Menu |||

এই ছবি দেখেই কি আত্মসমর্পণ করেছিলেন নিয়াজী?

১৯৭১-এর যুদ্ধের সময়ে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ-র দপ্তরে তখন জনসংযোগ আধিকারিক হিসাবে কাজ করতেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল রামমোহন রাও।

ডিসেম্বরের ১০ তারিখ হঠাৎই সেনা সদর দপ্তরে তাঁর দেখা হয়ে গেল ডিরেক্টর অফ মিলিটারি অপারেশনস মেজর জেনারেল ইন্দরজিত সিং গিলের সঙ্গে।

জুনিয়র অফিসারকে মেজর জেনারেল গিল বলেছিলেন, “কাল একটা বড় অপারেশন আছে জানো তো! ভাল করে পাবলিসিটি করতে হবে কিন্তু।”

ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেওয়া মি. গিল প্রথম জীবনে প্যারাস্যুট রেজিমেন্টের কর্নেল ছিলেন। আর ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসাবে।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাও কয়েক বছর আগে একটা লেখায় জানিয়েছিলেন, “ওই অপারেশনটা যে কী, সেটা জানতাম। আর যুদ্ধের জন্য যে সেটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তাও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আমি কলকাতায় পূর্ব কমান্ডের প্রধান জনসংযোগ আধিকারিক কর্নেল বি পি রিখিয়কে ফোন করে আবারও মনে করিয়ে দিয়েছিলাম যে পরের দিনের গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনের খবর যেন খুব ভাল করে ছাপা হয় সব কাগজে।”

ওই অপারেশনের প্রস্তুতি অবশ্য অনেক আগেই নেওয়া শুরু করেছিল ভারতীয় বাহিনী।

একদিকে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে অপারেশনের খুঁটিনাটি তৈরি করছেন, অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের পানাগড়, ব্যারাকপুর আর কলাইকুন্ডায় বাহিনী প্রস্তুত করা হচ্ছে।

‘ইন্ডিয়া স্ট্র্যাটেজিক’ ওয়েবসাইটে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল পি কে চক্রবর্তী লিখেছেন, “পূর্ব ফ্রন্টিয়ারের বিভিন্ন অঞ্চলকে যেসব সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল, সেই অনুযায়ী মেঘালয়ের তুরায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১০১ কমিউনিকেশ জোনের অধীনে পড়েছিল সেন্ট্রাল সেক্টর। পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে জামালপুর, ময়মনসিংহ হয়ে টাঙ্গাইল পর্যন্ত এলাকা দখল করা তাদের দায়িত্ব ছিল। বাকি অঞ্চলগুলি ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল ৪ কোর, ৩৩ কোর আর নতুন তৈরি হওয়া ২ কোরের মধ্যে।”

তার আগেই মেঘালয়ের তুরা-তে অবস্থিত ভারতীয় সেনার ১০১ কমিউনিকেশন জোনের অধীনস্থ ৯৫ মাউেন্টন ব্রিগেড গ্রুপ পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তের ভেতরে প্রবেশ করেছে। তাদের যাত্রাপথ নির্দিষ্ট করা হয়েছিল তুরা-জামালপুর-টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকার দিকে।

ভারতীয় বাহিনীর আরেকটি ব্রিগেড, এফ জে সেক্টর ময়মনসিংহ হয়ে টাঙ্গাইলের পথ ধরেছিল।

এরই মধ্যে জানা যায় যে পাকিস্তানি বাহিনীর ৯৩ নম্বর ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড উত্তরাঞ্চল থেকে ঢাকার দিকে ফিরে যাচ্ছে।

তাই তাড়াতাড়ি যমুনা নদের ওপরে পুঙ্গলি সেতুটা রক্ষা করা দরকার যে কোনও মূল্যে। না হলে ঢাকার দিকে এগোতে থাকা ভারতীয় বাহিনীর এগোনোর উপায় থাকবে না।

ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা বুঝে গিয়েছিলেন একটা ঝুঁকি নিতেই হবে। কিন্তু স্বাধীন ভারতে সেনাবাহিনী ওইরকম ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন আগে কখনও করে নি। শেষমেশ চূড়ান্ত হল অপারেশন। ঠিক করা হল টাঙ্গাইলের কাছাকাছি কোনও জায়গায় বিমান থেকে প্যারাসুটের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের সীমানার ভেতরেই সেনা নামিয়ে দেওয়া হবে।

সেটাই ছিল স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে প্রথম প্যারা-ড্রপিং।

এরকম যে পরিস্থিতি আসতে পারে, সেটা আন্দাজ করে আগেই টাঙ্গাইল অঞ্চলে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সরাসরি যোগাযোগ হয়েছিল।

ভারতীয় বাহিনীর এক বাঙালি অফিসার সেখানে পৌঁছিয়ে গিয়ে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে শুরু করেছিলেন।

মেজর জেনারেল সুখওয়ন্ত সিং তাঁর বই ‘ইন্ডিয়াজ ওয়ারস সিন্স ইন্ডিডিপেন্ডেন্স’-এ লিখেছেন, “৫০ ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্যারা ব্রিগেড গ্রুপকে আগেই ব্যারাকপুর, পানাগড় আর কলাইকুন্ডায় জড়ো করে রাখা হয়েছিল। তাদের মধ্যে থেকেই ২ নম্বর (মারাঠা) প্যারা ব্যাটালিয়নকে বেছে নেওয়া হল টাঙ্গাইলের জন্য। প্রয়োজনীয় অস্ত্র আর রসদ ব্রিগেড গ্রুপের সহযোগী ইউনিটগুলি থেকে দেওয়া হয়েছিল – যাতে স্বাধীনভাবে সম্মুখ সমরের জন্য সবকিছু তাদের সঙ্গেই থাকে। ব্যাটালিয়নটির নেতৃত্বে ছিলে লেফটেন্যান্ট কর্ণেল কুলওয়ন্ত সিং পান্নু।”

“মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে এমন একটা জায়গা প্যারা-ড্রপিংয়ের জন্য বাছা হয়েছিল, যার পূব দিকে মধুপুর জঙ্গল, মাঝে মাঝেই পুকুর-জলা আর গ্রামের বসতবাড়ি রয়েছে।

১১ তারিখ দুপুর আড়াইটের সময়ে দমদমের সিভিলিয়ান বিমানবন্দর আর কলাইকুন্ডার এয়ারবেস থেকে ৫০টি বিমান আকাশে উড়েছিল,” লিখেছেন মেজর জেনারেল সুখওয়ন্ত সিং।

প্যারাট্রুপারদের বিমানগুলি পৌঁছনর আগে কয়েকটি মিগ সেদিন টাঙ্গাইলের আকাশে চক্কর কাটছিল।

ভূমি থেকে পাঠানো সঙ্কেত দেখে শুরু হল অপারেশন।

প্রথমেই বিমান থেকে ফেলা হল রসদ, তারপর ভারী অস্ত্রশস্ত্র আর জিপ প্রভৃতি, আর একেবারে শেষে নামতে শুরু করল ছত্রী সেনা বা প্যারাট্রুপাররা।

দুটি বিমান থেকে সেনা আর রসদ সেদিন নামানো যায় নি, কিন্তু বাকি ৪৮টি বিমানই সেদিন সফল হয়েছিল বলা চলে।

 

যদিও মেজর সুখওয়ন্ত সিং সহ বিভিন্ন সেনা আধিকারিকই লিখেছেন যে ৪৬টি বিমান থেকে একেবারে ঠিকমতো রসদ, অস্ত্র আর সৈন্যরা নামতে পারলেও দুটি বিমানের একটি থেকে নামিয়ে দেওয়া জিপ গাড়িটি নির্দিষ্ট জায়গার প্রায় বেশ কিছুটা দূরে একটা পুকুরের মধ্যে গিয়ে পড়েছিল। আর আরেকটি বিমান ১৫ মাইল উত্তরে নামিয়ে দিয়েছিল সৈন্যদের।

তাদের ওপরে গুলিও চালিয়েছিল পাকিস্তানি সেনা। তবে পরের দিন তারা মূল বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিতে পেরেছিল।

যেসব বিমান সঠিক জায়গায় রসদ, অস্ত্র আর সৈন্যদের নামিয়ে দিতে পেরেছিল, তার মধ্যেও চারটি জিপ গাড়ি পড়ে গিয়েছিল পুকুরে।

বিকেল সাড়ে চারটের মধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছিল ”টাঙ্গাইল এয়ার ড্রপ” নামের সেই মূল অপারেশন।

তবে আকাশ থেকে নেমে আসা ছত্রী বাহিনীর যুদ্ধ তখন সবে শুরু হচ্ছে।

মুক্তিবাহিনী আর স্থানীয় গ্রামবাসীদের সাহায্যে সবগুলিকেই পুকুর থেকে টেনে তোলা হয়েছিল পরের দিনের মধ্যেই।

প্রায় এক হাজার টন রসদ আর গুলিবারুদ সেদিন আকাশ থেকে ফেলা হয়েছিল।

শুধু জিপ বা রসদ নয়, প্যারাট্রুপারদের মধ্যে বেশ কয়েকজনও পুকুরে পড়ে গিয়েছিলেন।

ততক্ষণে প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছে। কিন্তু স্থানীয় গ্রামবাসী আর মুক্তি যোদ্ধাদের সহযোগিতায় দুঘন্টার মধ্যেই সিংহভাগ ভারতীয় সেনা একজায়গায় জড়ো হতে পেরেছিলেন।

কাদেরিয়া বাহিনীর সহযোগিতায় গোটা দলটি তিন ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল।

মেজর জেনারেল সুখওয়ন্ত সিং লিখেছেন, “এক কম্পানি সেনা দক্ষিণে আকুয়া গ্রাম পেরিয়ে লোহাজং নদীর ফেরিঘাটের দিকে। রাত আটটার মধ্যেই ফেরিঘাটের দখল নিয়েছিল তারা – বিনা বাধায়। আরেকটি পদাতিক কম্ব্যাট টিম মিডিয়াম মেশিন গান আর রিকয়েল-লেস গান সহ এগিয়েছিল মুলিয়া সেতুর দিকে। জামালপুর-টাঙ্গাইল রাস্তার দিকে – যদি পাকিস্তানি বাহিনী সেদিক দিয়ে এসে পড়ে, তার ওপরে নজর রাখছিল তারা।”

“মূল বাহিনী এগিয়েছিল পুঙ্গলি সেতুর দিকে। মাঝে মাঝে দূর থেকে গুলির আওয়াজ পাওয়া গেলেও তারা যতক্ষণে সেতুর দুদিকে অবস্থান নেয়, তখন প্রথমে কোনও পাকিস্তানি সেনাকে দেখা যায় নি। ভারতীয় বাহিনী ভেবেছিল আকাশ থেকে সেনা নামতে দেখে তারা হয়তো ঢাকার দিকে চলে গেছে। রাত আটটা নাগাদ যখন আমাদের সেনারা প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করছে, সেই সময়েই উত্তর দিক থেকে গাড়ির হেডলাইটের লম্বা একটা লাইন দেখা যায়। পরে জানা গিয়েছিল যে জামালপুর আর ময়মনসিংহ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীই ফিরছিল ওই গাড়িগুলিতে। প্রথমে গুলি চালায় নি ভারতীয় বাহিনী। কিন্তু ১০০ ইয়ার্ডের মধ্যে চলে আসার পরে প্রথম গুলি চলে। প্রথম গাড়িটা উড়ে যায়। পরের কয়েকটা গাড়িও ভালরকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সম্মুখ সমর চলে প্রায় আধঘন্টা ধরে। তারপরে পাকিস্তানি বাহিনী আবারও উত্তরের দিকে পালাতে শুরু করে,” লিখেছেন সুখওয়ন্ত সিং।

 

ফিরে যাওয়ার আগে পাকিস্তানি বাহিনী চেষ্টা করেছিল পুঙ্গলি সেতুতে ভারতীয় বাহিনীর গড়ে তোলা প্রতিরোধ সরিয়ে এগোতে, কিন্ত তারা পরাস্ত হয়।

“সেনাবাহিনীর কাছে সেদিন যে রিপোর্ট পাঠানো হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল ১৪৩ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছে ওই সংঘর্ষে। মারা গেছেন ৪ জন ভারতীয় সেনাও। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে রাজাকার বাহিনীর অনেক সদস্যও ছিল।

পরের দিন দুপুরের দিকে প্রায় ২৫০ জন পাকিস্তানি সেনাকে মাথার ওপরে বন্দুক তুলে আত্মসর্মপনের ভঙ্গিতে এগিয়ে আসতে দেখে ভারতীয় বাহিনী। ১০০ ইয়ার্ডের কাছাকাছি এগিয়ে আসার পরে তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল অস্ত্র মাটিতে নামিয়ে রাখতে।

হঠাৎই ওই পাকিস্তানি সেনারা মাটিতে শুয়ে পড়ে গুলি চালাতে শুরু করে। শুরু হয় ব্যাপক গুলির লড়াই। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই সব শেষ হয়ে যায়। গুনে দেখা যায় ২২৯ জন পাকিস্তানি সেনা মারা গেছেন, ২০ জন আহত। দুজন অফিসার সহ ৪২ জনকে আটক করে ভারতীয় বাহিনী।”

টাঙ্গাইলের যুদ্ধের এই বর্ণনা লিখেছেন মেজর জেনারেল সুখওয়ন্ত সিং।

১২ তারিখেই বিকেল সাড়ে চারটের দিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেড আর এফ জে সেক্টরের সেনাদের সঙ্গে রেডিও যোগাযোগ স্থাপিত হয় প্যারা ব্যাটালিয়নের।

“কিন্তু ১২ই ডিসেম্বর তারিখের খবরের কাগজগুলোতে আমাদের সৈন্যদের ওই গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনের খবর প্রায় কিছুই ছাপা হয় নি,” লিখেছিলেন দিল্লির সেনা সদর দপ্তরের কর্মরত জনসংযোগ অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাও।

তিনি লিখেছিলেন, “পূর্ব কম্যান্ডের জনসংযোগ আধিকারিকের দপ্তরে ফোন করে জানতে চেয়েছিলাম যে কেন ওই অপারেশনের খবর বিস্তারিত ছাপা হল না। জবাব এসেছিল যে প্যারাড্রপিংয়ের কোনও ছবি যোগাড় করা যায় নি। তাই গুরুত্বটা বোঝানো যায় নি সাংবাদিকদের।”

মি. রাওয়ের মাথায় হঠাৎই খেলে গিয়েছিল একটা বুদ্ধি।

এই প্যারা ব্রিগেডেরই একটা অনুশীলনে যোগ দিতে তিনি একবছর আগে গিয়েছিলেন আগ্রায়।

বিমান থেকে নেমে আসা শয়ে শয়ে প্যারাসুটের ছবি তুলেছিলেন তিনি।

“আমি দৌড়লাম প্রতিরক্ষা দপ্তরের ফটো বিভাগে। খুঁজে বার করলাম এক বছর আগে আমারই তোলা ওই অনুশীলনের ছবিটা। সংবাদমাধ্যমে প্রচারের জন্য বিলি করে দিলাম। ছবির ক্যাপশানে লিখেছিলাম ভারতীয় প্যারা ব্রিগেডের সৈন্যদের পূর্ব পাকিস্তানে নামানো হয়েছে। শুধু উল্লেখ করি নি যে ছবিটা ‘ফাইল ছবি’। ক্যাপশানটা মিথ্যা ছিল না, কিন্তু সম্পূর্ণ সত্যিও ছিল না। ছবি দেখে মনে হচ্ছিল যে একটা গোটা প্যারা ব্রিগেডই যেন নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

“ছবিটা পরের দিন লন্ডন টাইমস, নিউ ইয়র্ক টাইমস সহ সারা পৃথিবীর সব গুরুত্বপূর্ণ কাগজে ছাপা হয়েছিল,” লিখেছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল রামমোহন রাও।

তারপরেই তাঁর ডাক পড়েছিল সেনা প্রধান স্যাম মানেকশ-র ঘরে। পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশ্যে উর্দুতে লেখা একটা বার্তা রেকর্ড করা হচ্ছিল তখন – আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে।

 

”আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্র থেকে সেই বার্তা বারে বারে ব্রডকাস্ট করা হয়েছিল আর সেটা ছাপাও হয়েছিল। সেই বার্তা পূর্ব পাকিস্তানের আকাশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিবাহিনী আর ঢাকার দিকে এগোতে থাকা আমাদের সৈন্যদের চাপে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন জেনারেল নিয়াজী। আমি জেনে গিয়েছিলাম যে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করতে চলেছে পাকিস্তানি বাহিনী। কিন্তু সংসদে সেটা ঘোষণা করার কথা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর। তাই আমি কাউকেই বলতে পারি নি কথাটা,” স্মৃতিচারণ করেছিলেন লেফটেন্যান্ট রামমোহন রাও।

তবে সপ্তাহখানেক পরে, ঢাকা থেকে ফিরে আসা এক অফিসারের কাছে তিনি জেনেছিলেন যে কেন অত তাড়াতাড়ি আত্মসমর্পণ করলেন জেনারেল নিয়াজী।

“ওই অফিসারকে জেনারেল নিয়াজী তাঁর সামনে টেবিলে পড়ে থাকা লন্ডন টাইমস কাগজের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়েছিলেন আত্মসমর্পণের কারণ হিসাবে। ওপরেই ছাপা হয়েছিল আমার তোলা আর প্রকাশ করা প্যারাবিগ্রেড নামানোর ছবিটা – গোটা আকাশ জুড়ে শয়ে শয়ে প্যারাসুট নেমে আসছে।”

ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্ব কমান্ডের দেওয়া একটি তথ্য বলছে সেদিন এক ব্যাটালিয়ন, অর্থাৎ প্রায় ৭০০ সৈন্য নামানো হয়েছিল প্যারাসুটের মাধ্যমে।

কিন্তু ইন্ডিয়া স্ট্র্যাটেজিক ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি লেখায় গুলশন লুথরা জানিয়েছেন, “১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের মাটিতে নেমেছিল ৫৪০ জন ভারতীয় সেনা।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্ব কমান্ড বলছে, “যে ছবি লেফটেন্যান্ট কর্নেল রামমোহন রাও প্রচার করেছিলেন, সেটা দেখে মনে হয়েছিল সত্যিই এক ব্রিগেড, অর্থাৎ প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার ভারতীয় সেনা নামিয়ে দেওয়া হয়েছে টাঙ্গাইলে। সেটাতেই কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলেন জেনারেল নিয়াজী।”

তবে ছবির ক্যাপশানে কেন সম্পূর্ণ তথ্য দেওয়া হয় নি, তার জন্য জবাবদিহি করতে হয়েছিল লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাওকে।

 

“কিন্তু আমার কাজে খুশি হয়ে অন্য কোনও দপ্তরের কোনও একটা ঘরে বসে মুচকি হেসেছিলেন আর এন কাউ নামের এক ব্যক্তি। আমি কিছুদিনের মধ্যেই হয়ে উঠেছিলাম ‘কাউবয়’,” লিখেছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাও।

ভারতের বৈদেশিক গুপ্তচর এজেন্সি – রিসার্চ এন্ড অ্যানালিসিস উইং বা ‘র’-এ প্রতিষ্ঠাতা-প্রধান ছিলেন মি. আর এন কাউ।

তিনিই ‘র’তে অন্তর্ভূক্ত করে নিয়েছিলেন রামমোহন রাওকে।

মি. কাউয়ের সংস্থা ‘র’-এর প্রথম দিকে অফিসারদের ডাকা হতো ‘কাউবয়’ ।

২০১৬ সালে মারা গেছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল রামমোহন রাও।

 

সূত্র, বিবিসি 

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» তারেক মনোয়ার একজন স্পষ্ট মিথ্যাবাদী

» কুয়েতে নতুন আইনে অবৈধ প্রবাসীদের কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে

» সোশ্যাল প্লাটফর্মে লন্ডনী মেয়েদের বেলেল্লাপনা,চাম্পাবাত সবার শীর্ষে

» ফারুকীর পদত্যাগের বিষয়টি সঠিক নয়

» পাকিস্তান থেকে সেই আলোচিত জাহাজে যা যা এল

» মিছিল করায় আট মাস ধরে সৌদি কারাগারে ৯৩ প্রবাসী, দুশ্চিন্তায় পরিবার

» কুয়েতে যুবলীগের ৫২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন

» ক্ষমা না চাইলে নুরের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়

» বাকু থেকে ফিরলেন ড. মুহাম্মাদ ইউনূস

» শুক্রবার আহত ও শহীদদের স্মরণে কর্মসূচি দিলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

Agrodristi Media Group

Advertising,Publishing & Distribution Co.

Editor in chief & Agrodristi Media Group’s Director. AH Jubed
Legal adviser. Advocate Musharrof Hussain Setu (Supreme Court,Dhaka)
Editor in chief Health Affairs Dr. Farhana Mobin (Square Hospital, Dhaka)
Social Welfare Editor: Rukshana Islam (Runa)

Head Office

UN Commercial Complex. 1st Floor
Office No.13, Hawally. KUWAIT
Phone. 00965 65535272
Email. agrodristi@gmail.com / agrodristitv@gmail.com

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
,

এই ছবি দেখেই কি আত্মসমর্পণ করেছিলেন নিয়াজী?

১৯৭১-এর যুদ্ধের সময়ে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ-র দপ্তরে তখন জনসংযোগ আধিকারিক হিসাবে কাজ করতেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল রামমোহন রাও।

ডিসেম্বরের ১০ তারিখ হঠাৎই সেনা সদর দপ্তরে তাঁর দেখা হয়ে গেল ডিরেক্টর অফ মিলিটারি অপারেশনস মেজর জেনারেল ইন্দরজিত সিং গিলের সঙ্গে।

জুনিয়র অফিসারকে মেজর জেনারেল গিল বলেছিলেন, “কাল একটা বড় অপারেশন আছে জানো তো! ভাল করে পাবলিসিটি করতে হবে কিন্তু।”

ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেওয়া মি. গিল প্রথম জীবনে প্যারাস্যুট রেজিমেন্টের কর্নেল ছিলেন। আর ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসাবে।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাও কয়েক বছর আগে একটা লেখায় জানিয়েছিলেন, “ওই অপারেশনটা যে কী, সেটা জানতাম। আর যুদ্ধের জন্য যে সেটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তাও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আমি কলকাতায় পূর্ব কমান্ডের প্রধান জনসংযোগ আধিকারিক কর্নেল বি পি রিখিয়কে ফোন করে আবারও মনে করিয়ে দিয়েছিলাম যে পরের দিনের গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনের খবর যেন খুব ভাল করে ছাপা হয় সব কাগজে।”

ওই অপারেশনের প্রস্তুতি অবশ্য অনেক আগেই নেওয়া শুরু করেছিল ভারতীয় বাহিনী।

একদিকে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে অপারেশনের খুঁটিনাটি তৈরি করছেন, অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের পানাগড়, ব্যারাকপুর আর কলাইকুন্ডায় বাহিনী প্রস্তুত করা হচ্ছে।

‘ইন্ডিয়া স্ট্র্যাটেজিক’ ওয়েবসাইটে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল পি কে চক্রবর্তী লিখেছেন, “পূর্ব ফ্রন্টিয়ারের বিভিন্ন অঞ্চলকে যেসব সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল, সেই অনুযায়ী মেঘালয়ের তুরায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১০১ কমিউনিকেশ জোনের অধীনে পড়েছিল সেন্ট্রাল সেক্টর। পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে জামালপুর, ময়মনসিংহ হয়ে টাঙ্গাইল পর্যন্ত এলাকা দখল করা তাদের দায়িত্ব ছিল। বাকি অঞ্চলগুলি ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল ৪ কোর, ৩৩ কোর আর নতুন তৈরি হওয়া ২ কোরের মধ্যে।”

তার আগেই মেঘালয়ের তুরা-তে অবস্থিত ভারতীয় সেনার ১০১ কমিউনিকেশন জোনের অধীনস্থ ৯৫ মাউেন্টন ব্রিগেড গ্রুপ পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তের ভেতরে প্রবেশ করেছে। তাদের যাত্রাপথ নির্দিষ্ট করা হয়েছিল তুরা-জামালপুর-টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকার দিকে।

ভারতীয় বাহিনীর আরেকটি ব্রিগেড, এফ জে সেক্টর ময়মনসিংহ হয়ে টাঙ্গাইলের পথ ধরেছিল।

এরই মধ্যে জানা যায় যে পাকিস্তানি বাহিনীর ৯৩ নম্বর ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড উত্তরাঞ্চল থেকে ঢাকার দিকে ফিরে যাচ্ছে।

তাই তাড়াতাড়ি যমুনা নদের ওপরে পুঙ্গলি সেতুটা রক্ষা করা দরকার যে কোনও মূল্যে। না হলে ঢাকার দিকে এগোতে থাকা ভারতীয় বাহিনীর এগোনোর উপায় থাকবে না।

ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা বুঝে গিয়েছিলেন একটা ঝুঁকি নিতেই হবে। কিন্তু স্বাধীন ভারতে সেনাবাহিনী ওইরকম ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন আগে কখনও করে নি। শেষমেশ চূড়ান্ত হল অপারেশন। ঠিক করা হল টাঙ্গাইলের কাছাকাছি কোনও জায়গায় বিমান থেকে প্যারাসুটের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের সীমানার ভেতরেই সেনা নামিয়ে দেওয়া হবে।

সেটাই ছিল স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে প্রথম প্যারা-ড্রপিং।

এরকম যে পরিস্থিতি আসতে পারে, সেটা আন্দাজ করে আগেই টাঙ্গাইল অঞ্চলে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সরাসরি যোগাযোগ হয়েছিল।

ভারতীয় বাহিনীর এক বাঙালি অফিসার সেখানে পৌঁছিয়ে গিয়ে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে শুরু করেছিলেন।

মেজর জেনারেল সুখওয়ন্ত সিং তাঁর বই ‘ইন্ডিয়াজ ওয়ারস সিন্স ইন্ডিডিপেন্ডেন্স’-এ লিখেছেন, “৫০ ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্যারা ব্রিগেড গ্রুপকে আগেই ব্যারাকপুর, পানাগড় আর কলাইকুন্ডায় জড়ো করে রাখা হয়েছিল। তাদের মধ্যে থেকেই ২ নম্বর (মারাঠা) প্যারা ব্যাটালিয়নকে বেছে নেওয়া হল টাঙ্গাইলের জন্য। প্রয়োজনীয় অস্ত্র আর রসদ ব্রিগেড গ্রুপের সহযোগী ইউনিটগুলি থেকে দেওয়া হয়েছিল – যাতে স্বাধীনভাবে সম্মুখ সমরের জন্য সবকিছু তাদের সঙ্গেই থাকে। ব্যাটালিয়নটির নেতৃত্বে ছিলে লেফটেন্যান্ট কর্ণেল কুলওয়ন্ত সিং পান্নু।”

“মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে এমন একটা জায়গা প্যারা-ড্রপিংয়ের জন্য বাছা হয়েছিল, যার পূব দিকে মধুপুর জঙ্গল, মাঝে মাঝেই পুকুর-জলা আর গ্রামের বসতবাড়ি রয়েছে।

১১ তারিখ দুপুর আড়াইটের সময়ে দমদমের সিভিলিয়ান বিমানবন্দর আর কলাইকুন্ডার এয়ারবেস থেকে ৫০টি বিমান আকাশে উড়েছিল,” লিখেছেন মেজর জেনারেল সুখওয়ন্ত সিং।

প্যারাট্রুপারদের বিমানগুলি পৌঁছনর আগে কয়েকটি মিগ সেদিন টাঙ্গাইলের আকাশে চক্কর কাটছিল।

ভূমি থেকে পাঠানো সঙ্কেত দেখে শুরু হল অপারেশন।

প্রথমেই বিমান থেকে ফেলা হল রসদ, তারপর ভারী অস্ত্রশস্ত্র আর জিপ প্রভৃতি, আর একেবারে শেষে নামতে শুরু করল ছত্রী সেনা বা প্যারাট্রুপাররা।

দুটি বিমান থেকে সেনা আর রসদ সেদিন নামানো যায় নি, কিন্তু বাকি ৪৮টি বিমানই সেদিন সফল হয়েছিল বলা চলে।

 

যদিও মেজর সুখওয়ন্ত সিং সহ বিভিন্ন সেনা আধিকারিকই লিখেছেন যে ৪৬টি বিমান থেকে একেবারে ঠিকমতো রসদ, অস্ত্র আর সৈন্যরা নামতে পারলেও দুটি বিমানের একটি থেকে নামিয়ে দেওয়া জিপ গাড়িটি নির্দিষ্ট জায়গার প্রায় বেশ কিছুটা দূরে একটা পুকুরের মধ্যে গিয়ে পড়েছিল। আর আরেকটি বিমান ১৫ মাইল উত্তরে নামিয়ে দিয়েছিল সৈন্যদের।

তাদের ওপরে গুলিও চালিয়েছিল পাকিস্তানি সেনা। তবে পরের দিন তারা মূল বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিতে পেরেছিল।

যেসব বিমান সঠিক জায়গায় রসদ, অস্ত্র আর সৈন্যদের নামিয়ে দিতে পেরেছিল, তার মধ্যেও চারটি জিপ গাড়ি পড়ে গিয়েছিল পুকুরে।

বিকেল সাড়ে চারটের মধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছিল ”টাঙ্গাইল এয়ার ড্রপ” নামের সেই মূল অপারেশন।

তবে আকাশ থেকে নেমে আসা ছত্রী বাহিনীর যুদ্ধ তখন সবে শুরু হচ্ছে।

মুক্তিবাহিনী আর স্থানীয় গ্রামবাসীদের সাহায্যে সবগুলিকেই পুকুর থেকে টেনে তোলা হয়েছিল পরের দিনের মধ্যেই।

প্রায় এক হাজার টন রসদ আর গুলিবারুদ সেদিন আকাশ থেকে ফেলা হয়েছিল।

শুধু জিপ বা রসদ নয়, প্যারাট্রুপারদের মধ্যে বেশ কয়েকজনও পুকুরে পড়ে গিয়েছিলেন।

ততক্ষণে প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছে। কিন্তু স্থানীয় গ্রামবাসী আর মুক্তি যোদ্ধাদের সহযোগিতায় দুঘন্টার মধ্যেই সিংহভাগ ভারতীয় সেনা একজায়গায় জড়ো হতে পেরেছিলেন।

কাদেরিয়া বাহিনীর সহযোগিতায় গোটা দলটি তিন ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল।

মেজর জেনারেল সুখওয়ন্ত সিং লিখেছেন, “এক কম্পানি সেনা দক্ষিণে আকুয়া গ্রাম পেরিয়ে লোহাজং নদীর ফেরিঘাটের দিকে। রাত আটটার মধ্যেই ফেরিঘাটের দখল নিয়েছিল তারা – বিনা বাধায়। আরেকটি পদাতিক কম্ব্যাট টিম মিডিয়াম মেশিন গান আর রিকয়েল-লেস গান সহ এগিয়েছিল মুলিয়া সেতুর দিকে। জামালপুর-টাঙ্গাইল রাস্তার দিকে – যদি পাকিস্তানি বাহিনী সেদিক দিয়ে এসে পড়ে, তার ওপরে নজর রাখছিল তারা।”

“মূল বাহিনী এগিয়েছিল পুঙ্গলি সেতুর দিকে। মাঝে মাঝে দূর থেকে গুলির আওয়াজ পাওয়া গেলেও তারা যতক্ষণে সেতুর দুদিকে অবস্থান নেয়, তখন প্রথমে কোনও পাকিস্তানি সেনাকে দেখা যায় নি। ভারতীয় বাহিনী ভেবেছিল আকাশ থেকে সেনা নামতে দেখে তারা হয়তো ঢাকার দিকে চলে গেছে। রাত আটটা নাগাদ যখন আমাদের সেনারা প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করছে, সেই সময়েই উত্তর দিক থেকে গাড়ির হেডলাইটের লম্বা একটা লাইন দেখা যায়। পরে জানা গিয়েছিল যে জামালপুর আর ময়মনসিংহ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীই ফিরছিল ওই গাড়িগুলিতে। প্রথমে গুলি চালায় নি ভারতীয় বাহিনী। কিন্তু ১০০ ইয়ার্ডের মধ্যে চলে আসার পরে প্রথম গুলি চলে। প্রথম গাড়িটা উড়ে যায়। পরের কয়েকটা গাড়িও ভালরকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সম্মুখ সমর চলে প্রায় আধঘন্টা ধরে। তারপরে পাকিস্তানি বাহিনী আবারও উত্তরের দিকে পালাতে শুরু করে,” লিখেছেন সুখওয়ন্ত সিং।

 

ফিরে যাওয়ার আগে পাকিস্তানি বাহিনী চেষ্টা করেছিল পুঙ্গলি সেতুতে ভারতীয় বাহিনীর গড়ে তোলা প্রতিরোধ সরিয়ে এগোতে, কিন্ত তারা পরাস্ত হয়।

“সেনাবাহিনীর কাছে সেদিন যে রিপোর্ট পাঠানো হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল ১৪৩ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছে ওই সংঘর্ষে। মারা গেছেন ৪ জন ভারতীয় সেনাও। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে রাজাকার বাহিনীর অনেক সদস্যও ছিল।

পরের দিন দুপুরের দিকে প্রায় ২৫০ জন পাকিস্তানি সেনাকে মাথার ওপরে বন্দুক তুলে আত্মসর্মপনের ভঙ্গিতে এগিয়ে আসতে দেখে ভারতীয় বাহিনী। ১০০ ইয়ার্ডের কাছাকাছি এগিয়ে আসার পরে তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল অস্ত্র মাটিতে নামিয়ে রাখতে।

হঠাৎই ওই পাকিস্তানি সেনারা মাটিতে শুয়ে পড়ে গুলি চালাতে শুরু করে। শুরু হয় ব্যাপক গুলির লড়াই। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই সব শেষ হয়ে যায়। গুনে দেখা যায় ২২৯ জন পাকিস্তানি সেনা মারা গেছেন, ২০ জন আহত। দুজন অফিসার সহ ৪২ জনকে আটক করে ভারতীয় বাহিনী।”

টাঙ্গাইলের যুদ্ধের এই বর্ণনা লিখেছেন মেজর জেনারেল সুখওয়ন্ত সিং।

১২ তারিখেই বিকেল সাড়ে চারটের দিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেড আর এফ জে সেক্টরের সেনাদের সঙ্গে রেডিও যোগাযোগ স্থাপিত হয় প্যারা ব্যাটালিয়নের।

“কিন্তু ১২ই ডিসেম্বর তারিখের খবরের কাগজগুলোতে আমাদের সৈন্যদের ওই গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনের খবর প্রায় কিছুই ছাপা হয় নি,” লিখেছিলেন দিল্লির সেনা সদর দপ্তরের কর্মরত জনসংযোগ অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাও।

তিনি লিখেছিলেন, “পূর্ব কম্যান্ডের জনসংযোগ আধিকারিকের দপ্তরে ফোন করে জানতে চেয়েছিলাম যে কেন ওই অপারেশনের খবর বিস্তারিত ছাপা হল না। জবাব এসেছিল যে প্যারাড্রপিংয়ের কোনও ছবি যোগাড় করা যায় নি। তাই গুরুত্বটা বোঝানো যায় নি সাংবাদিকদের।”

মি. রাওয়ের মাথায় হঠাৎই খেলে গিয়েছিল একটা বুদ্ধি।

এই প্যারা ব্রিগেডেরই একটা অনুশীলনে যোগ দিতে তিনি একবছর আগে গিয়েছিলেন আগ্রায়।

বিমান থেকে নেমে আসা শয়ে শয়ে প্যারাসুটের ছবি তুলেছিলেন তিনি।

“আমি দৌড়লাম প্রতিরক্ষা দপ্তরের ফটো বিভাগে। খুঁজে বার করলাম এক বছর আগে আমারই তোলা ওই অনুশীলনের ছবিটা। সংবাদমাধ্যমে প্রচারের জন্য বিলি করে দিলাম। ছবির ক্যাপশানে লিখেছিলাম ভারতীয় প্যারা ব্রিগেডের সৈন্যদের পূর্ব পাকিস্তানে নামানো হয়েছে। শুধু উল্লেখ করি নি যে ছবিটা ‘ফাইল ছবি’। ক্যাপশানটা মিথ্যা ছিল না, কিন্তু সম্পূর্ণ সত্যিও ছিল না। ছবি দেখে মনে হচ্ছিল যে একটা গোটা প্যারা ব্রিগেডই যেন নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

“ছবিটা পরের দিন লন্ডন টাইমস, নিউ ইয়র্ক টাইমস সহ সারা পৃথিবীর সব গুরুত্বপূর্ণ কাগজে ছাপা হয়েছিল,” লিখেছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল রামমোহন রাও।

তারপরেই তাঁর ডাক পড়েছিল সেনা প্রধান স্যাম মানেকশ-র ঘরে। পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশ্যে উর্দুতে লেখা একটা বার্তা রেকর্ড করা হচ্ছিল তখন – আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে।

 

”আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্র থেকে সেই বার্তা বারে বারে ব্রডকাস্ট করা হয়েছিল আর সেটা ছাপাও হয়েছিল। সেই বার্তা পূর্ব পাকিস্তানের আকাশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিবাহিনী আর ঢাকার দিকে এগোতে থাকা আমাদের সৈন্যদের চাপে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন জেনারেল নিয়াজী। আমি জেনে গিয়েছিলাম যে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করতে চলেছে পাকিস্তানি বাহিনী। কিন্তু সংসদে সেটা ঘোষণা করার কথা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর। তাই আমি কাউকেই বলতে পারি নি কথাটা,” স্মৃতিচারণ করেছিলেন লেফটেন্যান্ট রামমোহন রাও।

তবে সপ্তাহখানেক পরে, ঢাকা থেকে ফিরে আসা এক অফিসারের কাছে তিনি জেনেছিলেন যে কেন অত তাড়াতাড়ি আত্মসমর্পণ করলেন জেনারেল নিয়াজী।

“ওই অফিসারকে জেনারেল নিয়াজী তাঁর সামনে টেবিলে পড়ে থাকা লন্ডন টাইমস কাগজের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়েছিলেন আত্মসমর্পণের কারণ হিসাবে। ওপরেই ছাপা হয়েছিল আমার তোলা আর প্রকাশ করা প্যারাবিগ্রেড নামানোর ছবিটা – গোটা আকাশ জুড়ে শয়ে শয়ে প্যারাসুট নেমে আসছে।”

ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্ব কমান্ডের দেওয়া একটি তথ্য বলছে সেদিন এক ব্যাটালিয়ন, অর্থাৎ প্রায় ৭০০ সৈন্য নামানো হয়েছিল প্যারাসুটের মাধ্যমে।

কিন্তু ইন্ডিয়া স্ট্র্যাটেজিক ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি লেখায় গুলশন লুথরা জানিয়েছেন, “১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের মাটিতে নেমেছিল ৫৪০ জন ভারতীয় সেনা।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্ব কমান্ড বলছে, “যে ছবি লেফটেন্যান্ট কর্নেল রামমোহন রাও প্রচার করেছিলেন, সেটা দেখে মনে হয়েছিল সত্যিই এক ব্রিগেড, অর্থাৎ প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার ভারতীয় সেনা নামিয়ে দেওয়া হয়েছে টাঙ্গাইলে। সেটাতেই কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলেন জেনারেল নিয়াজী।”

তবে ছবির ক্যাপশানে কেন সম্পূর্ণ তথ্য দেওয়া হয় নি, তার জন্য জবাবদিহি করতে হয়েছিল লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাওকে।

 

“কিন্তু আমার কাজে খুশি হয়ে অন্য কোনও দপ্তরের কোনও একটা ঘরে বসে মুচকি হেসেছিলেন আর এন কাউ নামের এক ব্যক্তি। আমি কিছুদিনের মধ্যেই হয়ে উঠেছিলাম ‘কাউবয়’,” লিখেছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাও।

ভারতের বৈদেশিক গুপ্তচর এজেন্সি – রিসার্চ এন্ড অ্যানালিসিস উইং বা ‘র’-এ প্রতিষ্ঠাতা-প্রধান ছিলেন মি. আর এন কাউ।

তিনিই ‘র’তে অন্তর্ভূক্ত করে নিয়েছিলেন রামমোহন রাওকে।

মি. কাউয়ের সংস্থা ‘র’-এর প্রথম দিকে অফিসারদের ডাকা হতো ‘কাউবয়’ ।

২০১৬ সালে মারা গেছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল রামমোহন রাও।

 

সূত্র, বিবিসি 

Facebook Comments Box


এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



Exchange Rate

Exchange Rate EUR: Thu, 21 Nov.

সর্বশেষ খবর



Agrodristi Media Group

Advertising,Publishing & Distribution Co.

Editor in chief & Agrodristi Media Group’s Director. AH Jubed
Legal adviser. Advocate Musharrof Hussain Setu (Supreme Court,Dhaka)
Editor in chief Health Affairs Dr. Farhana Mobin (Square Hospital, Dhaka)
Social Welfare Editor: Rukshana Islam (Runa)

Head Office

UN Commercial Complex. 1st Floor
Office No.13, Hawally. KUWAIT
Phone. 00965 65535272
Email. agrodristi@gmail.com / agrodristitv@gmail.com

Bangladesh Office

Director. Rumi Begum
Adviser. Advocate Koyes Ahmed
Desk Editor (Dhaka) Saiyedul Islam
44, Probal Housing (4th floor), Ring Road, Mohammadpur,
Dhaka-1207. Bangladesh
Contact: +8801733966556 /+8801316861577

Email Address

agrodristi@gmail.com, agrodristitv@gmail.com

Licence No.

MC- 00158/07      MC- 00032/13

Design & Devaloped BY Popular-IT.Com
error: দুঃখিত! অনুলিপি অনুমোদিত নয়।