ধর্মদর্শন ডেস্ক: আমাদের নিঃশ্বাস, আমাদের বিশ্বাস, আমাদের শক্তি এবং আমাদের প্রেরণা সব কিছুর মূলে যে জিনিসগুলো অবস্থান করছে সেগুলো মাত্র ছয়টি। এ ছয়টি জিনিসের উপরই মানবজাতির পরলৌকিক জীবনের চুড়ান্ত মুক্তি নির্ভর করছে। এগুলোকে বলা হয় ’আরকানুল ঈমান’-মানে ঈমানের স্তম্ভ। এর মাধ্যমেই মুসলমান ও অমুসলামের মাঝে পার্থক্য রচিত হয়। এগুলোর বুঝার ক্ষেত্রে ত্রুটি থাকলে মুসলমানের দেহ সত্বায় ঘাটতি সৃষ্টি হয়। এখানে খুব অল্প কথায় এ বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে।
১) আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসঃ
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “(হে নবী!) বলুন, আমার নামায, আমার কুরবাণী, আমার জীবন ও মৃত্যু বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য নিবেদিত। তার সাথে অন্য কেউ অংশিদার নেই। এ জন্যই আমি নির্দেশ পেয়েছি এবং এতে আমি সর্বপ্রথম আত্মসমর্পণ করছি।”(সূরা আনআমঃ ১৬২ ও ১৬৩)
ইসলাম হল তাওহীদ ভিত্তিক জীবন ব্যবস্থার নাম। ইসলাম ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী খৃষ্টানদের এবং দিত্তবাদে বিশ্বাসী অগ্নিপূজকদের প্রতিবাদ করে। ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয়, আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। এ বিশ্বলোকের রাজত্ব এবং পরিচালনায় তাঁর কোন অংশিদার নেই। তিনি অগণিত সুন্দর সুন্দর নাম ও গুণাবলীর অধিকারী। তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। আল্লাহ বলেনঃ
“(হে নবী) বলুন, তিনি আল্লাহ এক। আল্লাহ অমুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাকে জন্ম দেয়নি এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই। (সূরা ইখলাস)
২) ফেরেশ্তাদের প্রতি বিশ্বাসঃ আল্লাহ তা’আলা ফেরেশ্তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদাত এবং আনুগত্য করার জন্য। তারা নবীদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে দূত হিসেবে আগমন করতেন। সে সকল ফেরেশ্তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জিবরাঈল (আলাইহিস সালাম)। যিনি ওহীর দায়িত্ব প্রাপ্ত। যিনি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট ওহী নিয়ে আগমন করতেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, মিকাঈল (আঃ) যিনি বৃষ্টি বর্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত। আরেকজন হচ্ছেন, মালাকুল মাউত। যিনি মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর আত্মহরণের দায়িত্বে নিযুক্ত। ফেরেশ্তাগণ আল্লাহর সম্মানিত বান্দা। সুতরাং তাদের প্রতি আমাদের সম্মান প্রদর্শন করা কর্তব্য। তাদের ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই ভাল মন্তব্য করতে হবে। কিন’ তাদেরকে আমরা মাবুদ বা উপাস্যের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারিনা বা তাদেরকে আল্লাহর পুত্র কিংবা কন্যা সাব্যস্ত করতে পারিনা যেমনটি অনেক অমুসলিম ধারণা করে থাকে। তারা আল্লাহর এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। আমরা সেই আল্লাহর এবাদত করি যিনি ফেরেশ্তাগণকে এমন বিস্ময়কর পদ্ধতিতে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
“তারা বলে, দয়াময় আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন। বরং তিনি পবিত্র! তিনি মহান! (প্রকৃতপক্ষে) তারা (ফেরেশ্তাগণ) তো সম্মানিত বান্দা। তারা আল্লাহর আগে বেড়ে কোন কথা বলেন না এবং তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে থাকেন। তাদের সামনে এবং পেছনের সব খবর আল্লাহ জানেন। তারা কেবল ঐ সব লোকদের শুপারিশ করবেন যাদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ সম্মত। তারা আল্লাহর ভয়ে প্রকম্পিত থাকেন। তাদের মধ্যে যে বলবে, আল্লাহ নয় বরং আমিই ইবাদতের হকদার তাহলে এজন্য তার বিনিময় হবে জাহান্নাম। অত্যাচারীদেরকে আমি এভাবেই বদলা দিয়ে থাকি।” (সূরা আম্বিয়াঃ ২৯)
৩) আসমানী গ্রন্থ সমূহের উপর বিশ্বাসঃ আল্লাহ তা’আলা রাসূলগণের নিকট আসমানী কিতাব অবতীর্ণ করেছেন যেন তারা মানুষের নিকট সেগুলো ব্যাখ্যা সহকারে বর্ণনা করে শুনায়। এসব কিতাব মূলতঃ আল্লাহ তা’আলার বাণী সমষ্টি। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর সহীফা সমূহ, মূসা এর উপর নাযিলকৃত কিতাব তাওরাত, দাঊদ এর নিকট নাযিলকৃত কিতাব যাবূর, ঈসা এর নিকট নাযিলকৃত কিতাব ইন্জিল এবং সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নকট নাযিলকৃত আল কুরআন। ইহুদীরা তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ তাওরাত এবং খৃষ্টানরা তাদের ধর্মীয়গ্রন্থ ইন্জিলের ভেতর পরিবর্তন-পরিবর্ধন করেছে। কিন্তু মহাগ্রন্থ আল কুরআন যেহেতু সর্বশেষ নাযিলকৃত আসমানী কিতাব তাই আল্লাহ তায়ালা তাকে পরবির্তন-পরিবর্ধণের হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করেছেন। এই কুরআন পূর্ববর্তী সকল কিতাবকে সত্যায়ন করে এবং সেগুলোর সংরক্ষক। অতএব, পূর্বের আসমানী কিতাবে যে বিষয়ই উল্লেখ করা হোক না কেন তা যদি কুরআনের বিপরীত হয় তবে নিশ্চিতভাবে ধরে নিতে হবে সেটা বিকৃত এবং পরির্তনের স্বীকার। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
“আমি তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছি সত্য বার্তা সহকারে যা পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব সমূহের সত্যায়নকারী এবং সেগুলোর সংরক্ষক । (সূরাঃ মায়েদাহঃ ৪৭) আল্লাহ তা’আলা কুরআনকে আরবী ভাষায় অবতীর্ণ করেছেন এবং তার এই সর্বশেষ আসমানী রেসালাতের বার্তাকে সব ধরণের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন থেকে সংরক্ষণ করেছেন।” আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
“আমি উপদেশ বাণী অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষণকারী।” (সূরা হিজ্রঃ ৯)
৪) রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাসঃ আমরা বিশ্বাস করি, মানবজাতিকে সঠিক পথের দিশা দেয়ার জন্য এবং তাদের নিকট রেসালাতের বাণী পৌঁছে দেয়ার মহান দায়িত্ব দিয়ে আল্লাহ তায়ালা মানুষের মধ্য থেকে কতিপয় নবী ও রাসূল নির্বাচিত করেছেন। আবার নবীদের মধ্যে থেকে নির্বাচিত করেছেন রাসূলগণকে। এসব রাসূলগণের নিকট নতুন শরীয়ত অবতীর্ণ করেছেন যেন তারা মানুষের নিকট তা পৌঁছে দেন এবং তাদেরকে দেন সঠিক পথের সন্ধান । সে সকল রাসূলের মধ্যে অন্যতম হলেন, নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা এবং মুহাম্মাদ (আলাইহিমুস সালাম)।ইসলম গ্রহণ করার অর্থ এই নয় যে, মূসা, ঈসা এবং অন্যান্য নবী রাসূলগণকে অস্বীকার করতে হবে। বরং পূর্ববতী সকল নবী-ও রাসূলের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা আমাদের ঈমানের মৌলিক দাবী। আল্লাহ তা’আলা কুরআনুল কারীমে কয়েকজন নবী ও রাসূলের নাম উল্লেখ করেছেন। তাদের সকলের প্রতি এবং তাদের নিকট অবতীর্ণ গ্রন্থের প্রতি সমানভাবে বিশ্বাস স্থাপন করতে আমরা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট। ইরশাদ হচ্ছেঃ
“ তোমরা বল, আমরা আল্লাহর প্রতি এবং যা আমাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে আর যা ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তাদের বংশধরের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল এবং মূসা ও ঈসা কে যা প্রদান করা হয়েছিল এবং অন্যান্য নবীগণ তাদের প্রভু হতে যা প্রদত্ব হয়েছিল সে সব কিছুর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করছি। তাদের মাঝে কাউকে আমরা পার্থক্য করিনা। এবং আমরা তাঁর নিকট আত্মসমর্পণকারী।” (সূরা বাক্বারাঃ ১৩৬)
৫) পরকালের প্রতি বিশ্বাসঃ আমরা বিশ্বাস করি এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহ তা’আলা যে সময় সীমা নির্ধারণ করে রেখেছেন তা শেষ হয়ে গেলে শুরু হবে আরেক নতুন জীবন। আল্লাহ তা’আলা একজন ফেরেশ্তাকে সিংগায় ফুঁ দেয়ার জন্য নির্ধারণ করে রেখেছেন। তিনি তাতে ফুঁ দেয়ার সাথে সাথে সমস্ত মানুষ মারা যাবে। আবার তিনি তাতে ফুঁ দিবেন। এই ফুঁ দেয়ার সাথে সাথে সব মানুষ কবর থেকে উঠে দাঁড়াবে। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে দুনিয়ায় কী কাজ করেছে তার হিসাব-নিকাশের জন্য হাশরের ময়দানে একত্রিত করবেন। যারা দুনিয়ায় আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছিল, তাঁর রাসূলকে অনুসরণ করেছিল, এবং ভাল কাজ করেছিল তাদেরকে পূরস্কার হিসেবে জান্নাত দান করবেন। সেখানে তারা অনন্তকাল ধরে মহা আনন্দ ও অনাবিল সুখ-সাচ্ছন্দে জীবন যাপন করবে। পক্ষান্তরে যারা আল্লাহ তা’আলাকে বিশ্বাস করেনি, তাঁর নবীর আদেশ-নিষেধ মেনে চলেনি, আল্লাহ তা’আলা প্রতিদান হিসেবে তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। সেখানে তারা অনন্তকাল ধরে নিদারুন কষ্ট ও অবর্ণনীয় শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
“আর যে সীমালঙ্ঘন করেছে, এবং দুনিয়ার জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, নিশ্চয়ই জাহান্নামই হবে তার ঠিকানা। পক্ষান-রে যে নিজ প্রতিপালকের সামনে দাঁড়ানোর ভয় করেছে এবং কুপ্রবৃত্তি হতে নিজেকে বিরত রেখেছে জান্নাতই হবে তার ঠিকানা।” (সূরা নাযি’আতঃ ৩৭-৪১)
৬) ভাগ্যের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাসঃ আমারা বিশ্বাস করি, আল্লাহ তা’আলার জ্ঞান এত সর্বময় এবং ব্যাপক যে তা কোন স্থান বা কালের ভিতর সীমাবদ্ধ নয়। প্রতিটি বিষয় সঠিকভাবে নিরূপন করা এবং তা বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে তিনি অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর রাজ্যের ভিতর তাঁর ইচ্ছা ব্যতীত কোন কিছুই সংঘটিত হয় না। তাঁর শক্তি, জ্ঞান এবং নির্দেশ সকল কালে ও সকল যুগে সমান ভাবে পরিবেষ্টিত। আল্লাহ তা’আলা অত্যন্ত ন্যায়পরায়ন এবং সৃষ্টিজীবের প্রতি তিনি পরম দয়ালু। প্রতিটি বিষয় অত্যন্ত প্রজ্ঞা ও হেকমত সহকারে যথোপযুক্ত ,পরিমিতভাবে সৃষ্টি করেছেন। এ বিষয়টি আমাদের মনে ও মগজে দৃঢ়ভাবে স্থাপিত হলে আল্লাহ তা’আলা যাবতীয় কাজ পরিপূর্ণ ঈমান সহকারে অবশ্যই আমাদেরকে গ্রহণ করতে হবে। যদিও আমরা তার মূলরহস্য পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারিনা অথবা ধারণা করি যে, এটি আমাদের স্বার্থের অনূকুলে নয়।
মহান আল্লাহ যেন আমাদের বিশ্বাসের ভীতকে আরও মজবুত করেন এবং সেই আলোকে তৈরি করে নিতে পারি আমাদের এই জীবনটাকে।তিনিই আমাদের সাহায্যকারী ও সকল কল্যাণ ও বরকতের একমাত্র মালিক।আল্লাহ্ পাক আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন !
লেখক :
ড. মোস্তফা কবীর সিদ্দিকী
সহকারী অধ্যাপক,
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ,
উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়,
ই-মেইল : mostafakabir_seu@ Yahoo.com