জাকির সিকদার ঃ “বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই, কুঁড়েঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই। আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে, তুমি কত কষ্ট পাও রোদ বৃষ্টি ঝড়ে।” কবি রজনীকান্ত সেনের কালজয়ী ‘স্বাধীনতার সুখ’ ছড়াটি ইংরেজী মাধ্যমে পড়ুয়া শিশুদের কাছে অপরিচিত লাগলেও বাংলা মাধ্যমের ৩য় শ্রেণির বাংলা বইয়ের পাঠ্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত গ্রাম বাংলার এই নিপুণ বাসা তৈরির কারিগর বাবুই পাখি আজ সুখে নেই কুড়েঁঘরে।কালের আবর্তে আজ বাবুই পাখির বাসা বিলুপ্তির পথে।
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম-অঞ্চলে আগের মত এখন আর চোখে পড়েনা বাবু পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা। বাবুই পাখিটি দেখতে ছোট হলেও বুদ্ধিতে সব পাখিকে হার মানায়। আগে রাঙ্গুনিয়ার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে দেখা যেত দৃষ্টিনন্দন বাবুই পাখির বাসা। কিন্তু কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে আবহামান বাংলার সেই ঐতিহ্যবাহী নিপুন বাসা তৈরির কারিগর বাবুই পাখি ও তার বাসা। বাবুই পাখি সু-নিপূণ ভাবে খড়ের ফালি, ধানের পাতা, তালের কচিপাতা, ঝাউ কাঁশবনের লতাপাতা দিয়ে উুঁচু তালগাছ নারীকেল গাছে চমৎকার আকৃতির বাসা তৈরি করতো। বাবুই পাখির বাসা যেমন দৃষ্টিনন্দন তেমনি মজবুত। মাঝে-মধ্যে খেজুর কিংবা অন্যান্য গাছের শাখাতেও দৃষ্টিনন্দন বাসা বাঁধতো। আর প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও প্রবল বৃষ্টি ও বাতাসের প্রবল বেগের সাথে মোকাবেলা করে টিকে থাকতো। মুক্ত বোননের বাবুই পাখির বাসাটি টেনেও ছেড়া খুব কঠিন। বাবুই এক ধারে শিল্পী, স্থবতি এবং সামাজিক বন্ধনের প্রতিচ্ছবি। এরা এক বাসা থেকে আরেক বাসায় যায়, পছন্দের সঙ্গীয় খোঁজতে। সঙ্গী পছন্দ হলে স্ত্রী বাবুইকে সঙ্গী বানানোর জন্য খাল-বিল ও ডোবাই গোসল করে ফুর্তিতে নেচে বেড়ায় গাছের ডালে ডালে। পরে এরা উঁচু তালগাছ, নারীকেল গাছ বা সুপারি গাছের ঢালে বাসা তৈরির কাজ শুরু করে। স্ত্রী বাবুই পাখির প্রেরণা পেয়ে পুরুষ বাবুই খুবই শিল্প সম্মত ভাবে নিপুন বাসা তৈরি করে।
প্রসঙ্গত পুরুষ বাবুই পাখি কেবল বাসা তৈরি করে। স্ত্রী বাবুই ডিম দেওয়ার সঙ্গে পুরুষ বাবুই খোঁজতে থাকে আরেক সঙ্গীকে। পুরুষ বাবুই এক মৌসুমে ৬টি পর্যন্ত বাসা তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ এরা ঘর-সংসার করতে পারে ৬ সঙ্গীর সঙ্গে, তাতেই স্ত্রী বাবুই’র বাধা নেই। প্রজনন প্রক্রিয়ায় স্ত্রী বাবুই ডিমের তাপ দেওয়ার দু’সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চা দেয়। এবং ৩ সপ্তাহ পর বাবুই বাচ্ছা ছেড়ে উড়ে যায়। স্ত্রী বাবুই দুধ, ধান সংগ্রহ করে এনে বাচ্ছাদের খাওয়ায়। হারিয়ে যাওয়া বাবুই পাখি গত কয়েক বছর আগেও রাঙ্গুনিয়ার কোদলা ইউনিয়ন, সরফভাটা, শিলক, নিশ্চিন্তাপুর, ইসলামপুর, দ:রাজানগর ইউনিয়নের সর্বত্র এলাকায় দেখা যেতো।
তবে মানব সমাজের এক শ্রেণীর লোভী মানুষ বাবুই পাখির আশ্রয়স্থল তালগাছ, নারিকেল গাছ, খেজুর গাছ কেটে সামন্য টাকার লোভে ইটভাটায় বিক্রি করে দিচ্ছেন।এতেই আশ্রয়স্থল হারিয়ে বাংলার এই নিপুণ বাসা তৈরির কারিগর বাবুই পাখিরা আজ সুখে নেই কুড়েঁঘরে।বৃক্ষ নিধনের ফলে আজ রাঙ্গুনিয়া উপজেলা থেকে বাবুই পাখির বাসা বিলুপ্তির পথে। আর এক শ্রেণী পাখি শিকারীরা বসে থাকে বাবুই খাবারের জন্য রাতের বেলায় যখন ঝাঁক বেধে সমতলে নামে, তখন শিকারীনা জাল পেতে রাখে বিভিন্ন কায়দায় এবং পাতানো জালে আটকা পড়ে শত শত বাবুই। প্রতিটি পাখি থেকে একশ – দেড়শ গ্রাম মাংস পাওয়া যায়। সামান্য লোভের জন্য এভাবেই বাবুই পাখি নিধন চলছে অহরহ। বাবুই শিকার অব্যাহত থাকলে এ উপজেলা থেকে একদিন কবি রজনীকান্ত সেনের কালজয়ী ‘স্বাধীনতার সুখের উপমায়ী বাবুই পাখির বিলুপ্তি ঘটবে বলে মনে করেন প্রাণী বিশেজ্ঞরা।