জাকির সিকদার,সাভার,ঢাকা : আজ ২৪ নভেম্বর।সকাল ১০ টায় ফেন্টাসীর সামনে মানববন্দন করে পালন করবে সাভারের পোশাক শিল্পের এক স্মরণীয় দিন। তিন বছর আগে এ দিনটিতে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের নিশ্চিন্তপুর এলাকার তাজরীন ফ্যাশন নামের একটি পোশাক কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছিল। এ অগ্নিকান্ডে ১১৩ জন শ্রমিকের করুন মৃতু হয়, আর আহত হয় আরো তিন শতাধিক শ্রমিক। অগ্নিকান্ডের তিন বছর পেরিয়ে গেলেও অনেক ক্ষতিগ্রস্থ শ্রমিকেরই অভিযোগ সরকার ও বিজিএমই এর ঘোষিত আর্থিক সহায়তা তারা এখনও পায়নি। জানা গেছে, আজ থেকে ৩ বছর আগে এই দিনটিতে শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় তোবা গ্রুপের তাজরীন ফ্যাশন নামের পোশাক কারখানার নীচ তলায় থাকা তুলার গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। মুর্হূতের মধ্যে আগুনের লেলিহান শিখা নীচ তলা থেকে ৫ তলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এসময় বিভিন্ন ফ্লোরে থাকা প্রায় হাজার খানিক শ্রমিক জীবন বাচাতে দিকবিদিগ ছুটাছুটি শুরু করে। অনেকে ছাদ থেকে, জানালা দিয়ে লাফিয়ে বা ভবনের পাইপ বেয়ে জীবন বাচাতে পারলেও ১১৩ জন শ্রমিকের জীবন
কেড়ে নেয় আগুনের লেলিহান শিখা আর আহত হয় প্রায় তিন শতাধিক শ্রমিক।
গতকাল সোমবার সকালে সরেজমিনে তাজরিন পোশাক কারখানায় এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অনেক আহত শ্রমিকই পোশাক কারখানার আশেপাশে অবস্থান নিয়ে আছে। তাদের চোখেমুখে কষ্টের ছাপ। দগ্ধ ক্ষত নিয়ে দাড়িয়ে আছে তাজরিন পোশাক কারখানার ভবনটি। প্রধান ফটকে তালা ঝুলে আছে। পুরো ভবনটিতে নেই কোন নিরাপত্তাকর্মী। অনেক শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা দিনটি উপলক্ষ্যে নানা কর্মসূচি নিতে ব্যস্ত সময় পার করছে। বিভিন্ন সংবাদকর্মীরা তথ্য সংগ্রহের জন্য আহতদের কাছে ছুটে বেড়াচ্ছেন।
ওই এলাকায়ই কথা হয় আহত সাবিনা খাতুনের সঙ্গে। তিনি তাজরীনে ফ্যাশনের ৬তলায় সুইং অপারেটরের কাজ করতেন। অগ্নিকান্ডের সময় তিনি কারখানার ভেতরেই ছিলেন। আগুন লাগার পর পরই কারখানার প্রানে বাচার জন্য কারখানার চার তলার জানালা ভেঙ্গে লাফিয়ে পড়েন। নিচে পড়ে গিয়ে বুকে ও কোমড়ের হাড় ভেঙ্গে যায় সাবিনার। এর পর থেকে আর কোন পোশাক কারখানায় কাজ করা তো দূরের কথা নিজের সংসারের কাজও ঠিকমতো করতে পারেনা সাবিনা। আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় এক মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে সেলিম মিয়ার বাড়িতে ভাড়া থাকেন সাবিনা। তাজরীনের আগুন তার জীবনের সব স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে। নিজের ছেলে মেয়েকে পড়াশুনা করিয়ে ভালোবাবে মানুষ করার স্বপ্ন এখন দু:স্বপ্নে পরিনিত হয়েছে। অগ্নিকান্ডে আহত হওয়ার পর কোন ক্ষতিপূরন না পাওয়া গ্রামের জমি বিক্রি করে কোনরকম চিকিৎসা করিয়েছেন। সে সময় সংসারের সকল দায়িত্ব পালন করার কথা। অথচ সেই সময়ে সাবিনা নিজেই অন্যের উপর নির্ভর হয়ে বেচে আছেন। অগ্নিকান্ডের পর সরকারীভাবে সহযোগীতা তো দুরের কথা সামান্যতম চিকিৎসাসেবাও মেলেনি তার ভাগ্যে।
তাজরীনের আগুন থেকে প্রানে বাচতে গিয়ে আরেক শ্রমিক রেহেনা বেগম বলেন, লাফিয়ে নিচে পড়েন। সে ফিনিশিং শাখায় অপারেটরের কাজ করতেন। নিচে লাফিয়ে পড়ায় প্রানে বাচলেও তার বাম পায়ে প্রচন্ড আঘাত পান। অগ্নিকান্ডের পর বিজিএম থেকে এক লক্ষ টাকা সহায়তা দেওয়া হয়। সহয়তার টাকা দিয়ে বেশ কিছু দিন চিকিৎসা করাতে পারলেও এখন চিকিসৎসা তো দুরের কথা নিজের সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। নিজের স্বামী জাবেদও তাকে ছাড়ে আরেকটি বিয়ে করে। গ্রামের জমি বিক্রি করে কোন রকম বেচে আছেন। নিজের দুই সন্তান গ্রামের বাড়িতে তার ছোট বোন আমিনার কাছে থেকে পড়াশুনা করছে। তাদের পড়াশুনার খরচ তার ছোট বোন বহন করছে। তাজরীনের সেই ভয়াবহ অগ্নিকান্ড তার জীবন অনিশ্চিয়তার মুখোমুখি দাড় করিয়ে দিয়েছে।
সাবিনা আর রেহেনা নয়, আঞ্জুয়ারা, আলিনুর, হেনা আক্তার, জাইনুস আক্তারসহ অনেক শ্রমিক শরীরের ক্ষত চিহ্ন নিয়ে হাজির ভবনটির আশপাশে। তাদের ধারণা এবার হয়তো কেউ তাদের ক্ষতিপূরণ দেবে। তারা ক্ষোভ নিয়ে বলেন, তিন বছর পার হলো এখনো কোন ক্ষতিপূরণ পেলাম না আর পাবো কিনা তাও জানি না। একটু সুখের আশায় ঘর থেকে কারখায় ঢুকেছি আর সে কারখানাই গলা টিপে সুখকে ধ্বংস করে দুঃখ এনে দিয়েছে। এমন জীবনের চেয়ে মরাটাই ভাল ছিল।
শ্রমিকদের ক্ষতিপূরন না পাওয়াকে সরকারের উদাসিনতা ও বিজিএমইএ’র স্বইচ্ছাকে দায়ি করছেন শ্রমিক নেতারা। বাংলাদেশ গামেন্ট এন্ড ইন্ডান্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, তিন বছরেও অনেক শ্রমিক এখনও তাদের ক্ষতিপূরণ পায়নি। বারবার তারা আমাদের কাছে এসে অভিযোগ করেন। আমরাও তাদের বিষযটি স্বস্ব টেবিলে জানিয়ে দেই। সকলে তাদের আশ্বাস দিলেও তারা আজও তাদের ক্ষতিপূরণ পায়নি। সরকারের উদাসিনতা ও বিজিএমইএ’র স্বইচ্ছা এর জন্য দায়ি।