বাংলাদেশে দু’হাজার সাল থেকে সাতটি নতুন রোগ শনাক্ত হয়েছে। যার সবগুলি পশু-পাখি ও কীট-পতঙ্গের মাধ্যমে ছড়ায়।
যুনোটিক ডিজিজ বলে পরিচিত এরকম পুরনো কয়েকটি রোগেরও নতুন করে প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে।
পশু-পাখি ও কীট-পতঙ্গ বাহিত অসুখ হঠাৎ এতটা পাওয়া যাচ্ছে কেন? সেগুলো সম্পর্কে মানুষজন কতটা জানে? আর তা প্রতিরোধে কি করা হচ্ছে?
ফরিদপুর সদরের মুল্লাপাড়ার বাসিন্দা খোকন ভাণ্ডারীর সাথে টেলিফোনে কথা হচ্ছিলো।
২০০৩ সালে খোকন ভাণ্ডারী ও তার পরিবারের ১৫ জন সদস্য নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এর মধ্যে নজনই মারা গেছেন। সেসময় বেশ সাড়া ফেলেছিল ঘটনাটি।
তিনি বলছিলেন, “আমার হুঁশ ছিলো না। আমারে আর আমার ওয়াইফরে ঢাকায় নিয়া মেডিকেলে ভর্তি করছিলো। কই রাখছে কী করছে কিছুই বলতে পারি না।”
খোকন ভাণ্ডারী তার অসুখ সম্পর্কে অনেক কিছুই পরে আবিষ্কার করেছেন এবং অবাক হয়েছেন।
রোগটি সম্পর্কে তিনি কতদূর জানেন সেনিয়ে বলছিলেন, “পরে বিদেশি ডাক্তাররা আমাদের বলছে কিভাবে অসুখটা হয়। খেজুরের রস বাদুরে খাইছে। সেই খেজুরের রস থেকে আমাদের নিপা হইছে। অবাক হওয়ারই কথা। কিন্তু পরে চিন্তা করলাম হইলেও হইতে পারে কারণ রসের হাড়িতো খোলা থাকে। এখন আল্লাহ পাকই জানে”
বাংলাদেশ রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট বা আইডিসিআরের দেয়া তথ্য মতে বাংলাদেশে ৩১ টি জেলায় এখনো পর্যন্ত বাদুর থেকে ছড়ানো এই অসুখটি পাওয়া গেছে। তবে প্রথম শনাক্ত হয়েছিলো ২০০১ সালে।
এর পর থেকে প্রতি শীতে অর্থাৎ খেজুরের রস খাওয়ার মৌসুমে অসুখটি মাঝে মাঝেই দেখা গেছে।
এপর্যন্ত শনাক্ত হওয়া ২৯৮ জন রোগীর মধ্যেই মারা গেছে ২০৯ জন। এরকম আর একটি পশু বাহিত অসুখ সোয়াইন ফ্লু।
২০০৯ সালে বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত হয়েছে। রোগটির নামই বলে দেয় এটি শুকর থেকে ছড়ায়। আর বাংলাদেশে পাখি ও মোরগ-মুরগী বাহিত যে অসুখটি সম্পর্কে অনেকেই শুনেছেন সেটি হলো বার্ড ফ্লু বা এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা।
সেটি বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে প্রথম পাওয়া গেছে ২০০৪ সালে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত এর আটজন রোগী শনাক্ত হয়েছে যার মধ্যে মারা গেছেন একজন।
অন্যদিকে বাংলাদেশে কাছাকাছি সময়ে মশাবাহিত একটি রোগ ডেঙ্গু রোগটি সম্পর্কে অনেকেই শুনেছেন।
দু’হাজার সালে বাংলাদেশে প্রথম অসুখটি চিহ্নিত হওয়ার পর থেকে প্রায় ৪০ হাজার লোক এতে আক্রান্ত হয়েছেন।
আর মারা গেছেন ২৬৫ জন। ঢাকার কাফরুলের বাসিন্দা কাজি সাইফ উদ্দিন এক বছর আগে বোনকে হারিয়েছেন ডেঙ্গু জ্বরে।
তিনি বলছিলেন, “সেদিন রাত এগারোটার সময় ওর হাজব্যান্ড আমাকে ফোন করলো যে ডেঙ্গু হইছে। এরপর রাত আড়াইটার দিকে আবার ফোন আসলো নিপু শেষ। মনে করলাম যে মশা থেকে হয়তো রোগ হতে পারে কিন্তু মৃত্যু যে হবে তা বুঝতে পারিনি। ভাবছিলাম হয়ত ভুগবে”।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বড় শহরগুলোতে নতুন আতংকের নাম এডিস মশাবাহিত আরেক রোগ চিকুনগুনিয়া।
আর লাতিন আমেরিকায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া মশাবাহিত আরেক রোগ, ‘জিকা’ রোগী বাংলাদেশে শনাক্ত হয়েছে এ পর্যন্ত একজন।
মশাবাহিত জাপানিজ এনকেফালাইটিসও বাংলাদেশে পাওয়া গেছে। আইডিসিআরের দেয়া তথ্য মতে ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশে যতগুলো নতুন রোগ শনাক্ত হয়েছে তার সবগুলোই পশু-পাখি ও কীট-পতঙ্গের মাধ্যমে ছড়ায়।
এরকম সাতটি নতুন অসুখ এসময় থেকে বাংলাদেশ পাওয়া গেছে যা পৃথিবীর অন্য কোন প্রান্ত থেকে এসেছে।
ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ প্রিভেনটিভ এন্ড সোশাল মেডিসিন নিপসম এর প্রধান বায়েজিদ খুরশীদ রিয়াজ বলছেন বিশ্বব্যাপী মানুষের যাতায়াত যত বাড়ছে সেই সাথে অসুখও পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্বের নানা প্রান্তে।
তিনি বলছেন, “মানুষের নিজের দেশের মধ্যে চলাফেরা যেভাবে বেড়েছে তেমনি দেশের বাইরেও চলাফেরা বেড়ে গেছে। এর একটা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে যে স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো একটি অঞ্চলের ছিলো বা কোন স্থানের ছিলো সেটি বিশ্বব্যাপী হয়ে যাচ্ছে”।
কিন্তু পশুপাখি আর কীট পতঙ্গ বাহিত রোগ এত বেশি দেখা যাচ্ছে কেন?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে বর্তমানে পৃথিবীতে নতুন যেসব সংক্রামক ব্যাধি দেখা যাচ্ছে তার ৭০ শতাংশই যুনোটিক ডিজিজ অর্থাৎ পশুপাখি ও কীট পতঙ্গ থেকে ছড়ানো রোগ।
আইডিসিআরের প্রধান মিরযাদি সাব্রিনা ফ্লোরা বলছেন জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে রয়েছে এর একটি বড় সম্পর্ক।
তিনি বলছে “জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে কিছু জীবাণু বংশ বৃদ্ধি করতে পারছে বেশি। কিছু জীবাণু নতুনভাবে শক্তিশালী হয়ে মানুষ বা পশুকে আক্রান্ত করছে। কোন কোনো জীবাণু ছিলো আগে শুধু পশুকে আক্রান্ত করতো এখন পরিবর্তিত হয়ে মানুষকেও আক্রমণ করার ক্ষমতা অর্জন করছে। আবার মানুষ থেকে মানুষ ছড়াতো না কিন্তু এখন ছড়াচ্ছে। এসব কিছু সমসাময়িক ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে হচ্ছে এবং শুধু বাংলাদেশে না সারা বিশ্বব্যাপী হচ্ছে”।
কিন্তু বাংলাদেশের মানুষজন এ ধরনের রোগবালাই সম্পর্কে কতটা জানেন? নিপসম এর প্রধান মি: রিয়াজ বলছেন, বাংলাদেশের মানুষ ঠেকে শিখছে।
তিনি বলছিলেন, “চিকুনগুনিয়া থেকে আতংক শুরু হলেও এরকম একটি নেতিবাচক পরিস্থিতি থেকে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। সেটি হলো মানুষ আতংক থেকে সচেতন হয়েছে। আবার যেমন ধরন এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা। সেক্ষেত্রে করনিয় কি, কিভাবে প্রতিরোধ করা যেতে পারে এব্যাপারেও সাধারণ মানুষ বিশেষ করে মুরগীর খামারিরা এখন খোজ খবর জানেন। আবার যেমন ধরন গরুর অ্যানথ্রাক্স রোগ বাড়ার পর মানুষজন এখন গরুর টিকা দেয়। ইত্যাদি ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে”।
তবে প্রাণী ও কীট-পতঙ্গ বাহিত রোগ যতটা বাড়ছে মানুষ ততটা সজাগ হচ্ছে কিনা সেটি এখনো প্রশ্নবিদ্ধ।
আর বাংলাদেশ অনেক ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ হওয়ার কারণে মানুষে-পশুতে আর মানুষে-মানুষে সংস্পর্শ বড্ড বেশি। আর সেটি বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বিষয়ক ঝুঁকি এড়ানোর ক্ষেত্রে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।
সূত্র, বিবিসি বাংলা