ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণ কমানোর একটা সহজ পথ বের করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ঋণ অবলোপন (রাইট অফ) নীতিমালায় শিথিলতার মাধ্যমে এ সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ অবলোপনের নীতিমালায় যে সংশোধন এনেছে, তাতে ব্যাংকগুলো এখন মাত্র তিন বছরের মন্দ মানের খেলাপি ঋণ ব্যালেন্স শিট থেকে বাদ দিতে পারবে।
এতে খেলাপি ঋণ আদায় না হলেও তা কাগজ-কলমে কমবে।
এতদিন কোনো ঋণ মন্দ মানে শ্রেণিকৃত হওয়ার পাঁচ বছর পার না হলে তা অবলোপন করা যেত না।
অন্যদিকে অবলোপনের জন্য এখন আর আগের মতো শতভাগ প্রভিশন লাগবে না। আবার দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ অবলোপনে মামলা করতে হবে না। এতদিন মামলা না করে অবলোপন করা যেত ৫০ হাজার টাকা।
বছরের পর বছর ধরে ব্যাংক ব্যবস্থায় মন্দ মানে শ্রেণিকৃত খেলাপি ঋণ স্থিতিপত্র (ব্যালেন্স শিট) থেকে বাদ দেওয়াকে ঋণ অবলোপন-রাইট অফ বলে। যদিও এধরনের ঋণ গ্রহীতা পুরো টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত খেলাপি হিসেবে বিবেচিত হন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার আলোকে ২০০৩ সাল থেকে ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন করে আসছে।
ক্ষুদ্র ঋণে মামলার খরচের চেয়ে অনেকাংশে বকেয়া ঋণের পরিমাণ কম হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ২০১৩ সালে মামলা না করেই ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ অবলোপনের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা শিথিলের এ সিদ্ধান্তের ফলে এক ধাক্কায় খেলাপি ঋণ অনেক কমে আসবে।
আ হ ম মুস্তাফা কামাল অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই খেলাপি ঋণ কমানোর বিষয়ে সরব। বুধবার রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের এক অনুষ্ঠানেও খেলাপি ঋণ কমানোর কথা বলেন তিনি।
এরই মধ্যে এ নিয়ে ঋণ অবলোপন নীতিমালা শিথিল করা হল।
নীতিমালার এই শিথিলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বুধবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাইট অফ ব্যাংকিং খাতের একটি আন্তর্জাতিক পদ্ধতি। হঠাৎ করেই নীতিমালায় কেন শিথিল করা হল বা পরিবর্তন আনা হল, সেটা নিয়েই প্রশ্ন।
“যদি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে তিন বছরের জায়গায় পাঁচ বছর করাসহ অন্যন্য পরিবর্তন করা হয়ে থাকে, সেটা একটা বিষয়। আবার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনেই করা হয়ে থাকে; তাহলে এখন কেন? এতদিন করা হয়নি কেন?”
কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কমানোর জন্যই যদি নীতিমালায় পরিবর্তন আনা হয়ে থাকে তাহলে তা ‘খুবই দুঃখজনক’ বলে মন্তব্য করেন আহসান মনসুর।
নতুন নীতিমালায় বলা হয়, যে সব ঋণ হিসাবের বকেয়া দীর্ঘদিন আদায় বন্ধ রয়েছে, নিকট ভবিষ্যতে আদায়ের সম্ভাবনাও নেই এবং যে সব ঋণ একাদিক্রমে ৩ বছর মন্দমানে খেলাপি হিসেবে রয়েছে এরূপ ঋণ হিসাব ব্যাংকগুলো অবলোপন করতে পারবে।
পাশাপাশি ব্যাংক নিজস্ব বিবেচনায় মৃত ব্যক্তির নিজ নামে অথবা তার একক মালিকানাধিন প্রতিষ্ঠানের নামে গৃহীত ঋণ শ্রেণিমান নির্বিশেষে ও অর্থঋণ আদালত আইন-২০০৩ অনুযায়ী মামলাযোগ্য না হলে মামলা না করেই অবলোপন করতে পারবে। তবে একক মালিকানাধিন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির উপার্জনক্ষম উত্তরসূরী রয়েছে কিনা তা বিবেচনায় নিতে হবে।
এক্ষেত্রে ঋণ অবলোপনের অন্যান্য সকল নির্দেশনা অনুসরণীয় হবে। অবলোপনযোগ্য ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের অনুকূলে বন্ধকীকৃত সম্পত্তি নিয়মানুগভাবে বিক্রির প্রচেষ্টা গ্রহণ এবং ব্যাংকে নিশ্চয়তা প্রদানকারী ব্যক্তিদের নিকট হতে পাওয়া অর্থ আদায়ে সমর্থ না হলে সেই ঋণ অবলোপনের আওতায় আসবে।
অবলোপনের জন্য নির্বাচিত ঋণ হিসাবগুলোর ক্ষেত্রে পূর্বে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়ে থাকলে অবলোপনের পূর্বে অবশ্যই অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে। তবে ক্ষুদ্র অংকের ঋণের ক্ষেত্রে মামলা দায়েরের খরচ বেশি হওয়ায় ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণের ক্ষেত্রে মামলা দায়ের ছাড়াই অবলোপন করা যাবে। আগে মামলা ছাড়াই ৫০ হাজার টাকার কম অঙ্কের ঋণ অবলোপনের সুযোগ রাখা হয়েছিল।
নীতিমালা অনুযায়ী, অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের জন্য প্রত্যেক ব্যাংকে পৃথক ডেট কালেকশন ইউনিট গঠন করতে হবে। এছাড়া অবলোপকৃত ঋণ হিসাবের বিপরীতে দায়েরকৃত মামলা দ্রুত নিস্পত্তির লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং অবলোপনকৃত ঋণের বিপরীতে প্রাপ্য অর্থ আদায়ের জন্য প্রয়োজনে তৃতীয় পক্ষ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে নিয়োজিত করা যাবে।
অবলোপনকৃত ঋণের হিসাব পৃথক লেজারে সংরক্ষণ করতে হবে এবং ব্যাংকের আর্থিক বিবরণীতে ব্যাংক কোম্পানি আইনের আওতায় রিপোর্ট করতে হবে। কোন অবস্থাতেই অবলোনকৃত ঋণ পুনঃতফসিল বা পুনর্গঠন করা যাবে না।
খেলাপিঋণ গ্রহীতার ঋণ অবলোপন হলেও সংশ্লিষ্ট গ্রহীতা তার সম্পূর্ণ পরিশোধ না করা পর্যন্ত খেলাপি ঋণগ্রহীতা হিসেবে চিহ্নিত হবেন। ব্যাংকের পরিচালক কিংবা সাবেক পরিচালক এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া অবলোপন করা যাবে না।
এছাড়া অবলোপনকৃত ঋণের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবিতে যথারীতি রিপোর্ট করতে হবে।
অবলোপনের আগে বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রি বা গ্যারান্টার থেকে পাওনা আদায়ের চেষ্টা করতে হবে। আর সংশিম্লষ্ট ঋণ থেকে স্থগিত সুদ বাদ দেওয়ার পর অবশিষ্ট স্থিতির সমপরিমাণ প্রভিশন রাখতে হবে। আগে পুরো দায়ের বিপরীতে প্রভিশন করতে হতো। তবে আগের মতোই পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৯ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দ মানের খেলাপি ঋণ ৮২ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট খেলাপি ঋণের ৮৩ দশমিক ১৬ শতাংশই মন্দ মানের।
এছাড়া ২০০৩ সাল থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো ৪৯ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করেছে। অবলোপন করা এসব ঋণের মধ্যে আদায় হয়েছে ১১ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা। এতে অবলোপন করা ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩৭ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা।
অবলোপন করা ঋণ হিসাবে নিলে ব্যাংক খাতে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩৭ হাজার ২৩৭ কোটি টাকা। মোট ঋণের যা ১৫ দশমিক ৮১ শতাংশ।
যদিও অবলোপনের ঋণ হিসাবে না আসায় খেলাপি ঋণ দেখানো হয়েছে ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
সূত্র, বিডিনিউজ২৪.কম