ডেস্ক নিউজ : রোহিঙ্গাদের মধ্যে বাল্যবিয়ের চল থাকলেও কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে তা বেড়ে গেছে ব্যাপকভাবে। এখানে অন্তত ৯০ শতাংশ বিয়ে হচ্ছে শুধু অভাবের তাড়নায় অর্থাৎ দু’বেলা দু’ মুঠো খেতে পারার আশায় – এমনটাই মনে করছেন কমিউনিটি লিডাররা।
এই যেমন ধরুন রোহিঙ্গা কিশোরী নুর কায়দার কথা। তার বয়স এখন মাত্র ১৩ বছর। বাবা-মাকে চোখের সামনেই জবাই হতে দেখেছে সে। রাখাইনের মগরা (উগ্রপন্থি বৌদ্ধ) হত্যা করেছে তাদের। সেই দৃশ্য দেখার পর কিছু দিন পালিয়ে বেড়িয়েছে নুর কায়দা। একপর্যায়ে দাদির সঙ্গে বাংলাদেশে চলে আসতে সক্ষম হয় সে।
মা-বাবাহারা কিশোরী নুর কায়দাকে দেখাশোনার কেউ ছিল না। দাদির পক্ষেও তার ভার বহন সম্ভব নয়। তাই কয়েক মাস আগে তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়েছে। ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে এই কিশোরী অকপটেই স্বীকার করে, ‘‘দাদির পক্ষে আমাকে খাওয়ানো সম্ভব ছিল না। এজন্য বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন।”
‘লেখাপড়ার সুযোগ পেলে বিয়ে করতাম না’
শ্বশুড়বাড়িতে ভালো আছেন মনে করছেন নুর কায়দা,অন্তত খাওয়ার চিন্তা নেই। তবে জীবনটা যে একটু অন্যরকম হতে পারতো – সেটাও ভাবে সে। বললো, সুযোগ থাকলে লেখাপড়া করতাম, কিন্তু ভাগ্যে নেই।
নুর কায়দার মতো তসলিমা আর মোমিরারও বিয়ে হয়ে গেছে কিছুদিন আগে। তারা নিজেদের বয়স ১৬ বলে দাবি করেছে। তবে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে থাকা এক স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, তাদের বয়স আরো অন্তত দুই বছর করে কম হবে।
তসলিমা ও মোমিরার বিয়ের কারণও একই – তাদের একজনের বাবা খুন হয়েছেন মগের হাতে, অন্যজন সামরিক বাহিনীর হাতে। ফলে তাদেরও দেখার কেউ নেই। অতএব আর কী, বাল্যবিয়ে! মোমিরার কথায়, ‘‘বাপ নেই, মা খাওয়াতে পারে না, তাই বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।”
তসলিমা মেয়েটি বেশ লাজুক, গুছিয়ে কথা বলতে পারে না, শুধু তাকিয়ে থাকে অপলক নয়নে। নিজের অনাগত সন্তানের ভবিষ্যত কী, তাও সে জানে না। শুধু জানে, বিয়ে করায় খাবারের সংকট ঘুচেছে। শরণার্থী শিবিরে পরিবার হিসেব করে ত্রাণ দেয়া হয়। তাই নিজের সংসার হওয়ায় ত্রাণসামগ্রী এখন বেশি পাওয়া যাচ্ছে।
কেন এত বাল্যবিয়ে?
এ অবস্থায় বাল্যবিয়েকে নানাভাবে আলোচনায় নিয়ে আসতে চাচ্ছে কয়েকটি সংগঠন। এদের মধ্যে ‘‘গার্লস নট ব্রাইডস” নামের লন্ডনভিত্তিক সংগঠনটি মনে করছে, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বাল্যবিয়ে বন্ধে উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। সংগঠনটির উপ নির্বাহী পরিচালক হেথার হ্যামিল্টন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মানবিক বিপর্যয়ের সময় বাল্যবিবাহের হার উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যায়। মেয়েদের জন্য খাদ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অনেক পরিবার তাদের বিয়ে দেয়ার পথ বেছে নেয়। কিন্তু তাতে তাদের শারীরিক ও মানসিক অনেক ক্ষতি হয় আর বাল্যকাল ও ভবিষ্যত ধ্বংস হয়ে যায়।”
কক্সবাজারের কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা জনপ্রতিনিধি, যারা মাঝি নামে পরিচিত, নুরুল ইসলামও বাল্যবিয়ের পেছনে খাদ্যসংকটের কথা জানালেন। তিনি বলেন, ‘‘মগদের জ্বালায় ওরা মিয়ানমার থেকে চলে এসেছে। এখানে এসে অভাবে পড়েছে। এজন্য মায়েরা তাদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।”
তিনি বলেন, ‘‘সরকার যদি আমাদের যেভাবে রেশন দেবে বলেছিল, ১৫ দিন পরপর, সেখাবে দিলে বাল্যবিবাহ ঠেকানো যাবে, নাহলে ঠেকানো যাবে না।”
তাঁর দাবি, ”রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১০ শতাংশ বিয়ে হয় স্বাভাবিকভাবে, আর বাকি ৯০ শতাংশ হয় অভাবের কারণে।”
স্বাস্থ্যঝুঁকিতে কিশোরী মায়েরা
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে দেশি ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা। এদের মধ্যে ব্র্যাক, সেইভ দ্য চিলড্রেন, ডক্টর্স উইদাউট বর্ডার্স, ইউনিসেফ এবং আইওএম উল্লেখযোগ্য।এসব প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে প্রসূতি মা এবং শিশুদের জন্য চিকিৎসার বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে।
কুতুপালং ক্যাম্পে দু’বছর ধরে কাজ করছেন ড. রোমানা ইসলাম৷। তিনি অভিবাসী বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন আইওএম-এর স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘‘বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েরা প্রথমত অপুষ্টিতে ভোগে। যেহেতু তারা নিজেরাই ছোট ও অপ্রাপ্তবয়স্ক, তাদের বাচ্চাগুলোও ছোট ও অপরিণত হয়। অনেক সময় তাদের ডেলিভারির সময় অনেক বেশি রক্তক্ষরণ হয়।”
তিনি বলেন, ‘‘তারা নিজেরা নিজেদের যত্ন তো নিতেই পারে না, সন্তানের যে পরিমাণ যত্ন নেয়া দরকার, সেটাও নিতে পারে না।”
উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বাল্যবিবাহ কমাতে হলে জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি মেয়েদের জন্য শিক্ষা এবং পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনুযায়ী ত্রাণের বন্টন বাড়ালে তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। সূত্র : ডয়চে ভেলে