জগলুল হুদা, রাঙ্গুনিয়া : বিলুপ্তির পথে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার মরিয়মনগর ইউনিয়নের খ্যাতনামা সামাজিক লাইব্রেরী জীবন সাথী পাঠাগার। একসময় পাঠকদের পদচারণায় মুখর ছিল পাঠাগারের পথ-প্রান্তর। দিন-রাত নিরন্তর পাঠাগারের পাঠকমহলের আড্ডায় জমজমাট থাকতো লাইব্রেরীটি। চলত বিভিন্ন উৎস থেকে নানাধরনের বই সংগ্রহের মহাযজ্ঞ। মিলনমেলায় পরিণত হতো সুশিল সমাজের। সবার মাঝে সামাজিক কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার মানসিকতার সৃষ্টি হতো। ফলে পাঠাগারের মাধ্যমে নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, পুকুরে মাছ চাষ, সরকারী খাস জমি ও পতিত জমিতে কৃষিকাজ, এলাকার যুবকদের সংগঠিত করে রাস্তাঘাট মেরামত, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অসহায় গরীব মেধাবী শিক্ষার্থীদের তহবিল গঠন করে অভিভাবকের ন্যায় দায়িত্বে নেওয়াসহ বহু সমাজউন্নয়ন মূলক কাজে অংশ নিতো জীবন সাথী পাঠাগারের মাধ্যমে লাইব্রেরীর পাঠকরা। এর ফলে বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিল পাঠাগারটি।
জানা যায়, ১৯৭৬ সালে মরিয়মনগরের ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন সি-গোডাউনের একটি নৈশ বিদ্যালয়ের মাধ্যমে এলাকার যুবকদের জন্য গণ শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এই কেন্দ্রটি গঠন করা হয়। বেকার যুবকদের সঙ্গে নিয়ে নজরের টিলার আলতাফ সওদাগর ও সমাজ সেবক মো. আজিম এর সহায়তায় পুকুরে মাছের চাষ, মিনি পুকুর খনন, সরকারী খাস জমি ও পতিত জায়গায় কৃষিকাজ, বেকার যুবকদের সংগঠিত করে রাস্তাঘাট মেরামত ইত্যাদিতে উৎসাহিত করা হয়। এছাড়াও জীবন সাথী পাঠাগারের আশে পাশে ফুলের বাগান ও মাঠি ভরাটের মাধ্যমে গনপাঠাগারের পরিবেশ মনোরম করা হয়। প্রতিদিন রাত ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত যুবকদেরকে পড়ালেখা শেখানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করেন জীবন সাথি পাঠাগারের শিক্ষকরা। পুরোদ্দমে চলতে থাকে জীবন সাথি পাঠাগারের স্বাক্ষরতা প্রদান কার্যক্রম।
প্রথমে প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে চট্টগ্রাম নগরীর নিউ মার্কেটের উজ্জ্বল বুক সেন্টার থেকে রাঙ্গুনিয়া কলেজের শিক্ষিকা অধ্যাপিকা সামশুন্নাহার আজাদ জীবন সাথী পাঠাগারের জন্য ১৯টি বই দান করেন। এছাড়াও একই সময়ে এলাকার শিল্পপতি ইলিয়াছ হায়দার ১০টি বই দান করেন। তাছাড়াও লোকমানুল হক চেয়ারম্যান ২৫টি। এভাবে বিভিন্ন বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগীর দানে পাঠাগারের বইয়ের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। সব মিলিয়ে ধীরে ধীরে বইয়ের সংখ্যা দাড়ায় ৩৭৯২টি। এছাড়াও শাকসবজি কার্যক্রমের জন্য ‘অছি কোদের’ খামার এবং মাছ চাষে ৪টি বড় পুকুর নেওয়া হলো। এভাবে পাঠাগারের কার্যক্রম বৃদ্ধির সাথে বিভিন্ন মহলের পাঠাগারের প্রতি আগ্রহও বাড়ে। এবার পড়ালেখার পাশাপশি ভিন্ন কার্যক্রমেও হাত দেয় পাঠাগার। জীবন সাথী পাঠাগারের পক্ষ থেকে ২৭৯ জন গরীব মেধাবী শিক্ষার্থীকে শিক্ষা কার্যক্রমে সাহায্য করে আসছে। এছাড়াও এলাকার ৭ জন গরীব মেয়েকে মরহুম মৌলানা বসির উল্লাহ’র সাহায্যে উপযুক্ত পাত্রের হাতে পাত্রস্ত করা হয়।
১ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর গনপাঠাগারের কার্যক্রমের পরিধি বৃদ্ধি করা হলো। এবার মেধাবি গরিব শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ব্যয়ভার গ্রহনের দায়িত্ব নেওয়া শুরু করলো জীবন সাথি পাঠাগার। প্রথম ধাপে শিক্ষার্থীদের পূর্ব সৈয়দবাড়ির জেলে পাড়ার বিজয় দাশ, আনন্দ দাশ ও শংকর দাশের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেয় জীবন সাথি পাঠাগার। পরের ধাপে নজরের টিলার প্রয়াত বিমল বড়–য়ার নেতৃত্বে ১০ জন বড়–য়া সম্প্রদায়ের শিশুদের নিয়ে জীবন সাথী পাঠাগারের উপর শিক্ষাদানের দায়িত্ব অর্পন করা হয়। এই ১০ জনের মধ্যে ৯জনই জীবন সাথী পাঠাগারের সহায়তায় পরবর্তীতে শিশু শ্রেণি থেকে এস.এস.সি পর্যন্ত শিক্ষাকার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যায়। তাদের কলেজে ভর্তি করার দয়িত্বও নেয় জীবন সাথি পাঠাগার কর্তৃপক্ষ। এভাবে পর্যায়ক্রমে ৩৭ জন শিক্ষার্থীকেও একই কায়দায় শিশু বিভাগ থেকে এস.এস.সি পর্যন্ত শেষ করে। এই ৩৭ জনের মধ্যে ৩৫ জন শিক্ষার্থী ২য় বিভাগে, ২ জন তৃতীয় বিভাগে পাশ করে। এভাবে ২২৬ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২১১ জন শিক্ষার্থী জীবন সাথী পাঠাগারের সহায়তায় শিক্ষাজীবন সম্পূর্ণ করে পরবর্তীতে বিভিন্ন পেশায় যোগদান করে।
১৯৯১ সালের ঘুর্নিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যে এগিয়ে আসে পাঠাগারের কর্মিরা। তখন ভোলা – হাতিয়া সহ বিভিন্ন দুর্গত এলাকায় পাঠাগারের পক্ষ থেকে ত্রান সামগ্রী নিয়ে তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়। তখন ইলিয়াছ হায়দার সহ বেশ কয়েকজন সমাজ সেবীরা কাপড় ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ দিয়ে তাদের বন্যার্তদের সাহার্য্য করা হয়। এভাবেই পাঠ কার্যক্রমের পাশাপাশি সমাজ ও দেশের বিভিন্ন ঝুঁকিতে এগিয়ে এসে সকলের কাছে আস্থা ও ভরসার একটি কেন্দ্রে পরিণত হলো জীবন সাথী পাঠাগার।
জীবন সাথী পাঠাগারের বিভিন্ন কার্যক্রমে যারা সহায়তা করেছিলেন তাদের মধ্যে রাঙ্গুনিয়া কলেজের সাবেক অধ্যাপক সামশুন্নাহার, চট্টগ্রাম কলেজের ইংরেজী বিভাগের ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ অন্যতম। পৃষ্টপোষকতা করেছেন বর্তমান আবুধাবি বঙ্গবন্ধু পরিষদ সভাপতি ইফতেখার হোসেন বাবুল। এছাড়াও জীবন সাথী পাঠাগারের কলেরা-ডায়রিয়া প্রতিরোধ বিষয়ক গণসচেতনতা কার্যক্রম হাতে নেয়। এই কার্যক্রমে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন শিল্পপতি ইলিয়াছ হায়দার। যিনি প্রতি মাসেই এই পাঠাগারের জন্য তার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে অর্থ বরাদ্দ রাখতেন। একসময় প্রায় নিয়মিতভাবে দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে পাঠাগারের বিভিন্ন কার্যক্রম। জীবন সাথী পাঠাগারের কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাজে গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখার জন্য জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত হয় পাঠাগার কতৃপক্ষ। বর্তমানের আধুনিক সমাজে জীবন সাথী পাঠাগার তার গৌরব হাড়াতে বসেছে। পাঠাগারে রক্ষিত সব বই এখন আর সবার পড়–নিতে মুখরিত হয় না। ক্রমে পোকামাকড়ের খাদ্যে পরিণত হচ্ছে বই সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম। সাথে কালের অতল গহবরে হাড়িয়ে যাচ্ছে একসময়ে চাঙ্গা জীবন সাথী পাঠাগার।
স্থানীয়দের দাবী অচিরেই এই জীবন সাথি পাঠাগারটি রক্ষানাবেক্ষন করে আবারও প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনা হোক।