ভারতে গঙ্গা চুক্তির ২০ বছর পূর্তিতে এটিকে একটি কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে বর্ণনা করা হলেও দু’দেশের কেউই যে প্রত্যাশিত পরিমাণে জল পায়নি, সেই বাস্তবতাও কিন্তু স্বীকার করা হচ্ছে।
এই চুক্তিকে ভারত-বাংলাদেশ সুসম্পর্কের এক দারুণ নিদর্শন হিসেবে দেখা হয়ে এসেছে।
এমন কী প্রস্তাবিত তিস্তা চুক্তিও অনেকটা একই মডেলে করার চেষ্টা হয়েছে বা হচ্ছে।
তবে পাশাপাশি এটাও ঠিক – এই চুক্তির মাধ্যমে কলকাতা বন্দরকে পুনরুজ্জীবিত করার স্বপ্নও কিন্তু সফল হয়নি।
আর চুক্তিতে যার ভিত্তিতে জল ভাগাভাগির অঙ্কটা কষা হয়েছিল, বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন গলদ ছিল সেই পরিসংখ্যানেই।
ভারত মনে করে গত ২০ বছরে গঙ্গা চুক্তির বাস্তবায়ন হয়েছে মোটামুটি মসৃণভাবেই।
কখনও বড় কোনও আপত্তি ওঠেনি চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দু’পক্ষের কারও কাছ থেকেই।
তা ছাড়া এই চুক্তির পর ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিবাদও অনেকটাই স্তিমিত হয়ে গেছে বলে তাদের মূল্যায়ন।
সুতরাং কূটনৈতিক দিক থেকে এই চুক্তি অবশ্যই সফল বলে ভারতের অভিমত, তবে জলের ভাগ নিয়ে দু’দেশের কেউই যে ঠিক সন্তুষ্ট নয় সেটাও কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না।
নদী-বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র মনে করেন, যে পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে চুক্তিটা করা হয়েছিল – আসলে অসঙ্গতি ছিল তার ভেতরেই।
তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, “যে পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে এই চুক্তিতে ভাগাভাগির হিসেবটা কষা হয়েছিল – যেটা হল ১৯৪৯ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত এই ৪০ বছরে ফারাক্কায় গঙ্গায় জলের পরিমাণ – সেই হিসেবেই একটা গলদ ছিল।”
“গলদটা এই জন্য ছিল যে ১৯৯৬ সালে যখন চুক্তিটা সই হচ্ছে, তখন কিন্তু ৫০ বা ৬০-এর দশকের তুলনায় গঙ্গায় জলের প্রবাহ অনেক কমে গেছে – নতুন নতুন নানা সেচ বা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে। ঠিক এই কারণেই চুক্তিতে যাই বলা থাক – বিশেষ করে শুখা মরশুমে নদীতে প্রবাহের বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ অন্য রকম”, বলছিলেন ড: রুদ্র।
বস্তুত উত্তরপ্রদেশ বা বিহারের মতো গঙ্গার উজানের রাজ্যগুলোতে যেভাবে একের পর এক জলবিদ্যুৎ বা সেচ প্রকল্প নির্মিত হয়েছে, তাতে ভাঁটির হুগলী বা পদ্মায় জলের প্রবাহ কমছে বছরের পর বছর ধরেই।
পশ্চিমবঙ্গের বহু বছরের পার্লামেন্টারিয়ান মহম্মদ সেলিম বলছিলেন, এমন কী ‘৯৬ সালে গঙ্গা চুক্তি সই হওয়ার আগেও এই রাজ্যগুলোর দিক থেকে পার্লামেন্টে তীব্র বাধা দেওয়া হয়েছিল।
তিনি জানাচ্ছেন, “চুক্তির আগে যখন রাজ্যসভায় এ নিয়ে বিতর্ক হয়, তখন ওই সব রাজ্যের এমপি-রা অনেকেই বলেছিলেন আমরা না কি বাংলাদেশকে বেশি দরদ দেখাচ্ছি। জবাবে আমি তখন বলেছিলাম, গঙ্গোত্রী থেকে ফারাক্কা পর্যন্ত তোমরা গঙ্গা নিয়ে যা করছ সেটা আগে দেখ, ফারাক্কা থেকে বাকিটা বরং আমরা বুঝে নেব।”
বস্তুত পর্যবেক্ষকরা অনেকেই মনে করেন, ভারতের ভেতরেও অনেকের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও মূলত পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর রাজনৈতিক সদিচ্ছাতেই এই চুক্তিটি সম্ভব হয়েছিল।
তিনি দুই প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে চুক্তিটি স্বাক্ষর করাতে পেরেছিলেন ঠিকই – কিন্তু নিজের রাজ্যের কলকাতা বন্দরকে কিন্তু বাঁচাতে পারেননি।
মাত্র কয়েক মাস আগেই ভাগীরথীর ফিডার ক্যানেল সম্পূর্ণ শুকিয়ে যাওয়ায় সেই পথে কয়লাবাহী বার্জ একেবারেই চলতে পারছিল না – ফলে ফারাক্কায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র পর্যন্ত সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে হয়েছিল।
যা থেকে বোঝা যায় গঙ্গা চুক্তি ভারতের দিকেও জলের প্রবাহ বিশেষ বাড়াতে পারেনি।
চুক্তির খসড়া তৈরিতে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন, এমন এক ভারতীয় কূটনীতিক তাই বলছেন – “এই চুক্তি অভাবের সংসারে দুই শরিকের মধ্যে হয়তো শান্তি আনতে পেরেছে, কিন্তু প্রাচুর্য আনতে পারেনি কোনও তরফেই।”
সূত্র, বিবিসি