নারীদেহের তলপেটের ভেতরের দিকে ওভারি বা ডিম্বাশয় নামে একটি অঙ্গ রয়েছে। দৈহিক সম্পর্কের সময় এই অঙ্গ থেকে ডিম্বাণু আসে। আর পুরুষের দেহ থেকে আসে শুক্রাণু। ডিম্বাণু আর শুক্রাণু মিলে তৈরি হয় একটি সন্তানের ভ্রূণ।
এরপর সেই ভ্রূণটি নারীদেহের জরায়ুতে ৯ মাস ধরে বড় হয়। তারপর পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে একটি শিশুর জন্ম হয়। এটি সন্তান জন্মের প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক নিয়ম। যেসব দম্পতি স্বাভাবিক নিয়মে মা-বাবা হতে পারেন না, তাঁরা অনেকেই আইভিএফ প্রেগন্যান্সির চিকিৎসা নিয়ে থাকেন।
আইভিএফ প্রেগন্যান্সি (IVF Pregnancy) বা ‘আইভিএফ’ মানে ‘ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন’, যাকে আমরা সাধারণত ‘টেস্টটিউব বেবি’ হিসেবেই চিনে থাকি। ইন মানে ভেতরে, ভিট্রো মানে কাচ আর ফার্টিলাইজেশন মানে নিষিক্তকরণ। অর্থাৎ কাচ বা টেস্টটিউবের ভেতরে নারী-পুরুষের ডিম্বাণু ও শুক্রাণুকে একত্রে রেখে নিষিক্ত ডিম্বাণু তৈরি করা হয়। এই নিষিক্ত ডিম্বাণুকে যন্ত্রপাতির মাধ্যমে নারীদেহের জরায়ুতে স্থাপন করা হয়।
তারপর সেই নিষিক্ত ডিম্বাণু বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে পরিপূর্ণ মানবশিশুতে পরিণত হয়।
আমাদের দেশে অসংখ্য মানুষের কাছে আইভিএফ পদ্ধতি এখনো নতুন কিছু। তবে এই পদ্ধতি নতুন চিকিৎসা নয়। বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশ এবং পাশ্চাত্য দেশগুলোতে টেস্টটিউব বেবি বা আইভিএফ পদ্ধতি ব্যাপক পরিচিত ও প্রচলিত। এই পদ্ধতি ভীষণ ব্যয়বহুল একটি চিকিৎসা।
আমাদের দেশে অনেক স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ আইভিএফের মাধ্যমে চিকিৎসা করছেন।
যাঁদের জন্য আইভিএফ প্রেগন্যান্সি কার্যকর
যাঁদের বারবার গর্ভপাত হয়, জরায়ুতে কোনো সমস্যা রয়েছে অথবা স্বাভাবিকভাবে গর্ভধারণ যাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়, তাঁদের জন্য এই পদ্ধতি কাজে আসবে।
আইভিএফ হলো এক ধরনের অ্যাসিস্টেড রি-প্রডাক্টিভ টেকনোলজি অর্থাৎ প্রজননকারী পদ্ধতি সহায়ক। দীর্ঘদিন ধরে যেসব দম্পতি বন্ধ্যাত্বের সমস্যায় ভুগছেন অথবা অধিক বয়সসম্পন্ন নারী, জননতন্ত্রের জটিল ও বড় কোনো অপারেশন হয়েছে, এ জন্য স্বাভাবিক গর্ভধারণ সম্ভব নয়, এমন পরিস্থিতিতে আইভিএফ প্রেগন্যান্সি কার্যকর।
স্বামী বা স্ত্রীর হরমোনজনিত সমস্যা বা বারবার গর্ভপাত হওয়া অথবা জননতন্ত্রের সমস্যা থাকলে কৃত্রিম গর্ভধারণের চিকিৎসা নিতে পারেন।
আইভিএফ নিয়ে যত ভুল ধারণা
বাংলাদেশে আইভিএফ হয় না। শুধু পাশ্চাত্য দেশেই সম্ভব।
প্রথম সন্তান আইভিএফ হলে আর কোনো দিন স্বাভাবিক নিয়মে গর্ভধারণ করা যাবে না। আইভিএফই করাতে হবে।
আইভিএফ প্রেগন্যান্সির জন্য বহুবিধ হরমোনের ওষুধ ব্যবহার করতে হয়। তাই সারা জীবন রক্তে হরমোনের মাত্রা এলোমেলো হয়ে যায়।
টেস্টটিউব বেবি মানেই স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষের শুক্রাণু ব্যবহার করা হয়। (অন্য পুরুষের বা নারীর সহযোগিতা প্রয়োজন হলে চিকিৎসকরা প্রতিটি বিষয় রোগীকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে বলে থাকেন।) তবে এই পদ্ধতি ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। তাই জেনেবুঝে এই চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত।
টেস্টটিউব বেবির চিকিৎসা মানেই ভয়াবহ শ্বাসকষ্ট হবে। তারপর আইসিইউতে থাকতে হবে। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। সব নারীর শারীরিক সক্ষমতা এক নয়। আইভিএফের জন্য বিভিন্ন ধরনের হরমোনের ওষুধ ব্যবহার করতে হয়। এসব ওষুধের জন্য অনেকের শ্বাসকষ্ট, অস্থিরতাসহ বহুবিধ সমস্যা হতে পারে। অনেকের আবার কিছুই হয় না।
এই পদ্ধতির মাধ্যমে যমজ বা তিনটি সন্তান জন্ম নেবেই। এই ধারণাও সম্পূর্ণ ভুল।
আইভিএফের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
নারীর ডিম্বাণুুর গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য হরমোনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়। এসব ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য হট ফ্ল্যাশ, রক্তচাপ বৃদ্ধি, ওজন বৃদ্ধি, মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরানো, জ্বর জ্বর লাগা, হাত-পায়ে বা পেটে পানি চলে আসতে পারে।
অনেকের ওভারিয়ান হাইপারস্টিমুলেশন সিনড্রোম হয়। এই সমস্যায় পেটে পানি জমে যাওয়া, পেটে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট হতে পারে। তবে সবার হয় না। অনেকের এসিডিটি, মানসিক অবসাদ, অস্থিরতাসহ আরো বহুবিধ সমস্যা বাড়তে পারে। অনেক রোগীর তেমন জটিল কোনো কষ্ট হয় না। তবে গর্ভাবস্থা স্বাভাবিক বা কৃত্রিম যেটিই হোক, প্রত্যেক নারীর কমবেশি শারীরিক কষ্ট হয়।
লেখক : মেডিক্যাল অফিসার, স্ত্রী প্রসূতিবিদ্যা ও বন্ধ্যাত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ঢাকা, বাংলাদেশ
ডা: ফারহানা মোবিন
চিকিৎসক, লেখক ও উপস্থাপিকা
ঢাকা, বাংলাদেশ