বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছরই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ প্রতিবেশী দেশ ভারতে যান বিভিন্ন কারণে। চিকিৎসা, শিক্ষা, ব্যবসা এবং ভ্রমণ- এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোক যান ভ্রমণ ভিসা নিয়ে। আর এ সংখ্যাটি প্রতিবছরই বাড়ছে।
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর হিসেবে চলতি বছরের এগারো মাসেই টুরিস্ট ভিসায় ভারতে যাওয়ার জন্য ৫৭ মিলিয়ন ডলার(৫কোটি ৭০ লাখ ডলার) বৈদেশিক মুদ্রা করা হয়েছে যা গত বছরের তুলনায় ১০ মিলিয়ন বেশি।
আর ঢাকায় ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভ্রমণ ভিসা নিয়ে যারা যাচ্ছেন তাদের একটা বড় অংশই যান ঈদের আগে এবং ভারতেই তারা ঈদের কেনাকাটা সেরে ফেলছেন।
ফলে বড় একটি ক্রেতা হারাচ্ছে বাংলাদেশের বাজার।
ভারতের পণ্যের প্রতি বাংলাদেশের ক্রেতাদের এই আগ্রহ কেন?
ঢাকার ফার্মগেট এলাকার বাসিন্দা ফারহানা ওয়ারিস। রোজার আগে আগে ভারতের কোলকাতায় গিয়েছিলেন পুরো পরিবার নিয়ে। সামনে ঈদ আর সেটা মাথায় রেখে কিনে এনেছেন বেশকিছু পোশাক। এর আগেও যতবার গিয়েছেন প্রতিবারই ভারতে ভ্রমণের পাশাপাশি বাড়তি আকর্ষণ থাকে কেনাকাটা।
তিনি বলেন, “দেশের কাপড়ের সাথে ভারতের কাপড়ের পার্থক্য প্রধানত দাম বেশি। ওদের কাজ ভাল, কালার কম্বিনেশন ভালো। ওখানকার পোশাক এনে বাংলাদেশে বিক্রি করে কিন্তু দাম রাখে দুইগুণের বেশি”।
কয়েকবার ভারতে গিয়েছেন ধানমন্ডী এলাকার ফাহমিদা মাহবুব। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম বাড়তি কী আকর্ষণ কোলকাতার বাজারে যেজন্য বাংলাদেশের বাজার ছেড়ে তারা ভারতে যাচ্ছেন?
ফাহমিদা মাহবুব উল্টো প্রশ্ন করেন, “একইসঙ্গে বেড়ানো এবং কেনাকাটা দুটোই করা যায়। তাহলে মানুষ কেন যাবে না।?”
তিনি বলেন, “দাম আর মান ছাড়াও আর একটা বড় ব্যাপার হল ব্যবহার। ভারতে যেকোনো দোকানে আপনি দুশো টাকার শাড়ি কিনলে একশোটা শাড়ি দেখাবে । কিন্তু বাংলাদেশের দোকানিদের মধ্যে সেটা নেই”।
তিনি বলেন “এখানে অনেকসময় বিক্রেতারা পোশাক পছন্দ না হলে ক্রেতারা ফিরে গেলে তখন অনেক আজে-বাজে কথা বলেন বিক্রেতারা, আমি নিজে দেখেছি”।
‘রমজানে দশজনের মধ্যে ৪জনই বাংলাদেশের কাস্টমার’
রমজান শুরুর আগ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার নিউমার্কেট এলাকাসহ এর আশপাশের বিপনীবিতানগুলোতে শুরু হয় বাংলাদেশি ক্রেতাদের ভিড়। আর এই সংখ্যাটা ঈদের আগ পর্যন্ত বাড়তে থাকে।
ভারতীয় দোকান মালিকেরা জানান, ঈদ এর একেবারে এক সপ্তাহ আগেই কোলকাতা থেকে কেনাকাটা চুকিয়ে বাংলাদেশীরা চলে আসেন। তারপরও রোজার শেষ সপ্তাহেও কোলকাতার নিউমার্কেটে দেখা মিলে যায় কেনাকাটা করতে আসা লোকজনের। কোলকাতায় বিবিসি বাংলার প্রতিনিধি অমিতাভ ভট্টশালীর সাথে কথা হয় তেমনই একটি পরিবারের। চিকিৎসার উদ্দেশ্যে তারা সেখানে গেলেও ঈদের কোনাকাটার বাজেট নিয়েই সেখানে গিয়েছিলেন তারা।
কথোপকথনটি ছিল এরকম:
বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে প্রশ্ন: কী কিনলেন?
পরিবারটির নারী সদস্যের উত্তর:সবকিছুই কিনলাম। পরিবারের সদস্যদের জন্য জুতা জামা, কসমেটিক্স সব।
প্রশ্ন: ঢাকায় পাওয়া যায়না এমন কী আছে?
উত্তর: সবই আছে। তবে প্রাইসটা (দাম) কম।
আর কোলকাতার নিউমার্কেটে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশী ক্রেতা আমিনুল হক লোটন বলেন, ঈদের বাজেট থেকে টাকা কিছুটা বাঁচাতেও পেরেছেন।
তিনি জানান, তাদের যেমনটা ঈদের বাজেট ছিল তার চেয়ে অনেক কম দামে জিনিসপত্র কিনতে পেরেছেন কোলকাতায়। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড -এসব দেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থাকলেও কেনাকাটায় ভারতের ব্যাপারে তিনি ‘সন্তুষ্ট’বলে জানান।
এগারো মাসেই ৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার ভারতে ভ্রমণ ব্যয়, বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসেব বলছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪৫ মিলিয়ন ডলার নিয়ে গেছে বাংলাদেশের টুরিস্টরা। পরের বছর তা বেড়েছে আরও দুই মিলিয়ন। তবে চলতি বছর তা অনেক বেশি ছাড়িয়ে যাবে। কারণ জুলাই থেকে মে মাস পর্যন্ত এগারো মাসেই বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়ার সময় ৫৭ মিলিয়ন ডলার ইনডোর্স করে নিয়ে গেছেন পর্যটকরা। বলছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা।
” ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪৫ মিলিয়ন ডলার নিয়ে গেছে বাংলাদেশের টুরিস্টরা। পরের বছর তা বেড়েছে আরও দুই মিলিয়ন। তবে চলতি বছর এগারো মাসেই বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়ার সময় ৫৭ মিলিয়ন ডলার (৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার) এনডোর্স করে নিয়ে গেছেন পর্যটকরা”।
অর্থাৎ বাংলাদেশী টাকায় হিসেবে করলে চারশো ষাট কোটি টাকা ভারতে নিয়ে গেছেন বাংলাদেশীরা। মি. সাহা জানান, এর তুলনায় চিকিৎসা, শিক্ষা বা ব্যবসায়িক খাতে ভারতে অর্থ বহনের অংক খুবই নগণ্য।
তবে এর কতটা কেনাকাটায় খরচ করেছেন সে হিসেব পুঙ্খানুপুঙ্খ বলা সম্ভব নয় ,জানান মি. সাহা। তিনি বলেন, এর বাইরে অনেকে মানি চেঞ্জারদের মাধ্যমে মুদ্রা লেনদেন করে নিয়ে যান যার হিসেব আমরা চাইছি কিন্তু পুরো হিসেব হয়তো পাওয়া যায়না। আবার বাংলা টাকাও থাকে কারো কারো মানিব্যাগে। তবে ঈদের মৌসুমে যে কেনাকাটা বেশি করেন পর্যটকরা সেটা তিনিও যোগ করেন।
“আসলে ছুটিও পাওয়া যায় এইসময়টায়, চাকরিজীবী লোকজনের হাতে বোনাস আসে। ফলে এই সময়টাতে তারা ভ্রমণ এবং কেনাকাটা দুটোই সেরে ফেলেন। আর সে কারণে ঈদ মৌসুমে আমাদের ‘আউটার ইনভিসিবল’ খরচ অন্য সময়ের চেয়ে বেশি”।
ভারতের মুদ্রা অবমূল্যায়নের ফলে রুপির সাথে বাংলাদেশি টাকার মূল্য ব্যবধানও কমে এসেছে। কেনাকাটায় আগ্রহ বাড়ার সেটাও একটি কারণ বলে মনে করা হয়।
আর ঈদ উপলক্ষে বিশেষ ছাড়ও দিয়ে থাকেন ভারতের ব্যবসায়ীরা। কোলকাতার ব্যবসায়ী সমিতির নেতা আশরাফ আলী বিবিসি বাংলাকে বলেন, স্থানীয় ক্রেতাদের যে খরা ছিল সেটা ঈদের আগে বাংলাদেশের ক্রেতাদের দ্বারা পূরণ হয়েছে।
“আসলে এখানে বাংলাদেশের কাস্টমার ৩৬৫ দিনই থাকে । তবে ঈদের সময় বাড়ে। এখানে.স্থানীয় ক্রেতাদের যে খরা ছিল সেটা ঈদের আগে বাংলাদেশের ক্রেতাদের দ্বারা পূরণ হয়েছে। প্রতি দশজনের মধ্যে ৩/৪জনই বাংলাদেশী কাস্টমার”।
কোলকাতার আরেকজন বিক্রেতা সুনীল শেঠি বলেন, “দশরোজা পর্যন্ত বাংলাদেশীদের ভিড় ছিল। এখন তারা প্রায় সবাই চলে গেছে”।
কি ধরনের পোশাক খোঁজেন বাংলাদেশীরা?
বিক্রেতারা জানান, শাড়ি, চুড়িদার, পাঞ্জাবি থেকে গয়না সবকিছুই কিনে নিয়ে আসেন বাংলাদেশের ক্রেতারা। পশমিনা শাল নিয়ে একধরনের ক্রেজ লক্ষ্য করা যায় বলেও জানান তারা।
ভিসা সহজ হওয়ায় বেড়েছে পর্যটকদের সংখ্যা
গতবছর বাংলাদেশে ভারতীয় দূতাবাস কর্তৃপক্ষ ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করার ঘোষণা দেয় এবং ঈদের আগ দিয়ে বিশেষ ভিসা ক্যাম্পও করে। সেখানে দুই সপ্তাহ ধরে দীর্ঘ লাইন দেখা যায়।
গতবছর ঈদের আগে ভারতে যাওয়ার জন্য অতিরিক্ত দেড়-লাখ লোক ভিসা নেন । এবার বিশেষ ক্যাম্প না থাকলেও ভিসা প্রক্রিয়া সহজ হওয়ায় এবং লম্বা সময়ের জন্য ভিসা সুবিধা মেলায় অনেকেই বাসে বা ট্রেনে যাচ্ছেন কোলকাতায়, বলছেন বাংলাদেশের ভ্রমণকারীরা।
ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাস ভিসা নিয়ে প্রবেশে বাংলাদেশী পর্যটকেদর জন্য সহজ করার বিষয় ঘোষণা দেয়া হয়েছে চলতি জুন মাসের শুরুতেই। তাদের ওয়েবসাইটে বলা বলা হয়, ২৪টি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর এবং চেকপোস্ট দিয়ে যাতায়াতকারী বাংলাদেশী নাগরিকদের ভিসায় প্রবেশ ও প্রস্থান নিষেধাজ্ঞা অপসারণ করা হয়েছে। উদ্দেশ্য ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যাতায়াতকে আরও সুগম করা।
উৎসব বাণিজ্যে কেন পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ?
অনেক বছর ধরেই ঈদ মৌসুম ছাড়াও অন্যান্য সময় এবং বিয়ের বাজারের জন্যই বাংলাদেশের অনেক ক্রেতার পছন্দ ভারতের বাজার।
শাড়ী, শাল, পাঞ্জাবি কিংবা জুতার জন্য নিউমার্কেট গড়িয়া হাটা নামগুলো তাদের কাছে গাউছিয়া-চাঁদনিচক-বেইলিরোডের বিকল্প।
একসময় উচ্চবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্তের মাঝে প্রবল থাকলেও বর্তমানে এই আকর্ষণ বাড়ছে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষের মাঝে। মূলত টুরিস্ট ভিসায গিয়ে বেড়ানো এবং কেনাকাটা দুটোই চলে ।
ঈদ উল ফিতর যেহেতু মুসলিম ধর্মানুসারীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব, ফলে এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বছরের সবচে বড় বাণিজ্যের-ব্যবসার আশায় থাকে বাংলাদেশের পোশাক খাতের সাথে জড়িতরা।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে তাই এ বিষয়টিকে দেখা হচ্ছে হুমকি হিসেবে।
বাংলাদেশের দোকান মালিক সমিতির সভাপতি এবং এফবিসিসিআইর সাবেক সহ-সভাপতি হেলালউদ্দিন বলেন, “মূলত ভারতের দূতাবাস ভিসা সহজ করে দিচ্ছে। বাসের-ট্রেনের টিকেট দেখালেই ছয়মাসেরও ভিসা দিচ্ছে। সেখানে দামও কম। ফলে উৎসব অর্থনীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা”।
প্রশ্ন: কেন যেতে হয় ?বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা পূরণ করতে পারেন না?
তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশে ভ্যাট আইনের কারণে দাম কমানো সম্ভব হচ্ছে না।
প্রশ্ন: কিন্তু অনেক ক্রেতা তো মানের বিষয়টির কথাও বলছেন?
মি. উদ্দিন বলেন, “দেখেন পহেলা বৈশাখে কিন্তু বাংলাদেশে অনেক কাপড় বিক্রি হয়। তখন কিন্তু ভারত থেকে এখানে আসার মত অবস্থা হয়। ঈদের সময় আসলে অনেক কাপড় লাগে। আর সবাই একটু দামী কাপড় কিনতে চায়। সেক্ষেত্রে আমরা তাদের সাথে পেরে উঠছি না-এটা ঠিক”।
ভারতে ভিসা প্রক্রিয়াটি আগের চেয়ে সহজ হওয়ায় অনেকেই মাল্টিপল ভিসা নিয়ে ছয়মাসের সুবিধা থাকায় বাসে বা ট্রেনে যাচ্ছেন ভারতে।
ইন্ডিয়ান হাইকমিশনের কয়েকজন কর্মকর্তাও এই সময়ে বাংলাদেশী পর্যটকদের চাপের বিষয়টি স্বীকার করলেন।
যদিও বাংলাদেশের ক্রেতারা ব্যবসায়ীদের বড় টার্গেট এই মৌসুমে তবে, এখানকার ক্রেতারাও কেবলমাত্র মান বা দামের বিষয়টিকেই সবেচয়ে বড় করে দেখার পক্ষে নন।
পণ্য বিক্রীর ক্ষেত্রে ভারতের দোকানি বা ব্যবসায়ীদের ব্যবহার বাংলাদেশের ক্রেতাদের চেয়ে অনেকটাই যে ভাল-সেটাও গুরুত্ব দিচ্ছেন অনেকেই।
সবমিলিয়ে দেশের বাজারে দাম, মান ও বিক্রয় ব্যবস্থাপনার দিকে নতুন করে নজর না দিলে দেশীয় বাজার নিয়ে ব্যবসায়ীদের দুর্ভাবনা কমার বদলে দিনদিন বাড়বে বলেই প্রতীয়মান হয়।
সূত্র, বিবিসি বাংলা