সুন্দরবনের অতন্দ্র প্রহরী বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার আজ হুমকির মুখে। বনদস্যু, বনজীবী ও চোরা শিকারিদের অপতৎপরতাসহ নানা কারণে বাঘের অবাধ বিচরণক্ষেত্র থেকে এই বাঘ আজ বিপন্ন হতে চলেছে। গত ১৬ বছরে বনজীবী, চোরা শিকারি ও বনদস্যুদের হাতে ৫২টি বাঘ মারা পড়েছে। এর মধ্যে বাগেরহাট অংশে ১৯টি ও খুলনা ও সাতক্ষীরা অংশে ৩৩টি। চোরা শিকারি আর বনদস্যুরা অধিক মুনাফার আশায় বাঘের অঙ্গপ্রতঙ্গ, চামড়া, হাড় পাচার করছে। ফলে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা দিন দিন কমছে। বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবন বাংলাদেশের অংশে রয়েছে ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা। ৪৫০টি নদ-নদী ও খাল এই সুন্দরবনকে জালের মতো ঘিরে রেখেছে। এখানে এক সময়ে ৫০০ থেকে সাড়ে ৪০০ রয়েল বেঙ্গল টাইগার দাপিয়ে বেড়াতো। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পরিবেশের বিরূপতা, চোরা শিকারিদের হামলা ও লোকালয়ে ঢুকে পড়ায় জনরোষের শিকার হয়ে দিনদিন কমতে শুরু করেছে সুন্দরবনের রক্ষা কবজ রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
সম্প্রতি সুন্দরবনের বাঘ গণনা জরিপ-২০১৫ এর ফলাফলে দেখা গেছে, সুন্দরবন বাংলাদেশের অংশে রয়েছে ১০৬টি বাঘ আর ভারত-বাংলাদেশ সুন্দরবনের উভয় অংশে বাঘের সংখ্যা মাত্র ১৭০টি। সেমতে ১০ বছরে ২৭০টি কম। সুন্দরবনের এ সম্পদ রক্ষা করতে হলে এখই সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে বলে মনে করেন সুন্দরবন বিশেজ্ঞরা।
বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী ২০০১ সালের ২০শে নভেম্বর শরণখোলা রেঞ্জের কচিখালী এলাকা থেকে ১টি স্ত্রী বাঘ ও একই বছরের ১২ই ডিসেম্বর চাদপাই সদর রেঞ্জ এলাকায় ১টি পুরুষ বাঘ ও ২০০৫ সালের ২৬শে অক্টোবর একই রেঞ্জের বলেশ্বর নদীর পাড়সংলগ্ন বন থেকে বাধর্ক্যের কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছিল। ২০০২ সালের ৯ই সেপ্টম্বর চাঁদপাই রেঞ্জের জোংড়া টহল ফাঁড়ি এলাকায় ১টি পুরুষ বাঘকে দুষ্কৃৃতকারীরা গুলি করে হত্যা করে, ২০০৩ সালের ২৮শে মে চাঁদপাই রেঞ্জের নলবুনিয়া গ্রামে, ১৯শে অক্টোবর শরণখোলা রেঞ্জের চালিতাবুনিয়া গ্রামে ২১শে ডিসেম্বর চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়া গ্রামে ও ২০০৯ সালে ২রা জুলাই শরণখোলা রেঞ্জের রাজাপুর গ্রামে লোকালয়ে ঢুকে পড়লে গণপিটুনিতে মারা যায় ৪টি বাঘ। এছাড়া ২০০৮ সালের ২৫শে আগস্ট শরণখোলা রেঞ্জের কাঁঠালতলার বেলায়েত হোসেনের বাড়ি থেকে ১টি বাঘের চামড়া উদ্ধার করা হয়। ২০০৬ সালের ২রা নভেম্বর শরণখোলা এলাকার নুরুজ্জামানের বাড়ি থেকে ১টি বাঘের চামড়া উদ্ধার করা হয়, ২০০৭ সালের ২রা মে চাঁদপাই রেঞ্জের হাড়বাড়ীয়া টহল ফাঁড়ির পুকুর পাড় থেকে ১টি মৃত বাঘ উদ্ধার করা হয় ও ১৬ই নভেম্বর চাঁদপাই রেঞ্জের ঢাংমারী স্টেশনের ঘাঘরামারী ক্যাম্প এলাকা থেকে সিডরের আঘাতে মারা যাওয়া ১টি মৃত বাঘ উদ্ধার করা হয়।
এবিষয়ে সেভ দ্যা সুন্দরবনের সভাপতি ড. ফরিদুল ইসলাম বলেন, বনদস্যুরা পেশা পরিবর্তন করে বাঘ শিকার ও পাচারের সাথে জড়িয়ে পড়ায় সুন্দরবনে দিন দিন বাঘের সংখ্যা কমছে। সুন্দরবন গবেষক ও সরকারি পিসি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক শাহ আলম ফরাজি বলেন, সুন্দরবনে চোরা শিকারিদের যে সিন্ডিকেট রয়েছে তাদের অনেকে বাঘের চামড়া ও হাড়গোড় বিভিন্ন সময় র্যাব, পুলিশ ও কোস্টগার্ডের হাতে আটক হলেও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয়ে পুনরায় তারা একই পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে। কঠোর আইনের মাধ্যমে এখনই যদি এ শিকারিদের ঠেকানো না যায় তবে অচিরেই সুন্দরবন থেকে বাঘ হারিয়ে যাবে। বাগেরহাট পুলিশ সুপার মো. নিজামুল হক মোল্যা বলেন, সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট যে কোন অপরাধ দমনের জন্য তালিকা তৈরিসহ অপরাধীদের শনাক্ত ও আটকের জন্য পুলিশ প্রশাসনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনের বাঘ ও সম্পদ রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি বনবিভাগও এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। এমনকি শিকারিরা যাতে দ্রুত পালিয়ে না যেতে পারে সে জন্য এক হুইলার বোর্ড চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সুন্দরবনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তিরি আরও বলেন, ২৪ ঘণ্টা সুন্দরবনের নিরাপত্তার জন্য চলতি অর্থ বছরের আগস্ট মাসে জেলেদের ৩০টি ও বনবিভাগের ৫টি নৌকায় ট্রেকিং ডিভাইস বসানো হবে। যা দ্বারা সরাসরি ২৪ ঘণ্টা ফুটেজের মাধ্যমে ডিএফও কার্যালয় থেকে সুন্দরবনের জেলে, বাওয়ালী, বনজীবী ও বনের বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তার জন্য হুমকি বিভিন্ন বিষয়ে মনিটরিং করা হবে। আর এর ফলে বন্যপ্রাণীসহ বনদস্যুদের হাত থেকে বনের জেলে, বাওয়ালী ও মৌয়ালদের রক্ষায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। এছাড়াও কেউ যদি বন্যপ্রাণী দ্বারা আক্রান্ত হয় ও প্রকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয় এই ট্রেকিং ডিভাইস ও মোবাইল নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।