মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশসহ সৌদি আরবে বাংলাদেশিদের পদচারণা ক্রমেই বেড়ে চলছে নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য এটি সুখবর। এই মানুষগুলো আমাদের কাছে প্রবাসী বাঙালি হিসেবেই পরিচিত। এদের অল্পসংখ্যক ভালো অবস্থানে থেকে কাজ করার সুযোগ পেলেও অধিকাংশই শ্রমজীবী মানুষ। শ্রমজীবী হলেও তারা আমাদের কাছে অতি সম্মানিতদের একজন। আমরা জানি টাকা-পয়সা খরচ করে বিদেশে ভ্রমণে যাননি তারা গিয়েছেন দৈহিক শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করতে; যে অর্থের ভাগীদার হচ্ছি আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ভাবে। মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের এ শ্রমজীবী মানুষের দারুণ খ্যাতি রয়েছে। দুটি কারণে সাধারণত এ খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন তারা। বিশ্বস্ততা এবং স্বল্পমূল্যে শ্রম দান করার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে রীতিমতো বাঙালিদের জয়জয়কার শোনা যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে অপ্রীতিকর কিছু ঘটনা ঘটে থাকলেও তা ধর্তব্যের আওতায় পড়ছে না। কিন্তু বর্তমানে ছোটখাটো ভুলভ্রান্তিগুলোকে অনেক বড় করে দেখছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সরকার। এর প্রধান কারণ হচ্ছে রোহিঙ্গাদের উপদ্রব। তারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট হাতিয়ে ওমরাহ ভিসা নিয়ে সৌদি আরবে পালিয়ে থেকে যাচ্ছে। চুরি-চামারিসহ নানা অপকর্ম করে ধরা পড়লে বাংলদেশি বলে পরিচয় দিচ্ছে। কাগজে কলমেও প্রমাণ মিলছে বাংলাদেশি, ফলে এক্ষেত্রে আর সাফাই গাওয়ার মতো সুযোগ থাকছে না। রোহিঙ্গারা এসব করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, তারা অধিক কাজ প্রাপ্তির লোভে নিজেদের শ্রমের মূল্যও কমিয়ে নিচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশি শ্রমিকরাও বাধ্য হচ্ছেন তাদের শ্রমের মূল্য আরো কমিয়ে দিতে। এতে বিপাকে পড়ে গেছেন বাংলাদেশি শ্রমিকরা। অধিক পরিশ্রম করেও পর্যাপ্ত অর্থকড়ি নিজ দেশে প্রেরণ করতে পারছেন না। অন্যদিকে আগের মতো বুক টান করে বিদেশের মাটিতে চলাফেরাও করতে পারছেন না। বাংলাদেশি পরিচয় জানলে সন্দেহের চোখে দেখছেন সেসব অনেকেই। অথচ আদতেই বাংলাদেশিরা অমন ধাঁচের নয় সেটি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন রোহিঙ্গাদের কারণেই। রোহিঙ্গারা সত্য-মিথ্যা বলে বিদেশিদের কান ভারি করছেন, এ রকম তথ্যও আমরা পত্রিকা মারফত জানতে পেরেছি। অথচ রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের দয়া দাক্ষিণ্যের ওপর থেকেই লালিত হচ্ছে এবং বাংলাদেশের পাসপোর্ট হাতিয়ে নিচ্ছে।
বাংলাদেশে মোট চার ধাপে রোহিঙ্গারা (মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়) অনুপ্রবেশ করে। তারা প্রথম অনুপ্রবেশ করে ১৭৮৪ সালে। তখন রাজা ‘বোদাওপায়া’ আরাকান দখলে নিয়ে রাজধানী গঠন করেন। দ্বিতীয়বার অনুপ্রবেশ করে জাপান কর্তৃক বার্মা (মিয়ানমার) দখল হলে। তৃতীয় ধাপে অনুপ্রবেশ করে ১৯৭৮ সালে। তখন প্রায় ২ লাখের বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। জেনারেল নে উইন অপারেশন কিংয়ের মাধ্যমে নাগরিকত্ব নথিবদ্ধ করার প্রাক্কালে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে ওই সময়ে। চতুর্থবার অনুপ্রবেশ করে ১৯৯১-৯২ সালে। তখন দ্য স্টেট ল’ অ্যান্ড অর্ডার রেজিস্ট্রেশন কাউন্সিল (এসএলওআরসি) উত্তর রাখাইন রাজ্যে মুসলিম সন্ত্রাসী দমনের উদ্যোগ নিয়ে সামরিক তৎপরতা বাড়িয়ে দিলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। দেখা গেছে মিয়ানমারে যখনই রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন বেড়ে যায় তখনই তারা তৎপর হয় ওঠে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে আমাদের সীমান্তরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এক সময় বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে পরক্ষণে স্থায়ী আবাসন গড়ার চিন্তা করে। এভাবে অনুপ্রবেশের ফলে বর্তমানে তাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় পাঁচ লাখের মতো। এ সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা ভোটার তালিকায় স্থান করেও নিয়েছে এবং নিচ্ছে নানা কৌশল অবলম্বন করে। উল্লেখ্য, রিফিউজি রেজিস্টার্ডভুক্তরা ভোটার তালিকায় স্থান না পাওয়ার কারণে স্বার্থান্বেষী মহলের ইঙ্গিতে রোহিঙ্গারা পালিয়ে কক্সবাজারের বিভিন্ন গ্রামে বসবাস করছে। পরে সুযোগ বুঝে ভোটার তালিকায় নাম উঠিয়ে নিচ্ছে। এ ধরনের তথ্যচিত্রের খবর আমরা প্রথম জানতে পারি ২০০৭-২০০৮ সালের দিকে। ওই সময় পাবর্ত্য এলাকায় ১২টি উপজেলায় পালিয়ে বেড়ানো রোহিঙ্গারা ভোটার হওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়। বিষয়টা নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টিগোচরে এলে ২০০৯ সালে তা খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয় কমিশন। এতে করে প্রায় ৪৮ হাজার ৬৭৩ জন রোহিঙ্গা ভোটার তালিকায় স্থান পাওয়ার সত্যতার প্রমাণ পায় নির্বাচন কমিশন। সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার পর এদের ভোটার তালিকা থেকে বাদও দেয় তৎকালীন নির্বাচন কমিশন। Â
রোহিঙ্গা শরণার্থীরা শুধু বাংলাদেশের ভোটারই হচ্ছে না, তারা ভোটার আইডি কার্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশি পাসপোর্ট বানিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে পাড়িও জমাচ্ছে। জানা যায় প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা বিভিন্ন ধরনের কূট-কৌশল অবলম্বন করে এ দেশের পাসপোর্ট হাতিয়ে নিয়েছে। এদের অধিকাংশই এখন সৌদি আরবে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত রয়েছে। এ সংখ্যা ক্রমান্বয়েই বাড়ছে, যা আমাদের জন্য অশনী সংকেত বলে মনে করছেন বিজ্ঞজনেরা। তারা আরো মনে করছেন, মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার ধরে রাখতে না পারলে আমাদের দেশ নি¤œ-মধ্যবিত্তের গণ্ডি পেরুতে হিমশিম খাবে। কাজেই ভবিষ্যতে যেন এমনটি আর না ঘটতে পারে সে দিকে দৃষ্টি দেয়া জরুরি কর্তব্য। এতে করে যেমনি বাঁচবে দেশের মান তেমনি বাড়বে দেশের অর্থনীতির গতি। Â
লেখক: আলম শাইন, কথাসাহিত্যিক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ।