জগলুল হুদা, রাঙ্গুনিয়া: চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় আজও উপেক্ষিত শহীদ আহমদ শাহ ও শহীদ মোহাম্মদ শাহ’র পরিবার। নিজ গ্রাম ও দেশকে পশ্চিমা হানাদারমুক্ত করতে ১৫ এপ্রিল ১৯৭১ সনে হানাদারদের বুলেটে শহীদ হয়েছেন দুই সহোদর। তাঁরাই চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার প্রথম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে পশ্চিমা হানাদারেরা রাঙ্গুনিয়া কলেজ দখল করে তাদের আস্তানা বানিয়ে ফেলে। পাক দোসর রাজাকার আলবদরদের সহায়তায় বাঙালী নিধনে মেতে উঠে পাকবাহিনী। রাঙ্গুনিয়ার মরিয়মনগর ইউনিয়ন সহ বিভিন্ন গ্রামে যখন হানাদাররা হিংস্র পাশাবিক অত্যাচার চালাতে লাগল তখন রাঙ্গুনিয়া কলেজের ৩য় বর্ষের ছাত্র এবং ছাত্র সংসদের ভিপি আহমদ শাহ ও তাঁর সহোদর তৎকালীন বিআইটি বর্তমানে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)-এর প্রকৌশল বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র এবং ছাত্র সংসদের জিএস মোহাম্মদ শাহ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁরা মরিয়মনগর এলাকার মরহুম আলহাজ্ব ছৈয়দ আহমদ সওদাগর ও মরহুমা ছুরুত বাহার বেগমের ১৪ সন্তানের মধ্যে ৪র্থ ও ৫ম সন্তান ছিলেন। অত্যন্ত মেধাবী এ দুই ভাই লেখাপড়ার পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। আহমদ শাহ জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৪৯ সালের ১৫ আগষ্ট। আর মোহাম্মদ শাহ’র জন্ম ২ সেপ্টেম্বর ১৯৫১ সালে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষনের পর যখন দেশব্যাপী স্বাধীনতার উত্তাল জোয়ার বইছে তখন তারা কলেজের ছাত্র-ছাত্রী ও এলাকার শিক্ষিত যুবকদের নিয়ে এক গোপন গেরিলা বাহিনী তৈরী করেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী রাঙ্গুনিযায় একে একে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নি সংযোগ করে রাঙ্গুনিয়াকে ধ্বংস স্তুপে পরিণত করতে লাগল। এক পর্যায়ে স্বদেশী ছদ্মবেশী রাজাকার আলবদর বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন আস্তানার সংবাদ হানাদারদের কাছে চিহ্নিত করে দিচ্ছিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে আহমদ শাহ ও মোহাম্মদ শাহ’র গোপন আস্তানার খবরও তাদের কাছে পৌঁছে যায়। তাঁদের আস্তানার খবর পেয়ে পাকিস্তানী বাহিনী ১৪ এপ্রিল সদলবলে আস্তানায় হানা দেয়। এ সময় দুই ভাইকে আস্তানায় না পেয়ে চরম আক্রোশে পাকবাহিনী তখন তাঁদের বাড়ি ঘেরাও করে পরিবারের সকল সদস্যকে রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে। টেনে হিঁছড়ে সবাইকে কলেজ ময়দানে নিয়ে আসে। এ খবর এক অনুচরের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী ইছামতি গ্রামের ডা. কমলেন্দু বড়–য়ার বাড়িতে পৌঁছে যায়। যেখানে দুই ভাই অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে পাকিস্তানী হানাদারদের মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হানাদাররা পরিবারের সদস্যদের কলেজ মাঠে নিয়ে যাওয়ার সংবাদ শুনে দুই ভাই পাগলের মতো কলেজ মাঠের দিকে দৌঁড়াতে থাকে। পথে শুভাকাঙ্খীরা তাঁদের ভয়াবহ পরিণতির কথা ভেবে বাঁধা দিতে চেষ্টা করেও বিফল হয়। অসহায় পিতা-মাতা, ভাই-বোনকে বাঁচাতে তাঁদের জীবনকে তুচ্ছ করে কলেজ মাঠে ছুটে আসেন। সেখানে পৌঁছামাত্রই আধুনিক মরণাস্ত্রের মুখে নিরস্ত্র দুই ভাই পাকিস্তানীদের হাতে বন্দি হয়। কাঙ্খিত দুই সহোদরকে পেয়ে হানাদাররা পরিবারের অন্য সদস্যদের ছেড়ে দেয়। এ খবর আলবদর বাহিনী সারা গ্রামে মহা উল্লাসে প্রচার করতে থাকে। পরদিন ১৫ এপ্রিল সকাল ৭টায় দুই ভাইকে রাঙ্গুনিয়া কলেজের দক্ষিণে মাজারের মাঝে দিঘির পাড়ে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। বুলেটের আঘাতে দু’জনেরই মাথার খুলি উড়ে যায়। শহীদদ্বয়ের দুটি দেহ এখানেই মাটি চাপা দেয় পাক বাহিনী। স্বাধীনতার ৪ দশক কেটে গেলেও রাঙ্গুনিয়ার প্রথম শহীদ দুই সহোদরের স্মৃতি রক্ষার্থে এ পর্যন্ত সরকারিভাবে কোন উদ্যোগই গ্রহণ করা হয় নি। দুই শহীদের পরিবারের প্রত্যাশা অন্তত তাঁদের নামে রাঙ্গুনিয়ায় একটি সড়কের নামাকরণ করা হবে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম মজুমদার জানান, বর্তমান সরকার সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি রক্ষার্থে শহীদদের গণকবরে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ সহ নানান উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।