নিজস্ব প্রতিবেদকঃ দীর্ঘ প্রায় ৪৫ ঘণ্টা জাতীয় সংসদে আলোচনার পর বৈষম্য দূর করে টেকসই উন্নয়ন করার লক্ষ্যে দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ বাজেট পাস হয়েছে । ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বাজেট পাস করে আবুল মাল আবদুল মুহিত । তার এটি টানা দশম বাজেট।
বিরোধী দল জাতীয় পার্টির স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে নির্দিষ্টকরণ বিল পাসের মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে নতুন ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট পাস হয়। টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ অর্থাৎ পঞ্চম বাজেট এটি। আর অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল মাল আবদুল মুহিতের টানা দশম বাজেট।
সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদসহ সরকারি ও বিরোধী দলের অধিকাংশ সদস্যের উপস্থিতিতে অধিবেশনে প্রস্তাবিত বাজেটের উপর ৫৯টি মঞ্জুরি দাবির বিপরীতে ৪৪৮টি ছাঁটাই প্রস্তাব আনা হয়।
সরকার ও বিরোধী দলের হুইপের মধ্যে সমঝোতা অনুযায়ী ৫টি মঞ্জুরি দাবি আলোচনার সিদ্ধান্ত হয়। আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় পার্টির মো. ফখরুল ইমাম, কাজী ফিরোজ রশীদ, নূরুল ইসলাম ওমর, মোহাম্মদ আব্দুল মুনিম চৌধুরী, নূরুল ইসলাম মিলন, সেলিম উদ্দিন ও বেগম রওশন আরা মান্নান এবং স্বতন্ত্র সদস্য ডা. রুস্তম আলী ফরাজী।
দীর্ঘ প্রায় চার ঘণ্টা আলোচনা শেষে দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ বাজেট পাস হয়। এর আগে আলোচনা শেষে মঞ্জুরি দাবিগুলো কণ্ঠভোটে সংসদে গৃহীত হয়। এরপর অর্থমন্ত্রী ‘নির্দিষ্টকরণ বিল-২০১৮’ পাসের প্রস্তাব উত্থাপন করলে সর্বসম্মতিতে তা পাস হয়।
বৈষম্য দূর করে টেকসই উন্নয়ন করার লক্ষ্য নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সর্বোচ্চ ৫ লাখ ৭১ হাজার ৮৩৩ কোটি ৮২ লাখ ৯২ হাজার টাকা ব্যয়ের অনুমোদন নিতে নির্দিষ্টকরণ বিল-২০১৮ পাসের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। পরে কণ্ঠভোটে সর্বসম্মতিতে তা পাস হয়।
এর আগে মঞ্জুরি দাবির উপর আলোচনার সুযোগ নিয়ে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা শিক্ষাখাতে অনিয়ম-দুর্নীতি, অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যর্থতা, জনগণের স্বাস্থ্য সেবা সঙ্কট, দুর্যোগ মোকাবেলা প্রস্তুতির অভাব ও রেলখাতের অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কঠোর সমালোচনা করেন।
সংসদে পাস হওয়া ৫ লাখ ৭১ হাজার ৮৩৩ কোটি ৮২ লাখ ৯২ হাজার টাকা ব্যয় বরাদ্দের নির্দিষ্টকরণ বিলটিই মূলত গ্রস বাজেট। বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও অন্যান্য খাতে বাজেটে সরকারের অর্থ বরাদ্দের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু এ অর্থ কখনও ব্যয় হয় না। যা বাজেটের আয়-ব্যয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে হিসাব মেলানো হয়। এই বাধ্যবাধকতার কারণে এবারের বাজেটেও ১ লাখ ৪৬ হাজার ১৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা ব্যয় হবে না।
অর্থমন্ত্রী গত ৭ জুন জাতীয় সংসদে যে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বাজেট উত্থাপন করেছেন, সেটাই ব্যয় হবে। সেটাই আগামী অর্থবছরের নিট বাজেট।
স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশনে আগামী অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট কণ্ঠভোটে পাস হয়। ৮৫ বছর বয়সী মুহিত এ বাজেটসহ তার দেয়া সকল বাজেটকে নির্বাচনী বাজেট আখ্যা দিয়েছেন। তবে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সদস্যদের বাইরে নিজ দল আওয়ামী লীগ, এমনকি মন্ত্রিসভার সহকর্মীরাও মুহিতের সমালোচনা করেছেন। বাজেট প্রস্তাবের পর সংসদ ও সংসদের বাইরে আলোচনা ও সমালোচনার প্রেক্ষিতে কিছু সংশোধনী এনে গতকাল বুধবার অর্থবিল ২০১৮ পাস করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্য টেবিল চাপড়িয়ে ইতিহাসের সর্ববৃহৎ বাজেট বাস্তবায়নের যাত্রাকে স্বাগত জানান। গত ৭ জুন জাতীয় সংসদে সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ শিরোনামে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। প্রস্তাবিত বাজেটের উপর সাধারণ আলোচনা গত ১০ জুন থেকে শুরু হয়।
গতকাল ২৭ জুন (বুধবার) সংসদ নেতা ও প্রধামন্ত্রী শেষ হাসিনার বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে সাধারণ আলোচনা শেষ হয়। মোট প্রায় ৪৫ ঘণ্টার আলোচনায় সরকারি দলের ১৬৫ জন এবং বিরোধী দলের ৪২ জন সদস্য অংশ নেন।
বাজেটে ব্যয়ের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। অনুদান ছাড়া আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। ফলে বাজেটে ঘাটতি থাকছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। অন্যদিকে অনুদানসহ মোট আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। এতে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ১ লাখ ২১ হাজার ২৪২ কোটি টাকা।
মোট রাজস্ব আয়ের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর খাতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা। এনবিআর-বহির্ভূত কর খাতের আয় ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা এবং কর ব্যতীত রাজস্ব আয় ৩৩ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। এছাড়া বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা।