ভারতে কোনও সাংবাদিক ‘ফেক নিউজ’ বা ভুয়ো খবর করলে তার স্বীকৃতি ও যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা কেড়ে নেওয়া হবে, এমন একটি নির্দেশ জারি করার পরদিনই সরকার তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের ওই নির্দেশিকায় বলা হয়েছিল, কোনও সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ফেক নিউজ প্রচারের অভিযোগ এলেই সঙ্গে সঙ্গে তার সরকারি অ্যাক্রিডিটেশন বা অনুমতিপত্র বাতিল হয়ে যাবে।
কিন্তু এর বিরুদ্ধে সংবাদকর্মীরা তীব্র প্রতিবাদ জানানোয় মঙ্গলবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কার্যালয়ের হস্তক্ষেপে ওই নির্দেশ রদ করা হয়েছে।
বিরোধী দলগুলিও বলছে, ফেক নিউজের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর প্রয়োজন থাকলেও তা কিছুতেই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে হতে পারে না।
ভারতে ফেক নিউজের বিপদ নিয়ে রাজনীতিবিদ, সমাজতাত্ত্বিকরা সতর্ক করে আসছেন গত বেশ কিছুদিন ধরেই – কিন্তু সেই ভুয়ো খবর ঠেকানোর জন্য সোমবার রাতে সরকার যে প্রেস বিবৃতিটি জারি করে তা অনেককেই হতবাক করে দেয়।
কারণ ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ফেক নিউজের অভিযোগ উঠলেই সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের অ্যক্রিডিটেশন বাতিল হয়ে যাবে – যার অর্থ তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই সরকারি ভবনগুলোতে বা সাংবাদিক সম্মেলনেও তার প্রবেশাধিকার থাকবে না।
‘অল্ট নিউজ’ নামে যে পোর্টালটি ভারতে ফেক নিউজের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বিরাট সাড়া ফেলেছে, তার কর্ণধার প্রতীক সিনহা বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন পৃথিবীর নানা দেশে ফেক নিউজের ইস্যুকে যেখানে খুব গুরুত্ব দিয়ে বা বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়ে মোকাবিলার চেষ্টা হচ্ছে, সেখানে ভারত কিন্তু চার প্যারার একটা বিবৃতি দিয়েই দায় সেরেছে।
“মনে হচ্ছে, স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সাংবাদিকরাই তাদের মূল নিশানা – অথচ ফেক নিউজের ব্যাপারে যারা মূল অপরাধী, সেই সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে সরকার একেবার চুপ”, বলছিলেন মি সিনহা।
বিরোধী দল কংগ্রেসের মুখপাত্র সঞ্জয় ঝা-ও অভিযোগ করেন, এই নির্দেশে সরকারের একটা স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে।
তার বক্তব্য ছিল, “বিশেষ করে স্মৃতি ইরানির অধীন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় যেভাবে ইচ্ছেমতো ফরমান জারি করছে তার বিরুদ্ধে ভারতের সব মিডিয়ার রুখে দাঁড়ানো উচিত। কারণ এইভাবে চললে এই সরকার ভারতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেবে।”
তথ্যমন্ত্রী স্মৃতি ইরানি কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন এদিন সকালেও – এই নির্দেশিকার পক্ষে সওয়াল করে তিনি টুইটারে তর্কে জড়ান কংগ্রেস নেতা আহমেদ প্যাটেলের সঙ্গেও।
কিন্তু দেশের সাংবাদিকরা এই ফরমানে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ, এটা আঁচ করে দুপুরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী মোদীর দফতর ওই বিবৃতি প্রত্যাহার করার নির্দেশ দেয়।
ফেক নিউজের অভিযোগ আগের মতোই প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়াই খতিয়ে দেখবে, একথা জানানোর পরও সাংবাদিকদের ক্ষোভ অবশ্য পুরোপুরি থামেনি।
প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়ার জরুরি প্রতিবাদ-সভা থেকে সংস্থার প্রেসিডেন্ট গৌতম লাহিড়ী বলছিলেন কেন তারা এখনও পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারছেন না।
“আমাদের সন্দেহ, যে সরকার একবার এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে ভবিষ্যতেও তারা আবার একই জিনিস করতে পারে। সেটা যাতে তারা না-নিতে পারে, সে জন্যই আমরা মনে করছি সাংবাদিকদের এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করা দরকার”, বলছিলেন মি লাহিড়ী।
তিনি আরও জানান, প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়ার এদিনের সভা থেকে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবও এসেছে। যার একটি হল, প্রতিনিধিত্বমূলক বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের সুপারিশ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সরকার যেভাবে অ্যাক্রিডিটেশন কমিটি গঠন করেছে তার বিরুদ্ধে কোনও আইনি পদক্ষেপ নেওয়া যায় কি না সেটা খতিয়ে দেখা হবে।
দ্বিতীয়ত, সোশ্যাল মিডিয়ায় যে সব ‘বিভেদকামী তথ্য’ প্রচার করা হয়ে থাকে তার ওপর নজরদারি চালানোর জন্য প্রেস ক্লাব ইন্ডিয়ার তরফে একটি ‘ওয়াচডগ’ গঠনেরও প্রস্তাব এসেছে। প্রয়োজনে তারা ওই ফেক নিউজের বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সতর্কও করবে।
সরকার অবশ্য ফেক নিউজের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সেই পথে হাঁটতে চায় বলে এখনও কোনও ইঙ্গিত দেয়নি।
আর বিরোধী দলগুলির পরামর্শ, এই অভিযান শুরু হওয়া উচিত শাসক দল বিজেপির আইটি সেল থেকেই – যাদের বিরুদ্ধেও অতীতে ভূয়ো খবর ছড়ানোর প্রচুর অভিযোগ উঠেছে।
সূত্র, বিবিসি