Menu |||

স্বপ্ন দেখার তাবিজ-কবজ

ভরা বাস। প্যাসেজেও দাঁড়িয়েছে কয়েকজন যাত্রী। ঠিক এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেয়া ব্রয়লারগুলোর মতো অবস্থা। পিক-আপ একটু দুলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে খাঁচির ভেতরে বেসামাল শরীরে গলা নাচিয়ে ওঠে সব। এর মধ্যে কেউ একজন সামনের দিকে যেতে চাইলেন। প্রথমে কেউ খেয়াল করেনি। আসলে খেয়াল করার মতো কেউ ছিলো না। পঞ্চাশোর্ধ বয়স। খাঁটো মতো, গোট্টাগাট্টা গড়ন। রঙচড়া হলেও পরিচ্ছন্ন কালো প্যান্ট আর গায়ে হাফ হাতার হাওয়াই শার্ট। দেখতে একেবারে অফিসের পুরনো পিওনের মতো। তবে ছোট করে ছাটা দাড়িতে বেশ পরিশিলীত ভাব আছে।

‘এই যে ভাই, দেখি; দেখি; দেখি একটু সামনে যেতে দিন’- বলে বলে রাস্তা করছিলেন লোকটা, দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের ভেতর চূড়ান্ত রকম বিরক্তির উদ্বেগ ঘটিয়ে। তারা বুঝতে পারছিল না, আসলে লোকটা কোথায় যেতে চায়। কারণ লোকটা বাসের সেই যাত্রীকেও সরে দাঁড়াতে বলছিলেন, যেখানে সাধারণত কেউ দাঁড়ায় না। লোকটা ঘুরে দাঁড়াল বাসের একেবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছার পর। কেবল তখনই তার হাতের ছোট পার্সটা সবার সামনে তুলে ধরলেন। প্রথমে সবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন ধর্মমতে সালাম-আদাব দিয়ে। শুধু শিক্ষিতদের ধন্যবাদ জানালেন তিনি।

‘আমার নাম মোহাম্মদ ইউনুস আলী’- দরাজ কণ্ঠে জানান দিলেন লোকটা। ‘আমার বাড়ি খুলনা জেলার ১৩ খাদা উপজেলার জুনুরিয়া গ্রামে। আমি একজন রিকশা চালক ছিলাম।’ এ পর্যন্ত লোকটার সরল স্বীকারোক্তি সবাইকে আকর্ষণ করলো। কিন্তু তিনি কারো প্রতি বিশেষ আগ্রহ না দেখিয়ে একই ভঙ্গিতে বললেন, ‘এখন আপনাদের মাঝে আমি একটা তাবিজ নিয়ে এসেছি।’ কেবল এ সময়ই তার আসল উদ্দেশ্য ধরা পড়লো। তাতে যাত্রীদের বিরক্তিও বেড়ে গেলো কয়েকগুণ। সবকিছু উপেক্ষা করে তবু তিনি বলে যেত লাগলেন, ‘আপনারা প্রশ্ন করবেন, রিকশা ছেড়ে কেন এই কাজে এলাম?’

কারো কাছে প্রশ্নের উত্তর আশা না করে দার্শনিকের মতো নিজেই উত্তর দিলেন, ‘আমি বলবো স্বপ্ন এমনই, আপনাকে পথে নামিয়েই ছাড়বে। এটা কখনো বংশধারা মেনে আসে না।’ তার কণ্ঠ ক্রমেই ক্ষীণ থেকে উচ্চকিত হতে থাকে—‘আমার তাবিজটা যেনতেন কিছু না, এটা স্বপ্নে পাওয়া তাবিজ। এর ভেতরে একটা গাছের জর আছে। আপনারা যদি জিজ্ঞেস করেন এটা এটা কোন গাছের জর?’ পুনরায় তিনি প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন। এটা তার কথা বলার কৌশলও হয়তো। কিন্তু তার কথাগুলো ভারি বেমানান ও অনভ্যস্ত লাগছিলো।

‘আমি বলতে পারবো না। কারণ এটা স্বপ্নে পাওয়া গাছের জর। আমি জানি না।’- খসখসে গলায় লোকটা বলে যেতে লাগলেন, ‘কিন্তু এটা এমন একটা জর, যদি কেউ খাস নিয়তে ব্যবহার করেন, তাহলে দারুণ ফল পাবেন। এটা সবচেয়ে যেটা আপনাকে করবে তা হলো, আপনাকে স্বপ্ন দেখাবে। আপনি স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা ফিরে পাবেন। আপনি স্বপ্ন দেখবেন।’- বিস্ময়ে তার চোখ-মুখ চকচক করছিলো তখন।

লোকটার এই আশ্চর্য রকমের অসুখের কথা সবাইকে বিস্মিত করল। আসলে যাত্রীরা কেউ ভাবেই নি যে, এমন একটা অসুখ কারো থাকতে পারে। কিংবা তারা নিজের অজ্ঞাতেই এই রোগ বহন করে চলছে। এমন কি এর জন্য তাবিজও হতে পরে! কারণ সাধারণত মানুষ স্বপ্ন বিষয়ে দুইটি সমস্যার কথাই জানে। প্রথম যে সমস্যা, তা শিশুকালেই ঘটে। শিশুরা ঘুমের ভেতর দুঃস্বপ্ন দেখে কান্না করে ওঠে, কখনো কখনো, খুব বেশি হলে, স্বপ্নে দেখে বিছানায় পেচ্ছাব করে দেয়। এজন্য মসজিদের ইমামের ‘কাইতান’ পড়া বা বেঁদে-বদ্যির কাছ থেকে কড়ি-রুদ্রাক্ষ-কড়ই ফলের বীজ ও বন রুইয়ের হাড় গাঁথা ‘কাছ’ কোমড়ে বেঁধে দিলেই মুশকিল আসান। দ্বিতীয় সমস্যাটা হয় যৌবন প্রাপ্ত হওয়ার পরে। তখন ঘুমের ভেতর কোনো সুন্দরী রমণীর সঙ্গে সঙ্গমের স্বপ্ন দেখে বীর্যপাত হয়। কখনো কখনো এটা এতটাই ঘন ঘন হয় যে, সে শরীরিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। সবাই একে বলে ‘স্বপ্ন দোষ’। তখন স্বপ্নআক্রান্ত ব্যক্তি গোপনে স্থানীয় ফকির বা ওঁঝার কাছ থেকে পড়া পানি ও তাবিজ নিয়ে খেল খতম করে। কিন্তু এই লোকটা যা বলছে তা হলো, দুঃস্বপ্ন বা ‘স্বপ্ন দোষ-টোষ’ কিছু না, রীতিমত স্বপ্নই না দেখা!

লোকটা বেশ ভারিক্কি চালেই বলেন, ‘আপনি ভাবতে পারেন, এটা কি কোনো অসুখ হলো? আমি বলবো, হ্যাঁ, এটা মস্ত অসুখ। সেই অসুখ বলার আগে, আপনারা বুকে হাত দিয়ে বলেন তো, গত এক সপ্তায় কে কে স্বপ্ন দেখেছেন?’ চারপাশের শব্দের মাঝে লোকটা কথা রিনরিন করে বাজে। তখন কারো কারো মনে হয় লোকটা কথা হয়তো বাইরের শব্দকে বাধা দিচ্ছে।কিন্তু একজন ক্যানভাসারের কথায় যাত্রীরা কেন নিজেকে ঘাটতে যাবে? আসলে লোকটা যদি সাচ্চা ক্যানভাসার হতেন, তাহলে বুকে চাপড় দিয়ে কথাটা বলতে পারতেন। তখনো তার আনাড়ি ভাব চোখে পড়ার মতো। তার কথা শুনে যাত্রীরা কেউ কেউ প্রথমে অন্যর দিকে, তারপর নিজের দিকে তাকালেন। দু-একজন তার বুকের খোলা বোতামটায় হাত ছোঁয়ালেন। কিন্তু গরমে সামান্য স্বস্তি পাওয়া জন্য শেষ পর্যন্ত তা খোলাই রাখলেন।

যথারীতি যাত্রীদের ভেতর থেকে সাড়া পাওয়া গেল না। যদিও কেউ কেউ অন্যদিকে তাকিয়ে লোকটির দিকে কান খাড়া করে রাখলো এরপর সে কী বলে শোনার জন্য। ‘দেখলেন, দেখলেন তো!’— স্বজোরে ঝাঁকিয়ে উঠলেন লোকটা—‘কেউ স্বপ্ন দেখে নাই! স্বপ্ন দেখতে পারে না!’ লোকটা চোখ-মুখ থেকে তখন ঘামের সঙ্গে চুইয়ে চুইয়ে ঝরে পড়ছে বিস্ময়। তিনি অনর্গল বলতে লাগলেন মানুষের স্বপ্ন দেখার অক্ষমতার কথা। তিনি বোঝাতে চাইলেন, এটা যেনতেন সমস্যা না। এটা নেশা-পানি করতে করতে অথবা হস্ত মৈথুন করে জৈবিক ক্ষমতা হারানোর মতো সমস্যা।

‘আপনারা দেখবেন’—লোকটা তার ছোট্ট শরীর চাগিয়ে বলেন, ‘এই অক্ষমতার কথা কেউ কাউকে বলতে পারছে না। ফুটপাতে ‘বলশালী’ ওষুধের দোকানেও ভিড় নেই। কিন্তু’—একমাত্রায় দম নেন লোকটা—‘কিন্তু গোপনে তার চাটনি বিক্রি হয়ে যায়।’ লোকটা সবার সামনে উন্মোচন করে তরমুজের এমন এক জগৎ যার ভেতরের লাল সবাই জানলেও বুক চিড়ে দেখার আগ পর্যন্ত স্বীকার করতে চায় না।

‘এইসব লোকদের নারীর প্রতি ভোগ জাগে কিন্তু দূরে থাকেন। এ দিকে বয়স হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বাড়ি থেকে বিয়ের কথা বললে রাজি হতে পারেন না। স্ত্রী ডাকছে কিন্তু সাড়া দিতে পারছেন না, পরিবারের অশান্তি। স্বপ্ন না দেখা সেই রকম সমস্যা। এটা মা-বোনদের ঋতুশ্রাব, আপনারা যাকে বলেন মাসিক, তা বন্ধ হওয়ার পর শরীর থেকে বের হওয়া ফাই ফাই গন্ধের মতো। যা আপনাকে দূরে ঠেলে দেয়। আপনি যন্ত্রণায় ভুগেন। স্বপ্ন না দেখলে আপনে সেই যন্ত্রণায় ভুগবেন। প্রশ্রাবের রাস্তা বন্ধ হওয়ার মতো জ্বালা-পোড়া করবে আপনার ভেতর।’ লোকটির ভাষা কারো কারো কাছে অমার্জিত মনে হয়। যাত্রীদের ভেতরে একটা অস্বস্তি জেগে ওঠে। বিরক্ত হয়। ভ্যাপসা গরম অনুভব করে একযোগে। কিন্তু কেউ তাকে কথা বন্ধ করতে বলেন না কিংবা মেনেও নিতে পারেন না।
‘ভাই লজ্জা পাবেন না’—লোকটা আবার বলেন, ‘এটা এই সময়ের সব চেয়ে বড় সমস্যা।’ লোকটা তখন নিজের বুকে হাত দিয়ে বলেন, ‘আপনারা বুকে হাত দিয়ে বলেন তো, এই যে প্রতিদিন অফিসে যান-আসেন, এতকিছু দেখেন কিন্তু অন্যকিছু চিন্তা কি করেন? ভেবে দেখেন, আপনি সংসার করেন, কিন্তু তা দারোয়ানের মতো দায়িত্ব পালন ছাড়া কিছুই না। বৈবাহিক জীবনে আপনি বুকের ব্যাথায় রাত-বিরাতে চিৎকার করে ওঠেন। কিন্তু কোনো স্বপ্ন দেখে চিৎকার করেন ওঠেন না। অথচ প্রত্যেক মানুষই স্বপ্ন নিয়ে জন্মায়।’ পূর্ণ স্থিতি নিয়ে থামে লোকটা। গোট্টাগাট্টা গোছার হাতটা তিনি আরেক বার মাথার উপর তুলেন।

‘এই যে’—পুনর্বার তিনি নিজের দিকে আকর্ষণ করেন, ‘‘দেখবেন, অবোধ শিশুরা স্বপ্ন দেখে ঘুমের মধ্যেই হাসে। কারণ কী?’
বিষয়টা সবাই দেখেছে। কিন্তু সবাই শিশুর হাসিতে এতটা খুশি হয়ে যে, এ নিয়ে কেউ কোনো দিন চিন্তা করেছে বলে মনে হয় না। তারা যা জেনে থাকবে তা লোকটা খুব তমিজের সঙ্গে বর্ণনা করেন, ‘কারণ হলো শিশুরা হলো আল্লাহর ফেরেস্তা। তাদের কথা ফেরেস্তারা বুঝে, ফেরেস্তাদের কথাও তারা বুঝে। ফেরেস্তাদের সঙ্গে তাদের দীন মোকামের কথা হয়। ফেরেস্তারা যখন শিশুদের বলেন, ‘তোমার মা তো মারা গেছে। তোমার মা তোমাকে রেখে মামা বাড়ি গেছে। শিশু তখন হাসে। শিশুরা তখন উত্তরে বলে, ‘এটা হতে পারে না! কারণ এইমাত্র আমি মায়ের বুকের দুধ খেয়েছি। এসব বলে আর হাসে।’’

বলতে বলতে লোকটার মুখেও হাসি ফুটে ওঠে। তিনি হাসি হাসি মুখে এদিক সেদিক তাকান। আবার ফেরেস্তারা যখন বলে, ‘তোমার বাবা মারা গেছে।’
শিশুটি বলে, ‘কোথায়?’
‘দূর দেশে গিয়ে মারা গেছে।’
তখন ওরা কাঁদে। ওরা বলে, ‘হ, তা হতেও পারে। কারণ অনেকক্ষণ যাবৎ আমি আমার বাবার মুখ দেখি না।’ লোকটার মুখ এ সময় সত্যি সত্যি গাঢ় বেদনায় ভরে ওঠে। তিনি বসে থাকা যাত্রীদের দিকে তাকান। কিন্তু কারো ভেতর তেমন কোনো হেলদোল দেখা যায় না। ‘আপনারাও হাসেন’— একটা গোপন খবর জেনে ফেলার মতো বিজয়ের ভঙ্গিতে লোকটা বলেন, ‘যখন নেতারা আপনাদের বলে, তোমাদের সকল সমস্যা সমাধান করে দেয়া হবে, আমরা আপনাদের চাকর, আপনাদের সেবা করার সুযোগ চাই। আর যখন আপনারা দেখেন ভোটের পর সবকিছুই আরো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন আপনারা কাঁদেন।’

‘স্বপ্ন হলো তাই যা শিশুরা দেখে। ওরা না বুঝেই এর দ্বারা আমোদিত হয়। ওরা বুঝতে চায় না, সত্যি এর কোনো মূল্য আছে কি না। কিন্তু ওরা দেখে এবং ক্রমাগত নিজের সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু আপনারা শিশুদের মতো স্বপ্নে দেখেন না। স্বপ্ন আপনারও দরকার।’—তর্জনি ঘুরিয়ে দেন যাত্রীদের দিকে—‘স্বপ্ন হলো তাই, যা শিশুদের দেখায় আর বড়দের দেখতে হয়। এই দুনিয়ার জঞ্জাল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য স্বপ্ন দেখা খুবই জরুরি।’

‘চিন্তা করবেন না সাহেবেরা, আপনার যদি স্বপ্ন নাও দেখতে চান তবুও এই তাবিজ কাজ করবে।’—লোকটা আবার শুরু করেন, একেবার শান্ত গলায়। ‘কেউ যদি খাস নিয়তে ব্যবহার করেন আমার এই তাবিজ তার গোপন সমস্যারও সমাধান করবে। এটা মাজার ব্যথা দূর করবে, ধাতু ক্ষয় রোধ করবে এবং কোষ্ঠ-কাঠিন্য দূর করবে। স্বপ্ন না দেখলে জীবনটাই কোষ্ঠ-কাঠিন্যে ভরে ওঠে। আর যদি কেউ চান তাহলে স্বপ্ন দেখতে পারবেন। স্বপ্নই হলো সব কিছুর দাওয়াই। এটা কোনো আল-বিলাতি স্বপ্ন না। সত্যি সত্যি স্বপ্ন।’ একহাত তাস একটা একটা করে ছড়িয়ে দেয়ার মতো বর্ণনা করেন লোকটা।

‘স্বপ্ন বুঝতে হলে আপনাকে সাত আসমান বুঝতে হবে। স্বপ্ন মানে নিজের থেকে একটু ওপরে ওঠা। যেমন করে নবী করিম (সা.) মেরাজে গিয়ে তাঁর বন্ধুর সান্নিধ্যে ছিলেন। যেমন তিনি বন্ধুর হাত ধরে ছিলেন। যেমন তিনি শেষে দেখলেন, তিনি নিজের হাতই ধরে আছেন। স্বপ্ন হলো নিজেকে নিজের বাইরে গিয়ে অনুভব করা।’

লোকটা তার ছোট্ট পার্স থেকে একটা ক্ষুদ্রকায় তাবিজ বের করলেন। তাবিজটা এতটাই ক্ষুদ্রকায় যে, গিঁট ফোলা তিন আঙুলের চিপায় পুরোপুরি ঢাকা পড়ে যায়। তিনি তিন আঙুলের সংযোগস্থলেই চুমু খান একবার। তারপর কপালে ছুঁইয়ে উপরে তুলে ধরেন, ‘তাবিজের দাম আমি আগে বলবো না। তার আগে আপনাদের মাঝে আছেন কোনো ভাই যিনি নিজে স্বপ্ন দেখেন না, কিন্তু স্বপ্নে বিশ্বাস করেন; যিনি অবস্থার বদলে বিশ্বাস করেন, বদল চান—এমন একজন হাত ওঠান।’

কথাগুলো বলতে বলতে লোকটি সবার মুখের দিকে তাকাতে থাকলেন। কিন্তু কেউ তার কথায় সায় দিল না। যখন একজন লোকও তার তাবিজের প্রতি আগ্রহ দেখালো না, লোকটা রীতিমতো মুষড়ে পড়লেন। তাকে বিমর্ষ দেখাল। তিনি গাড়ির ছাদ কেটে তৈরি করা ছোট্ট জানালা দিয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ছোট্ট জানালা দিয়ে তিরতির করে বাতাস আসছিল। তিনি বড় করে নিঃশ্বাস নিলেন। এপাশ-ওপাশ দুঃখী ও অসহায় দৃষ্টিতে বিরবির করে বললেন—স্বপ্নহীন মানুষের কাছে এই তাবিজ কোনো কিছুই ফল দেয় না। বিশ্বাসহীনদের কাছে কিছুই আসে না। স্বপ্ন হইলো জীবনের আত্মা। রুহানী খেলা। আক্ষেপের সঙ্গেই ইউনুস আলী বলেন, ‘যারা মানুষের কথা বিশ্বাস করতে পারে না, তারা নেতাদের বিশ্বাস করবে কি করে?’
‘আহ্ স্বপ্ন!’—ইউনুস আলী বলে উঠেন স্বগোক্তির মতো।

আসলে, দিন চলে যাওয়ার আগে কেউ বুঝতেই পারেন না, দিনটি কেমন কাটবে। যেমন পেটপুরে খাওয়ার পরই কেবল তৃপ্তির ঢেঁকুর দিতে পারে। সরোদের সঙ্গে বেহালা আর তবলার শব্দ মিশ্রণের পরই মনে হয় সত্যিকারের ‘রাগ কাফি’ শুনতে পাচ্ছে। কেউ নষ্ট হওয়ার আগে যদি না বোঝে, তাকে কে বাঁচাবে?

ইউনুস আলী চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। পরবর্তী স্টেশন আসার আগেই তিনি তৈরি হতে থাকেন। নেমে যাওয়ার আগে একজন যাত্রী তাকে দশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিয়ে সাহায্য করতে চাইলেন। ‘স্বপ্ন এমনই আপনাকে পথে নামিয়ে ছাড়বে। এটা আমাকে ক্ষমা করেনি, আপনাকেও করবে না।’— যথেষ্ট দম আটকে ইউনুস আলী বলেন, তারপর স্রোতের বিপরীতের যাওয়া ইলিশ মাছের মতো নেমে যান।

লোকটা নেমে যাওয়ার পরই সম্বিৎ ফিরে পায় সবাই। তাদের মনে পড়ে, এতোক্ষণে লোকটা তাবিজের কোনো দামই বলেন নি। এটা আর কোথাও পাওয়া যাবে কি না তাও বলে যাননি। এমনকি তার তাবিজটা দেখেও নি কেউ। কিন্তু স্বপ্ন দেখা তাদের সবার জন্যই জরুরি।

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» কুয়েতে ঈদুল ফিতর উদযাপিত এবং রাষ্ট্রদূত এর সঙ্গে প্রবাসীদের শুভেচ্ছা বিনিময়

» কান্না দেখে কাঁদছে হৃদয়, আমি মোটেও হৃদয়হীন নয়

» কুয়েতে রাইয়ান ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত

» কুয়েতে বৃহত্তর ফরিদপুর জনকল্যাণ সমিতি কুয়েতের ইফতার ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত

» হাসনাতের ফেসবুক স্ট্যাটাসে তোলপাড় সোশ্যাল প্লাটফর্ম

» কুয়েতে আঞ্জুমানে আল-ইসলাহ কুয়েত শাখার আলোচনা সভা ও ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত

» ঐতিহাসিক বদর দিবস আজ

» জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন কুয়েতের শোক সভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত

» “হামজা” জয় দিয়ে শুরু হোক জয়গান

» বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ স্বপ্ন “হামজা এখন বাংলাদেশে”

Agrodristi Media Group

Advertising,Publishing & Distribution Co.

Editor in chief & Agrodristi Media Group’s Director. AH Jubed
Legal adviser. Advocate Musharrof Hussain Setu (Supreme Court,Dhaka)
Editor in chief Health Affairs Dr. Farhana Mobin (Square Hospital, Dhaka)
Social Welfare Editor: Rukshana Islam (Runa)

Head Office

UN Commercial Complex. 1st Floor
Office No.13, Hawally. KUWAIT
Phone. 00965 65535272
Email. agrodristi@gmail.com / agrodristitv@gmail.com

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
,

স্বপ্ন দেখার তাবিজ-কবজ

ভরা বাস। প্যাসেজেও দাঁড়িয়েছে কয়েকজন যাত্রী। ঠিক এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেয়া ব্রয়লারগুলোর মতো অবস্থা। পিক-আপ একটু দুলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে খাঁচির ভেতরে বেসামাল শরীরে গলা নাচিয়ে ওঠে সব। এর মধ্যে কেউ একজন সামনের দিকে যেতে চাইলেন। প্রথমে কেউ খেয়াল করেনি। আসলে খেয়াল করার মতো কেউ ছিলো না। পঞ্চাশোর্ধ বয়স। খাঁটো মতো, গোট্টাগাট্টা গড়ন। রঙচড়া হলেও পরিচ্ছন্ন কালো প্যান্ট আর গায়ে হাফ হাতার হাওয়াই শার্ট। দেখতে একেবারে অফিসের পুরনো পিওনের মতো। তবে ছোট করে ছাটা দাড়িতে বেশ পরিশিলীত ভাব আছে।

‘এই যে ভাই, দেখি; দেখি; দেখি একটু সামনে যেতে দিন’- বলে বলে রাস্তা করছিলেন লোকটা, দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের ভেতর চূড়ান্ত রকম বিরক্তির উদ্বেগ ঘটিয়ে। তারা বুঝতে পারছিল না, আসলে লোকটা কোথায় যেতে চায়। কারণ লোকটা বাসের সেই যাত্রীকেও সরে দাঁড়াতে বলছিলেন, যেখানে সাধারণত কেউ দাঁড়ায় না। লোকটা ঘুরে দাঁড়াল বাসের একেবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছার পর। কেবল তখনই তার হাতের ছোট পার্সটা সবার সামনে তুলে ধরলেন। প্রথমে সবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন ধর্মমতে সালাম-আদাব দিয়ে। শুধু শিক্ষিতদের ধন্যবাদ জানালেন তিনি।

‘আমার নাম মোহাম্মদ ইউনুস আলী’- দরাজ কণ্ঠে জানান দিলেন লোকটা। ‘আমার বাড়ি খুলনা জেলার ১৩ খাদা উপজেলার জুনুরিয়া গ্রামে। আমি একজন রিকশা চালক ছিলাম।’ এ পর্যন্ত লোকটার সরল স্বীকারোক্তি সবাইকে আকর্ষণ করলো। কিন্তু তিনি কারো প্রতি বিশেষ আগ্রহ না দেখিয়ে একই ভঙ্গিতে বললেন, ‘এখন আপনাদের মাঝে আমি একটা তাবিজ নিয়ে এসেছি।’ কেবল এ সময়ই তার আসল উদ্দেশ্য ধরা পড়লো। তাতে যাত্রীদের বিরক্তিও বেড়ে গেলো কয়েকগুণ। সবকিছু উপেক্ষা করে তবু তিনি বলে যেত লাগলেন, ‘আপনারা প্রশ্ন করবেন, রিকশা ছেড়ে কেন এই কাজে এলাম?’

কারো কাছে প্রশ্নের উত্তর আশা না করে দার্শনিকের মতো নিজেই উত্তর দিলেন, ‘আমি বলবো স্বপ্ন এমনই, আপনাকে পথে নামিয়েই ছাড়বে। এটা কখনো বংশধারা মেনে আসে না।’ তার কণ্ঠ ক্রমেই ক্ষীণ থেকে উচ্চকিত হতে থাকে—‘আমার তাবিজটা যেনতেন কিছু না, এটা স্বপ্নে পাওয়া তাবিজ। এর ভেতরে একটা গাছের জর আছে। আপনারা যদি জিজ্ঞেস করেন এটা এটা কোন গাছের জর?’ পুনরায় তিনি প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন। এটা তার কথা বলার কৌশলও হয়তো। কিন্তু তার কথাগুলো ভারি বেমানান ও অনভ্যস্ত লাগছিলো।

‘আমি বলতে পারবো না। কারণ এটা স্বপ্নে পাওয়া গাছের জর। আমি জানি না।’- খসখসে গলায় লোকটা বলে যেতে লাগলেন, ‘কিন্তু এটা এমন একটা জর, যদি কেউ খাস নিয়তে ব্যবহার করেন, তাহলে দারুণ ফল পাবেন। এটা সবচেয়ে যেটা আপনাকে করবে তা হলো, আপনাকে স্বপ্ন দেখাবে। আপনি স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা ফিরে পাবেন। আপনি স্বপ্ন দেখবেন।’- বিস্ময়ে তার চোখ-মুখ চকচক করছিলো তখন।

লোকটার এই আশ্চর্য রকমের অসুখের কথা সবাইকে বিস্মিত করল। আসলে যাত্রীরা কেউ ভাবেই নি যে, এমন একটা অসুখ কারো থাকতে পারে। কিংবা তারা নিজের অজ্ঞাতেই এই রোগ বহন করে চলছে। এমন কি এর জন্য তাবিজও হতে পরে! কারণ সাধারণত মানুষ স্বপ্ন বিষয়ে দুইটি সমস্যার কথাই জানে। প্রথম যে সমস্যা, তা শিশুকালেই ঘটে। শিশুরা ঘুমের ভেতর দুঃস্বপ্ন দেখে কান্না করে ওঠে, কখনো কখনো, খুব বেশি হলে, স্বপ্নে দেখে বিছানায় পেচ্ছাব করে দেয়। এজন্য মসজিদের ইমামের ‘কাইতান’ পড়া বা বেঁদে-বদ্যির কাছ থেকে কড়ি-রুদ্রাক্ষ-কড়ই ফলের বীজ ও বন রুইয়ের হাড় গাঁথা ‘কাছ’ কোমড়ে বেঁধে দিলেই মুশকিল আসান। দ্বিতীয় সমস্যাটা হয় যৌবন প্রাপ্ত হওয়ার পরে। তখন ঘুমের ভেতর কোনো সুন্দরী রমণীর সঙ্গে সঙ্গমের স্বপ্ন দেখে বীর্যপাত হয়। কখনো কখনো এটা এতটাই ঘন ঘন হয় যে, সে শরীরিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। সবাই একে বলে ‘স্বপ্ন দোষ’। তখন স্বপ্নআক্রান্ত ব্যক্তি গোপনে স্থানীয় ফকির বা ওঁঝার কাছ থেকে পড়া পানি ও তাবিজ নিয়ে খেল খতম করে। কিন্তু এই লোকটা যা বলছে তা হলো, দুঃস্বপ্ন বা ‘স্বপ্ন দোষ-টোষ’ কিছু না, রীতিমত স্বপ্নই না দেখা!

লোকটা বেশ ভারিক্কি চালেই বলেন, ‘আপনি ভাবতে পারেন, এটা কি কোনো অসুখ হলো? আমি বলবো, হ্যাঁ, এটা মস্ত অসুখ। সেই অসুখ বলার আগে, আপনারা বুকে হাত দিয়ে বলেন তো, গত এক সপ্তায় কে কে স্বপ্ন দেখেছেন?’ চারপাশের শব্দের মাঝে লোকটা কথা রিনরিন করে বাজে। তখন কারো কারো মনে হয় লোকটা কথা হয়তো বাইরের শব্দকে বাধা দিচ্ছে।কিন্তু একজন ক্যানভাসারের কথায় যাত্রীরা কেন নিজেকে ঘাটতে যাবে? আসলে লোকটা যদি সাচ্চা ক্যানভাসার হতেন, তাহলে বুকে চাপড় দিয়ে কথাটা বলতে পারতেন। তখনো তার আনাড়ি ভাব চোখে পড়ার মতো। তার কথা শুনে যাত্রীরা কেউ কেউ প্রথমে অন্যর দিকে, তারপর নিজের দিকে তাকালেন। দু-একজন তার বুকের খোলা বোতামটায় হাত ছোঁয়ালেন। কিন্তু গরমে সামান্য স্বস্তি পাওয়া জন্য শেষ পর্যন্ত তা খোলাই রাখলেন।

যথারীতি যাত্রীদের ভেতর থেকে সাড়া পাওয়া গেল না। যদিও কেউ কেউ অন্যদিকে তাকিয়ে লোকটির দিকে কান খাড়া করে রাখলো এরপর সে কী বলে শোনার জন্য। ‘দেখলেন, দেখলেন তো!’— স্বজোরে ঝাঁকিয়ে উঠলেন লোকটা—‘কেউ স্বপ্ন দেখে নাই! স্বপ্ন দেখতে পারে না!’ লোকটা চোখ-মুখ থেকে তখন ঘামের সঙ্গে চুইয়ে চুইয়ে ঝরে পড়ছে বিস্ময়। তিনি অনর্গল বলতে লাগলেন মানুষের স্বপ্ন দেখার অক্ষমতার কথা। তিনি বোঝাতে চাইলেন, এটা যেনতেন সমস্যা না। এটা নেশা-পানি করতে করতে অথবা হস্ত মৈথুন করে জৈবিক ক্ষমতা হারানোর মতো সমস্যা।

‘আপনারা দেখবেন’—লোকটা তার ছোট্ট শরীর চাগিয়ে বলেন, ‘এই অক্ষমতার কথা কেউ কাউকে বলতে পারছে না। ফুটপাতে ‘বলশালী’ ওষুধের দোকানেও ভিড় নেই। কিন্তু’—একমাত্রায় দম নেন লোকটা—‘কিন্তু গোপনে তার চাটনি বিক্রি হয়ে যায়।’ লোকটা সবার সামনে উন্মোচন করে তরমুজের এমন এক জগৎ যার ভেতরের লাল সবাই জানলেও বুক চিড়ে দেখার আগ পর্যন্ত স্বীকার করতে চায় না।

‘এইসব লোকদের নারীর প্রতি ভোগ জাগে কিন্তু দূরে থাকেন। এ দিকে বয়স হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বাড়ি থেকে বিয়ের কথা বললে রাজি হতে পারেন না। স্ত্রী ডাকছে কিন্তু সাড়া দিতে পারছেন না, পরিবারের অশান্তি। স্বপ্ন না দেখা সেই রকম সমস্যা। এটা মা-বোনদের ঋতুশ্রাব, আপনারা যাকে বলেন মাসিক, তা বন্ধ হওয়ার পর শরীর থেকে বের হওয়া ফাই ফাই গন্ধের মতো। যা আপনাকে দূরে ঠেলে দেয়। আপনি যন্ত্রণায় ভুগেন। স্বপ্ন না দেখলে আপনে সেই যন্ত্রণায় ভুগবেন। প্রশ্রাবের রাস্তা বন্ধ হওয়ার মতো জ্বালা-পোড়া করবে আপনার ভেতর।’ লোকটির ভাষা কারো কারো কাছে অমার্জিত মনে হয়। যাত্রীদের ভেতরে একটা অস্বস্তি জেগে ওঠে। বিরক্ত হয়। ভ্যাপসা গরম অনুভব করে একযোগে। কিন্তু কেউ তাকে কথা বন্ধ করতে বলেন না কিংবা মেনেও নিতে পারেন না।
‘ভাই লজ্জা পাবেন না’—লোকটা আবার বলেন, ‘এটা এই সময়ের সব চেয়ে বড় সমস্যা।’ লোকটা তখন নিজের বুকে হাত দিয়ে বলেন, ‘আপনারা বুকে হাত দিয়ে বলেন তো, এই যে প্রতিদিন অফিসে যান-আসেন, এতকিছু দেখেন কিন্তু অন্যকিছু চিন্তা কি করেন? ভেবে দেখেন, আপনি সংসার করেন, কিন্তু তা দারোয়ানের মতো দায়িত্ব পালন ছাড়া কিছুই না। বৈবাহিক জীবনে আপনি বুকের ব্যাথায় রাত-বিরাতে চিৎকার করে ওঠেন। কিন্তু কোনো স্বপ্ন দেখে চিৎকার করেন ওঠেন না। অথচ প্রত্যেক মানুষই স্বপ্ন নিয়ে জন্মায়।’ পূর্ণ স্থিতি নিয়ে থামে লোকটা। গোট্টাগাট্টা গোছার হাতটা তিনি আরেক বার মাথার উপর তুলেন।

‘এই যে’—পুনর্বার তিনি নিজের দিকে আকর্ষণ করেন, ‘‘দেখবেন, অবোধ শিশুরা স্বপ্ন দেখে ঘুমের মধ্যেই হাসে। কারণ কী?’
বিষয়টা সবাই দেখেছে। কিন্তু সবাই শিশুর হাসিতে এতটা খুশি হয়ে যে, এ নিয়ে কেউ কোনো দিন চিন্তা করেছে বলে মনে হয় না। তারা যা জেনে থাকবে তা লোকটা খুব তমিজের সঙ্গে বর্ণনা করেন, ‘কারণ হলো শিশুরা হলো আল্লাহর ফেরেস্তা। তাদের কথা ফেরেস্তারা বুঝে, ফেরেস্তাদের কথাও তারা বুঝে। ফেরেস্তাদের সঙ্গে তাদের দীন মোকামের কথা হয়। ফেরেস্তারা যখন শিশুদের বলেন, ‘তোমার মা তো মারা গেছে। তোমার মা তোমাকে রেখে মামা বাড়ি গেছে। শিশু তখন হাসে। শিশুরা তখন উত্তরে বলে, ‘এটা হতে পারে না! কারণ এইমাত্র আমি মায়ের বুকের দুধ খেয়েছি। এসব বলে আর হাসে।’’

বলতে বলতে লোকটার মুখেও হাসি ফুটে ওঠে। তিনি হাসি হাসি মুখে এদিক সেদিক তাকান। আবার ফেরেস্তারা যখন বলে, ‘তোমার বাবা মারা গেছে।’
শিশুটি বলে, ‘কোথায়?’
‘দূর দেশে গিয়ে মারা গেছে।’
তখন ওরা কাঁদে। ওরা বলে, ‘হ, তা হতেও পারে। কারণ অনেকক্ষণ যাবৎ আমি আমার বাবার মুখ দেখি না।’ লোকটার মুখ এ সময় সত্যি সত্যি গাঢ় বেদনায় ভরে ওঠে। তিনি বসে থাকা যাত্রীদের দিকে তাকান। কিন্তু কারো ভেতর তেমন কোনো হেলদোল দেখা যায় না। ‘আপনারাও হাসেন’— একটা গোপন খবর জেনে ফেলার মতো বিজয়ের ভঙ্গিতে লোকটা বলেন, ‘যখন নেতারা আপনাদের বলে, তোমাদের সকল সমস্যা সমাধান করে দেয়া হবে, আমরা আপনাদের চাকর, আপনাদের সেবা করার সুযোগ চাই। আর যখন আপনারা দেখেন ভোটের পর সবকিছুই আরো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন আপনারা কাঁদেন।’

‘স্বপ্ন হলো তাই যা শিশুরা দেখে। ওরা না বুঝেই এর দ্বারা আমোদিত হয়। ওরা বুঝতে চায় না, সত্যি এর কোনো মূল্য আছে কি না। কিন্তু ওরা দেখে এবং ক্রমাগত নিজের সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু আপনারা শিশুদের মতো স্বপ্নে দেখেন না। স্বপ্ন আপনারও দরকার।’—তর্জনি ঘুরিয়ে দেন যাত্রীদের দিকে—‘স্বপ্ন হলো তাই, যা শিশুদের দেখায় আর বড়দের দেখতে হয়। এই দুনিয়ার জঞ্জাল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য স্বপ্ন দেখা খুবই জরুরি।’

‘চিন্তা করবেন না সাহেবেরা, আপনার যদি স্বপ্ন নাও দেখতে চান তবুও এই তাবিজ কাজ করবে।’—লোকটা আবার শুরু করেন, একেবার শান্ত গলায়। ‘কেউ যদি খাস নিয়তে ব্যবহার করেন আমার এই তাবিজ তার গোপন সমস্যারও সমাধান করবে। এটা মাজার ব্যথা দূর করবে, ধাতু ক্ষয় রোধ করবে এবং কোষ্ঠ-কাঠিন্য দূর করবে। স্বপ্ন না দেখলে জীবনটাই কোষ্ঠ-কাঠিন্যে ভরে ওঠে। আর যদি কেউ চান তাহলে স্বপ্ন দেখতে পারবেন। স্বপ্নই হলো সব কিছুর দাওয়াই। এটা কোনো আল-বিলাতি স্বপ্ন না। সত্যি সত্যি স্বপ্ন।’ একহাত তাস একটা একটা করে ছড়িয়ে দেয়ার মতো বর্ণনা করেন লোকটা।

‘স্বপ্ন বুঝতে হলে আপনাকে সাত আসমান বুঝতে হবে। স্বপ্ন মানে নিজের থেকে একটু ওপরে ওঠা। যেমন করে নবী করিম (সা.) মেরাজে গিয়ে তাঁর বন্ধুর সান্নিধ্যে ছিলেন। যেমন তিনি বন্ধুর হাত ধরে ছিলেন। যেমন তিনি শেষে দেখলেন, তিনি নিজের হাতই ধরে আছেন। স্বপ্ন হলো নিজেকে নিজের বাইরে গিয়ে অনুভব করা।’

লোকটা তার ছোট্ট পার্স থেকে একটা ক্ষুদ্রকায় তাবিজ বের করলেন। তাবিজটা এতটাই ক্ষুদ্রকায় যে, গিঁট ফোলা তিন আঙুলের চিপায় পুরোপুরি ঢাকা পড়ে যায়। তিনি তিন আঙুলের সংযোগস্থলেই চুমু খান একবার। তারপর কপালে ছুঁইয়ে উপরে তুলে ধরেন, ‘তাবিজের দাম আমি আগে বলবো না। তার আগে আপনাদের মাঝে আছেন কোনো ভাই যিনি নিজে স্বপ্ন দেখেন না, কিন্তু স্বপ্নে বিশ্বাস করেন; যিনি অবস্থার বদলে বিশ্বাস করেন, বদল চান—এমন একজন হাত ওঠান।’

কথাগুলো বলতে বলতে লোকটি সবার মুখের দিকে তাকাতে থাকলেন। কিন্তু কেউ তার কথায় সায় দিল না। যখন একজন লোকও তার তাবিজের প্রতি আগ্রহ দেখালো না, লোকটা রীতিমতো মুষড়ে পড়লেন। তাকে বিমর্ষ দেখাল। তিনি গাড়ির ছাদ কেটে তৈরি করা ছোট্ট জানালা দিয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ছোট্ট জানালা দিয়ে তিরতির করে বাতাস আসছিল। তিনি বড় করে নিঃশ্বাস নিলেন। এপাশ-ওপাশ দুঃখী ও অসহায় দৃষ্টিতে বিরবির করে বললেন—স্বপ্নহীন মানুষের কাছে এই তাবিজ কোনো কিছুই ফল দেয় না। বিশ্বাসহীনদের কাছে কিছুই আসে না। স্বপ্ন হইলো জীবনের আত্মা। রুহানী খেলা। আক্ষেপের সঙ্গেই ইউনুস আলী বলেন, ‘যারা মানুষের কথা বিশ্বাস করতে পারে না, তারা নেতাদের বিশ্বাস করবে কি করে?’
‘আহ্ স্বপ্ন!’—ইউনুস আলী বলে উঠেন স্বগোক্তির মতো।

আসলে, দিন চলে যাওয়ার আগে কেউ বুঝতেই পারেন না, দিনটি কেমন কাটবে। যেমন পেটপুরে খাওয়ার পরই কেবল তৃপ্তির ঢেঁকুর দিতে পারে। সরোদের সঙ্গে বেহালা আর তবলার শব্দ মিশ্রণের পরই মনে হয় সত্যিকারের ‘রাগ কাফি’ শুনতে পাচ্ছে। কেউ নষ্ট হওয়ার আগে যদি না বোঝে, তাকে কে বাঁচাবে?

ইউনুস আলী চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। পরবর্তী স্টেশন আসার আগেই তিনি তৈরি হতে থাকেন। নেমে যাওয়ার আগে একজন যাত্রী তাকে দশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিয়ে সাহায্য করতে চাইলেন। ‘স্বপ্ন এমনই আপনাকে পথে নামিয়ে ছাড়বে। এটা আমাকে ক্ষমা করেনি, আপনাকেও করবে না।’— যথেষ্ট দম আটকে ইউনুস আলী বলেন, তারপর স্রোতের বিপরীতের যাওয়া ইলিশ মাছের মতো নেমে যান।

লোকটা নেমে যাওয়ার পরই সম্বিৎ ফিরে পায় সবাই। তাদের মনে পড়ে, এতোক্ষণে লোকটা তাবিজের কোনো দামই বলেন নি। এটা আর কোথাও পাওয়া যাবে কি না তাও বলে যাননি। এমনকি তার তাবিজটা দেখেও নি কেউ। কিন্তু স্বপ্ন দেখা তাদের সবার জন্যই জরুরি।

Facebook Comments Box


এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



Exchange Rate

Exchange Rate EUR: Thu, 3 Apr.

সর্বশেষ খবর



Agrodristi Media Group

Advertising,Publishing & Distribution Co.

Editor in chief & Agrodristi Media Group’s Director. AH Jubed
Legal adviser. Advocate Musharrof Hussain Setu (Supreme Court,Dhaka)
Editor in chief Health Affairs Dr. Farhana Mobin (Square Hospital, Dhaka)
Social Welfare Editor: Rukshana Islam (Runa)

Head Office

UN Commercial Complex. 1st Floor
Office No.13, Hawally. KUWAIT
Phone. 00965 65535272
Email. agrodristi@gmail.com / agrodristitv@gmail.com

Bangladesh Office

Director. Rumi Begum
Adviser. Advocate Koyes Ahmed
Desk Editor (Dhaka) Saiyedul Islam
44, Probal Housing (4th floor), Ring Road, Mohammadpur,
Dhaka-1207. Bangladesh
Contact: +8801733966556 /+8801316861577

Email Address

agrodristi@gmail.com, agrodristitv@gmail.com

Licence No.

MC- 00158/07      MC- 00032/13

Design & Devaloped BY Popular-IT.Com
error: দুঃখিত! অনুলিপি অনুমোদিত নয়।