তা করতাম না। আমি আমাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম।
ঈদ এলে নিজেই তৈরি করতাম আমার ঈদের বাজেট তালিকা। মা বাবা আপারা কি করবে না করবে সেসব আমার দেখার দরকার নেই। আমাদের এত বড় পরিবারের চাহিদা পুরণ করা আমার বাবার একার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু আমার দেয়া বাজেটের বিন্দু মাত্র নড়চড় হলে আমি তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে দিতাম।
এভাবেই চলছিল আমার জীবন। মা সবসময় আমার জন্য ভালো ভালো খাবার রেখে দিত নিজেরা না খেয়ে।আর আমি স্বার্থপরের মতো সব খেতাম। জানতেও চাইতাম না সবাই খেয়েছে কিনা।
বড় দুই বোনের বিয়ের সময় বাবাকে বেশ কিছু জমি বিক্রি করতে হয়েছে। আমি তখন কোনরকমে এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হই। ভর্তি হয়েই আমি রাজনীতিতে জড়িয়ে যাই। টাকার সাথে সাথে সিগারেট মদ গাজা কিছু বাকি রাখলাম না। আমার এই অধঃপতন দেখে বাবা খুব কষ্ট পেতেন। আমি থোড়াই কেয়ার করতাম।
একদিন প্রতিপক্ষের সামনে পড়লে তারা আমাকে আচ্ছা মতো মেরে রাস্তায় ফেলে চলে যায়। বাবা এ খবর শুনার সাথে সাথেই হার্ট অ্যাটাক করে। একদিক দিয়ে দুই বোনের বিয়েতে এত গুলো জমি বিক্রি করে দিতে হয়েছে, আর আমার অবস্থা দেখে বাবা আর সহ্য করতে পারেনি। দুই দিন পরেই বাবা না ফেরার দেশে চলে গেলেন।
আমি সুস্থ হয়ে বাড়ি গেলে মা আমাকে বিদেশ পাঠানোর জন্য উঠে পড়ে লাগে। ভিটে বিড়ি ছাড়া বাকি ধানের জমি গরু ছাগল যা ছিল সবই বিক্রি করে মা দালালের মাধ্যমে আমাকে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠাল আমার ভালোর জন্য। নিজেরা কিভাবে খাবে চলবে এ কথা একবারও ভাবলো না।
বিমান যখন আকাশে মূহুর্তে চোখের সামনে ভেসে উঠলো মমতাময়ী মায়ের করুন চেহারা। বোনদের তৃষ্ণার্ত মুখ। হু হু করে কেঁদে উঠলাম। চোখের পানিতে শার্ট ভিজে গেল। পেছনের কথা মনে করে আরোও কাঁদতে লাগলাম। কিন্তু সামনে আমার জন্য ছিল আরো খারাপ অবস্থা।
বিমান থেকে নামার পর ঐ দেশের দালাল আমাদের এক রুমে নিয়ে রাখল। কাজ দেওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের এখানেই থাকতে হবে। আহা খাবারের যে কি কষ্ট। বাড়িতে আমার খাবার একটু এদিক সেদিক হলেই সব খাবার ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি। ভয়ে কেউ একটা কথা বলেনি। আর আজ একবেলা শুকনা খাবার খাই চোখের পানিতে ভিজিয়ে।
এক মাস এভাবে থাকার পর যে কাজের কথা বলে এনেছে তা না দিয়ে একেবারে কম বেতনের শ্রমিকের কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছে। অথচ বেশী বেতনের কথা বলে দালাল অনেক টাকা নিয়েছে।বিদেশ বলে কথা কার কাছে যাবো কাকে বলবো বুঝতে না পেরে এখানেই ঢুকে গেলাম। মা বোনেরা কিভাবে আছে তাও জানিনা।
এক রুমে আমরা গাদাগাদি করে অনেকে থাকি। বাড়িতে আমার বিছানা জামা কাপড় সব আমার বোনেরা গুছায় পরিপাটি করে রাখত।সেই সব দিনের কথা মনে করে লজ্জায় কুণ্ঠিত হয়ে যাই। মনে মনে মা বাবা বোনদের কাছে মাফ চাই। সারাক্ষণ আল্লাহকে ডাকি। এখান কত অবহেলায় কাটে আমার জীবন তা যদি আমার মা জানত তাহলে কষ্টে তার বুক ভেঙে যেত।
দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, ঈদ যায়। এভাবে ছয় ঈদ কাটায় দিলাম। মোবাইল কিনে মার জন্য পাঠালাম। মা বারে বারে বলে বাড়ি যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি পাপি। মা বোনদের জন্য এখন পর্যন্ত তেমন কিছু করতে পারিনি। মাকে বললাম বোনদের বিয়ে দিয়ে তারপর আসবো।
সেজ আপার রোজার ঈদের পরে বিয়ে ঠিক হয়েছে। মা বলেছে অনেক টাকা লাগবে। দিনরাত কাজ করে টাকা জমাচ্ছি। হঠাৎ করে করোনা ভাইরাসে সব উলট পালট হয়ে গেল। কাজ বন্ধ। বেতন বন্ধ। কিভাবে টাকা রেডি করবো মাথা খারাপ অবস্থা।
মন শান্ত করার জন্য প্রতিদিন কথা বললেও যেন তৃপ্তি মেটে না। কিছুদিন ধরে মায়ের একটাই কথা বাবা দুনিয়ার মধ্যে নাকি কি অসুখ আসছে মানুষ সমানে মারা যাচ্ছে, তুই দেশে চলে আয়।
মাকে বলতে পারি না ইচ্ছা থাকলেও যেতে পারবো না মা। যা বিক্রি করে বিদেশ এসেছি তার কিছুই তো এখন পর্যন্ত করতে পারলাম না। জানি না কতদিন এভাবে থাকতে হবে।
ঈদের দিন সকালে মা ফোন দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে জানতে চাইছেন সেমাই খেয়েছি কিনা। চোখের পানি মুছে বললাম খেয়েছি মা তুমিও খাও।
লেখক,
আফরোজা মুন্নি
ঢাকা, বাংলাদেশ