ডেস্ক নিউজ : গদখালী বাজার থেকে দক্ষিণ দিকের পিচ ঢালা রাস্তার ধরে এগিয়ে গেলেই ডানে-বাঁয়ের গ্রামগুলোর দেখা মিলবে দিগন্ত জোড়া ফুলের ক্ষেত। যেদিকে চোখ যায় শুধু ফুল আর ফুল। ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে আছে গদখালী মাঠেগুলো। পথের দুই ধারে গোলাপ, রজনীগন্ধা, গ্ল্যাডিওলাস, গাঁদা, জারবেরা ফুলের ক্ষেত। বাতাসে ফুলের মিষ্টি সৌরভ, মৌমাছির গুঞ্জন এখানে শোনা যায়। ফুলের কতই না তার রং! লাল, নীল, হলুদ,গোলাপী, বেগুনি আর সাদা রঙের এক বিস্তীর্ণ বিছানা যেন বিছিয়ে রেখেছে । মাঠের পর মাঠজুড়ে ফুলের ক্ষেত। চোখ জুড়ানোর পাশাপাশি জুড়িয়ে যায় হৃদয়ও। ফুলই এখানে অর্থকারী ফসল। দেশে উৎপাদিত ফুলের ৭০ ভাগ যোগান হয় এখান থেকে। ফুলের রাজধানী বলে খ্যাত এই গদখালী। যেখানে গেলে চোখে পড়বে কৃষকদের ব্যস্ততা। কেউ ফুল কেটে বাজারে নিয়ে যাচ্ছে, সেখান থেকেই বান্ডিল করে চালান হয়ে যাচ্ছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে। পুরুষদের পাশে নারীও কাজ করছে ফুলের ক্ষেতে। কেউ ফুল কাটছে, কেউ নিড়ানি দিচ্ছে। । বছরের এই সময়টাতে ফুলের বিকিকিনির ধুম পড়ে যায়। এ বারের বসন্তবরণ, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস এবং ভাষাশহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বিক্রির লক্ষ্য ৪৫ কোটি টাকা।
প্রস্তুত গদখালী
বসন্তবরণ, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস এবং ভাষাশহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে সামনে রেখে মহাব্যস্ত সময় পার করছেন দেশে ফুল উৎপাদনের প্রধান জোন যশোরের গদখালীর চাষিরা। সময়মতো পর্যাপ্ত ফুল পেতে গাছ পরিচর্যায় ব্যস্ত তারা। আবহাওয়া অনুকূল থাকলে এ তিন দিবসে দেশের চাহিদা পূরণ করতে পারবেন তারা। এবার বিক্রি ৪৫ কোটি টাকার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন তারা।
যশোর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে যশোর- বেনাপোল মহাসড়কের পাশের জনপদ গদখালী। এখন থেকেই দেশজুড়ে ফুলের সরবরাহ যায়। ১৩ ফেব্রুয়ারি পয়লা ফাল্গুন- বসন্তবরণ। পরদিন ভ্যালেন্টাইনস ডে বা বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। এ দুটি দিবসে প্রিয়জনের মন রাঙাতে চান তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সীরা। প্রিয়জনের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশে ফুলই শ্রেষ্ঠ।
মানুষের মনের খোরাক মেটাতে গদখালীর চাষিরা এখন দিনরাত পরিশ্রম করছেন। ফুল নিদিষ্ঠ সমযে ফোটাতে গোলাপের কুড়িতে পরিয়ে রাখছেন ‘ক্যাপ’। ফলে বসন্ত উৎসব, ভালোবাসা দিবস আর ২১ ফেব্রুয়ারিতে ফুল বাজারে দেয়া নিশ্চিত হয়েছে। বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে গোলাপ, গাঁদা, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাসসহ নানা রঙের ফুল। চোখ ধাঁধানো এই সৌন্দর্য কেবল মানুষের হৃদয়ে প্রশান্তিই আনে না, ফুল চাষ সমৃদ্ধিও এনেছে অনেকের জীবনে। ইতিমধ্যে বসন্ত উৎসব আর ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে রাজধানীসহ দেশের বড় শহরগুলো ফুলের চালান যাওয়া শুরু হয়ে গেছে। গদখালী বাজারে এখন জারবেরার স্টিক বিক্রি হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ টাকায়, রজনীগন্ধা ২-৩ টাকায়, গোলাপ রং ভেদে ৫-১৫ টাকায়, গ্ল্যাডিওলাস ৩-১০ টাকায়, এক হাজার গাঁদা মিলছে ৫৫০-৬০০ টাকায়।
গদখালি ফুলচাষি কল্যাণ সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক রনি আহম্মদের মতে, গত বছর এই মৌসুমে ২৫ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছিল। এবার তা গিয়ে ঠেকতে পারে ৪০ থেকে ৪৫ কোটিতে। তবে রনির এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমতও আছে অনেকের।
রনি জানান, ভ্যালেন্টাইনস ডেতে রঙিন গ্লাডিওলাস, জারবেরা, রজনীগন্ধা ও গোলাপ বেশি বিক্রি হয়। আর গাঁদা বেশি বিক্রি হয় একুশে ফেব্রুয়ারি ও বসন্ত উৎসবে। প্রতিদিন চাষি, পাইকার ব্যবসায়ীদেও হাঁকডাকে মুখর হয়ে উঠছে গদখালীর ফুলের বাজার। পাইকারদেও কেনা ফুল সকালথেকেই বিভিন্ন রুটের বাসের ছাদে স্তুপ করে সাজানো হচ্ছে, পাঠানো হচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো বড় শহরে ট্রাক-পিকআপ ভ্যান ভরে ফুল যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
ফুলচাষি হাফিজা খাতুন হ্যাপি বলেন, ‘সারাদেশে বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে যে ফুল বেচা কেনা হয় তার ৭০ শতাংশই যশোরে উৎপাদিত। তবে এবারের ভালোবাসা দিবসে ফুলের যেমন উৎপাদন বেশি, তেমনি চাহিদা অন্য যেকোনো বারের তুলনায় বেশি। তাই শহর-নগরের ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী আমরা ফুলের অর্ডার নিচ্ছি।’
ফুলচাষি আজগর আলী জানান, এবার তিনি ১০ বিঘা জমিতে গোলাপ, জারবেরা, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস চাষ করেছেন। আবহাওয়া ভালো থাকায় বেশি ফুল এসেছে। ফলে পাঁচ-ছয় লাখ টাকা ঘরে তুলতে পারবেন বলে আশা করছেন তিনি। স্থানীয় ক্ষুদ্র পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, সামনে ভ্যালেন্টাইন ডেতে ফুল বিক্রি বেশি হবে। বাজারে জারবেরা, গোলাপ, রজনীগন্ধা ফুলের চাহিদা বেশি।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম এবার বিক্রি ৪৫ হবে কোটি টাকার বলে আশা করছেন।
তিনি বলেন, ‘এবার ফুলের উৎপাদন, চাহিদা ও দাম সবই বেশ ভালো। এ অঞ্চলের ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীরা সবাই খুশি।
ফুল চাষেই জীবন-জীবিকা
দেশের ফুলের চাহিদার ৭০ ভাগ সরবরাহ করেন যশোরের ফুল চাষিরা। যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলা ও আশপাশের এলাকায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমিতে ফুল চাষ করছেন প্রায় ছয় হাজার চাষি। যশোর জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী এখানে প্রতি বছর ১২০ কোটি পিস ফুল উৎপাদন হয়ে থাকে। ফুল চাষের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৫০ হাজার লোক জড়িত। ফেব্রুয়ারি মাসের তিনটি দিবসে ৪০ থেকে ৪৫ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে বলে ব্যবসায়ীদের দাবি। যা দেশের অর্থনীতিতে রাখছে বড় ধরনের ভূমিকা। ফুল যশোরের গদখালী চাষিদের আয়ের প্রধান উৎস। ফুল চাষ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করেন। ফুলচাষি আতিয়ার গাজী জানান, এবার তিনি গোলাপ, জবা, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাসের পাশাপাশি জারবেরার চাষ করেছেন। আবহাওয়া ভালো থাকায় বাগানে ফুল ভাল হয়েছে। খরচ বাদে লাখ দুয়েক টাকা লাখ টাকা ঘরে তুলতে পারবেন বলে আশা তার। তিনি জানান, ফুল যশোরের গদখালী চাষিদের আয়ের প্রধান উৎস। ফুল চাষ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করেন।
এ বারের নতুন অতিথি ডার্স রোজ
আর এ বছর গদখালীর ফুলের মাঠে নতুন অতিথি ডার্স রোজ। যা স্থানীয় চাষিদের কাছে লং ষ্টিক রোজ নামে পরিচিতি লাভ করেছে। কেবল গদখালীতেই নয়, বাংলাদেশেই এই প্রথমবারের মতো গোলাপের এ জাতটির চাষ শুরু বলে জানান বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম। কেবল গদখালীতেই নয়, বাংলাদেশেই এই প্রথমবারের মতো গোলাপের এ জাতটির চাষ শুরু করেছেন গদখালী এলাকার ইমামুল হোসেন, যা ইতিমধ্যেই বাজারে উঠতে শুরু করেছে।
ইমামুল জানান, ভারতের পুনে থেকে চারা এনে ৪০ শতক জমিতে তিনি লং স্টিক রোজের চাষ করেছেন। চারা কেনা,শেড তৈরি, পরিচর্যাসহ এ পর্যন্ত এই খেতের পেছনে তার ব্যয় হয়েছে আট লাখ টাকা। এরই মধ্যে কয়েকদফা ফুল বাজারে বিক্রি করেছেন। এ ফুল বিক্রি করে এক বছরের মধ্যেই তার সব বিনিয়োগ উঠে আসবে বলে জানান তিনি। ঠিকমতো পরিচর্যা করলে এই খেত থেকে একটানা ১০ বছর ফুল পাওয়া যাবে। ইমামুল এই জাতের গোলাপের বিশেষত্ব সম্পকে বলেন, অন্য জাতের গোলাপ ফুল গাছ থেকে তোলার পর যেখানে ৪-৫ দিনের বেশি রাখা যায় না, সেখানে লং স্টিক গোলাপ দুই সপ্তাহ পর্যন্ত রাখা যায়। এর স্টিক বেশ শক্ত এবং লম্বা হয়, ফলে সহজে ভেঙে যায় না। ফুলের পাপড়িগুলোও বেশ শক্ত। এসব কারণে অন্য জাতের গোলাপ যেখানে ৩ থেকে ৪ টাকায় বিক্রি হয়, সেখানে লং স্টিক রোজ বিক্রি হচ্ছে ১২ টাকায়।
ফুল চাষে নারীরাও
পুরুষের পাশাপাশি গদখালী এলাকায় ফুল চাষে এগিয়ে আসছেন নারীরাও। গদখালী এলাকায় শতাধিক নারী এখন সরাসরি ফুল চাষের সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া ফুল প্যাকেজিং, গ্রেডিং ও মালা গাঁথার সঙ্গে আরও তিন শতাধিক নারী কাজ করছেন। সফলতার উদাহরণও তৈরি করছেন তারা। এমনই একজন হ্যাপি। অষ্টম শ্রেণি পাস হ্যাপি ২০০১ সালে ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ১০ কাঠা জমিতে ফুল চাষ শুরু করেন তিনি। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। এখন তিনি ১০ বিঘা জমিতে নানারকম ফুলের চাষ করছেন। ভারত ও কম্বোডিয়া থেকে ফুল চাষের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, গদখালী এলাকায় হ্যাপির মতো শতাধিক নারী এখন সরাসরি ফুল চাষের সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া ফুল প্যাকেজিং, গ্রেডিং ও মালা গাঁথার সঙ্গে আরও তিন শতাধিক নারী কাজ করছেন।
সহজ শর্তে ঋণ ও নীতিমালা প্রয়োজন
ফুল চাষে আরও বেশি উৎসাহিত করতে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা দরকার বলে মনে করেন বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম। তিনি বলেন, জারবেরা ফুল চাষের জন্য শেড নির্মাণ, চারা ক্রয়, সার, সেচ, পরিচর্যায় প্রতি বিঘায় খরচ হয় ৮ থেকে ৯ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বও থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত চারা রোপণ করা যায়। তিন মাস পর থেকেই ফুল বিক্রি শুরু করা যায়। ফুল চাষে লাভ আছে তবে প্রযোজন মূলধনের। তাই সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা হলে চাষির সংখ্যা আরও বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম, ১৯৮২ সালে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালীতে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে ফুলচাষ শুরু হয়। গদখালী এলাকার মাটি ফুল চাষের উপযুক্ত ও অর্থনৈতিকভাবে ধান-পাটের থেকে বেশি লাভজনক। তাই এ এলাকার প্রধান অর্থকারী ফসল এখন ফুল। তিনটি বিশেষ দিবসে বিক্রি ৪০ কোটিতে ছাড়িয়ে যাবে। তিনি বলেন, গদখালীতে উৎপাদিত ফুল আন্তজাতিক মানের। সৌদিআরব, কাতার, দুবাই, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ আরও বেশকিছু দেশে এসব ফুল রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। এখন সবজি ও পানের সঙ্গে অল্পকিছু ফুল রপ্তানি হয়। তিনি বলেন, ফুল রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকার যদি আলাদা নীতিমালা করে তাহলে ফুল রপ্তানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।
ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ফুল চাষে সংশ্লিষ্ট নারীদের উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের সহায়তা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রেও নারীদের বিশেষভাবে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, এ অঞ্চলে সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমিতে ৫০০ ফুলচাষি বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ করেছেন। বর্তমানে এটি ‘ফুলের রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত। এবার আবহাওয়া ভাল থাকায় ফুলের উৎপাদন বেশি হয়েছে। বিদায়ী ২০১৭ সালে শুধু গদখালি থেকে ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকার ফুল বেচাকেনা হয়। এবছর তা অতিক্রম করবে বলে আশা করা হচ্ছে। ফুল চাষকে লাভজনক করে তুলতে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে নানা সহায়তা দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত