অগ্রদৃষ্টি-ডেস্ক: গরিবের চিকিৎসক খ্যাত ডা. এড্রিক বেকার চলে গেলেন না ফেরার দেশে। ৭৪ বছর বয়সী বেকার মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে মধুপুর গড়ে প্রতিষ্ঠিত নিজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে মধুপুর গড়ের গরিব-দুঃখীসহ সর্বস্তরের মানুষের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে। গতকাল তার প্রতিষ্ঠিত কাইলাকুড়ি হাসপাতালের পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অবিবাহিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, ১৯৭৯ সালে তিনি বাংলাদেশে আসেন। এরপর ৩৬ বছর যাবৎ মধুপুর গড় এলাকায় অবস্থান করে দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে রাখেন। ১৯৪১ সালে নিউজিল্যান্ডের রাজধানী ওয়েলিন্টনে এড্রিক বেকারের জন্ম। তার বাবা ছিলেন পরিসংখ্যানবিদ। মা বেট্রি বেকার শিক্ষক। চার ভাই, দুই বোনের মধ্যে দ্বিতীয় এড্রিক ডুনিডেন শহরের ওটাগো মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ওয়েলিন্টনে ইন্টার্নি শেষে নিউজিল্যান্ড সরকারের সার্জিক্যাল টিমে যোগ দিয়ে চলে যান যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনামে। সেখানে কাজ করেন ’৭৫ সাল পর্যন্ত। মাঝে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডে পোস্ট গ্রাজুয়েশন কোর্স করেন ট্রপিক্যাল মেডিসিন, গাইনী, শিশুস্বাস্থ্য বিষয়ে। ’৭৬ সালে পাপুয়া নিউগিনি ও জাম্বিয়ায় যান। কিন্তু কোথাও মন টেকেনি তার। এরই মধ্যে জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে চলে যান যুক্তরাজ্যে। এক বছর পর সুস্থ হয়ে ’৭৯ সালে চলে আসেন বাংলাদেশে।
এদেশে এসে এড্রিক বেকার প্রথমে মেহেরপুর মিশন হাসপাতালে প্রায় দু’বছর ও পরে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালে ৮ মাস কাজ করেন। বেকারের বড় কোন হাসপাতালে কাজ করার ইচ্ছে কখনও ছিল না। ইচ্ছে ছিল প্রত্যন্ত গ্রামে কাজ করার। অন্যরকম কিছু করার। সে চিন্তা থেকেই চলে আসেন টাঙ্গাইলের মধুপুর পাহাড়ি গড় এলাকায়। তখন সাধারণ মানুষের মাঝে কাজ করতে গিয়ে বুঝতে পারেন ভাষা শিক্ষা নেয়া দরকার। তাই মধুপুরের জলছত্র খ্রিষ্টান মিশনে এক বছর থেকে বাংলা ভাষা শিখেছেন। তারপর যোগ দেন গড় এলাকার থানারবাইদ গ্রামে। চার্চ অফ বাংলাদেশের একটি ক্লিনিকে। সেই থেকে প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান করে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দিতে শুরু করেন ডা. বেকার। ’৮৩ সালে দুজন খণ্ডকালীন এবং তিনজন সার্বক্ষণিক কর্মী নিয়ে বেকারের যাত্রা শুরু হয়। দিনদিন বাড়তে থাকে রোগীর সংখ্যা। তখন থানার বাইদের পাশের গ্রাম কাইলাকুড়িতে ১৯৯৬ সালে উপকেন্দ্র খুলে চিকিৎসা সেবা দেয়া শুরু করেন। ২০০২ সালে একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য কেন্দ্র হিসেবে মধুপুরের কাইলাকুড়িতে কাজ শুরু হয়। বর্তমানে সেখানে ৯৩ জন গ্রামীণ দরিদ্র যুবক-যুবতীকে প্রশিক্ষিত করে চালিয়ে যাচ্ছিলেন এ স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম।
টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় কাইলাকুড়ি গ্রামের অবস্থান। এলাকার আদিবাসী-বাঙালি প্রায় সবাই দরিদ্র। এ রকম একটি প্রত্যন্ত এলাকায় চার একর জায়গার উপর ডা. এড্রিক বেকারের স্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। ছোট ছোট মাটির ২৩টি ঘরে হাসপাতালের ডায়াবেটিস বিভাগ, যক্ষ্মা বিভাগ, মা ও শিশু বিভাগ, ডায়রিয়া বিভাগসহ আলাদা আলাদা বিভিন্ন বিভাগে ৪০ জন রোগী ভর্তির ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে আগত রোগীদের সবাই দরিদ্র। তবে এখানে টাকা উপার্জনকারী সচ্ছল ও বড়লোক রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয় না। এখানে বহির্বিভাগে প্রতিদিন প্রায় একশ’ জন রোগী দেখা হয়। এ ছাড়া হাসপাতালে নিচের পক্ষে ৪৫ জন রোগী সবসময় ভর্তি থাকে।