Menu |||

আসহাবে কাহাফ: ঘুমন্ত সেই গুহাবাসীদের কাহিনী

জনাকয়েক পলাতক যুবক, একটি গুহা আর তিন শতাব্দীর নিদ্রা- আসহাবে কাহাফের কাহিনী কেবল মুসলিমদের কাছেই প্রবল জনপ্রিয় একটি ঘটনা নয়, বরং খ্রিস্টানদের কাছেও ছিল খুব জনপ্রিয় ও অলৌকিক ঘটনা। কুরআনে বর্ণিত এই কাহিনীর সাথে সাথে সেই সিরিয়ান উপাখ্যান এবং যে নগরীতে এই ঘটনা ঘটেছিল- সবই আমরা এ লেখায় আলোচনা করার চেষ্টা করব।

শুরুতেই বলে রাখা দরকার, এই ঘটনাটি কুরআনে বর্ণিত বিধায়, মুসলিমদের বিশ্বাস ওতপ্রোতভাবে এর সাথে জড়িত। অনেক পাঠকই অভিযোগ করে থাকেন বিধায়, কুরআনের আয়াত বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করার সময় কেবল ইসলামিক সূত্র ব্যবহার করা হবে, এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে তাফসির ইবনে কাসিরের বঙ্গানুবাদের চতুর্দশ খণ্ড। তবে কুরআনে যে ঘটনার বর্ণনা করা হয়েছে, সেটি কুরআন অবতরণের কয়েক শতাব্দী আগের ঘটনা এবং সেটার বিস্তারিত বিবরণও দেওয়া হবে, সেজন্য আমরা ব্যবহার করব ৫ম শতকের স্থানীয় সিরীয় উপকথা, ঠিক যেমনটা লিপিবদ্ধ ছিল। কাহিনীগুলোর পার্থক্য তখনই প্রতীয়মান হবে। তাহলে প্রথমে শুরু করা যাক কুরআনে বলা ঘটনাটি দিয়ে।

কুরআনের ১৮ নম্বর সুরা ‘সুরা কাহাফ’ মক্কাতে অবতীর্ণ হয়; অর্থাৎ তখনও নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) ও তাঁর অনুসারীরা মদিনায় চলে যাননি। কিন্তু মক্কাতে তখন তাঁর অনুসারীর সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে দেখে কুরাইশরা খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ে। যেহেতু নবী (সা) এমন ধর্ম প্রচার করে চলেছিলেন, যেখানে আগের নবীদের সাথে ইহুদি-খ্রিস্টানদের নবীরা মিলে যায়, তাই কুরাইশ নেতারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, তাঁরা ইহুদি র‍্যাবাইদের (আলেম) সাথে পরামর্শ করবে। নাযার ইবনে হারিস এবং উকবা ইবনে মুয়িত নামের দুজনকে তাঁরা মদিনার ইহুদি র‍্যাবাইদের কাছে প্রেরণ করে এই বলে যে, তাঁরা যেন মুহাম্মাদ (সা) এর ব্যাপারে তাদের মতামত জানায়।

তারা মদিনা পৌঁছালে ইহুদি আলেমরা তাদের কথা শুনে মীমাংসা করার জন্য একটি উপায় বাতলে দেন,

“দেখো, আমরা তোমাদের মীমাংসা করার জন্য একটি কথা বলছি। তোমরা ফিরে গিয়ে তাঁকে তিনটি প্রশ্ন করবে। তিনি যদি উত্তর দিতে পারেন, তবে তিনি যে সত্য নবী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর না দিতে পারলে তিনি মিথ্যেবাদী। প্রথম প্রশ্ন: পূর্বযুগে যে যুবকেরা বেরিয়ে গিয়েছিলেন তাদের ঘটনা বর্ণনা করুন তো? এ এক বিস্ময়কর ঘটনা…”

এরকম আরো দুটি প্রশ্ন তাঁরা করতে বলেন। বাকি ঘটনা এখানে আমরা লিখছি না, তবে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর হিসেবেই অবতীর্ণ হয় সুরা কাহাফ (‘গুহা’)

‘আসহাবে কাহাফ’ অর্থ ‘গুহাবাসী’। এ ঘটনা ঘটেছিল প্রাচীন গ্রিক শহর আনাতোলিয়া বা এফিসাসে (Ephesus)। কাছেই ছিল গ্রিক দেবী আরটেমিসের বিখ্যাত মন্দির। বর্তমানে ভৌগোলিকভাবে শহরটি তুরস্কে পড়েছে। তবে কুরআনে অবশ্য নাম-ঠিকানা উল্লেখ করা নেই।

প্রথমে কুরআনের ভাষ্যতেই কাহিনী শুনে নেয়া যাক।

তুমি কি ধারণা করো যে, গুহা ও রাকীমের অধিবাসীরা আমার নিদর্শনাবলীর মধ্যে বিস্ময়কর ছিল? যখন যুবকেরা পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করে তখন দোয়া করে: “হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদেরকে নিজের কাছ থেকে রহমত দান করুন এবং আমাদের জন্য আমাদের কাজ সঠিকভাবে পূর্ণ করুন।” তখন আমি কয়েক বছরের জন্য গুহায় তাদের ঘুমন্ত অবস্থায় রাখলাম। অতঃপর আমি তাদেরকে পুনরুত্থিত করি, একথা জানার জন্যে যে, দুই দলের মধ্যে কোন দল তাদের অবস্থানকাল সম্পর্কে অধিক নির্ণয় করতে পারে। আপনার কাছে তাদের ইতিবৃত্তান্ত সঠিকভাবে বর্ণনা করছি। তারা ছিল কয়েকজন যুবক। তারা তাদের পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল এবং আমি তাদের সৎপথে চলার শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আমি তাদের মন দৃঢ় করেছিলাম, যখন তারা উঠে দাঁড়িয়েছিল। অতঃপর তারা বলল: “আমাদের পালনকর্তা আসমান ও যমীনের পালনকর্তা, আমরা কখনও তার পরিবর্তে অন্য কোনো উপাস্যকে আহবান করব না। যদি করি, তবে তা অত্যন্ত গর্হিত কাজ হবে। এরা আমাদেরই স্ব-জাতি, এরা তাঁর পরিবর্তে অনেক উপাস্য গ্রহণ করেছে। তারা এদের সম্পর্কে প্রকাশ্য প্রমাণ উপস্থিত করে না কেন? যে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা উদ্ভাবন করে, তার চাইতে অধিক পাপী আর কে?” তোমরা যখন তাদের থেকে পৃথক হলে এবং তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের এবাদত করে তাদের থেকে, তখন তোমরা গুহায় আশ্রয় গ্রহণ কর। তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের জন্যে দয়া বিস্তার করবেন এবং তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের কাজকর্মকে ফলপ্রসু করার ব্যবস্থা করবেন। তুমি সূর্যকে দেখবে, যখন উদিত হয়, তাদের গুহা থেকে পাশ কেটে ডান দিকে চলে যায় এবং যখন অস্ত যায়, তাদের থেকে পাশ কেটে বাম দিকে চলে যায়, অথচ তারা গুহার প্রশস্ত চত্বরে অবস্থিত। এটা আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্যতম… তুমি মনে করবে তারা জাগ্রত, অথচ তারা নিদ্রিত। আমি তাদেরকে পার্শ্ব পরিবর্তন করাই ডান দিকে ও বাম দিকে। তাদের কুকুর ছিল সামনের পা দুটি গুহাদ্বারে প্রসারিত করে। যদি তুমি উঁকি দিয়ে তাদেরকে দেখতে, তবে পেছন ফিরে পলায়ন করতে এবং তাদের ভয়ে আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়তে। আমি এমনিভাবে তাদেরকে জাগ্রত করলাম, যাতে তারা পরস্পর জিজ্ঞাসাবাদ করে। তাদের একজন বলল: “তোমরা কতকাল অবস্থান করেছ?” তাদের কেউ বলল: “একদিন অথবা একদিনের কিছু অংশ অবস্থান করছি।” কেউ কেউ বলল: “তোমাদের পালনকর্তাই ভালো জানেন তোমরা কতকাল অবস্থান করেছ। এখন তোমাদের একজনকে তোমাদের এই মুদ্রাসহ শহরে প্রেরণ কর; সে যেন দেখে কোন খাদ্য পবিত্র। অতঃপর তা থেকে যেন কিছু খাদ্য নিয়ে আসে তোমাদের জন্য; সে যেন নম্রতা সহকারে যায় ও কিছুতেই যেন তোমাদের খবর কাউকে না জানায়। তারা যদি তোমাদের খবর জানতে পারে, তবে পাথর মেরে তোমাদেরকে হত্যা করবে, অথবা তোমাদেরকে তাদের ধর্মে ফিরিয়ে নেবে। তাহলে তোমরা কখনই সাফল্য লাভ করবে না।” এমনিভাবে আমি তাদের খবর প্রকাশ করে দিলাম, যাতে তারা জ্ঞাত হয় যে, আল্লাহর ওয়াদা সত্য এবং কেয়ামতে কোনো সন্দেহ নেই। যখন তারা নিজেদের কর্তব্য বিষয়ে পরস্পর বিতর্ক করছিল, তখন তারা বলল: “তাদের উপর সৌধ নির্মাণ কর।” তাদের পালনকর্তা তাদের বিষয়ে ভালো জানেন। তাদের কর্তব্য বিষয়ে যাদের মত প্রবল হল, তারা বলল: “আমরা অবশ্যই তাদের স্থানে উপাসনালয় নির্মাণ করব।” অজ্ঞাত বিষয়ে অনুমানের উপর ভিত্তি করে এখন তারা বলবে: তারা ছিল তিন জন, তাদের চতুর্থটি তাদের কুকুর। একথাও বলবে, তারা পাঁচ জন। তাদের ছষ্ঠটি ছিল তাদের কুকুর। আরও বলবে, তারা ছিল সাত জন। তাদের অষ্টমটি ছিল তাদের কুকুর। বলুন: আমার পালনকর্তা তাদের সংখ্যা ভালো জানেন। তাদের খবর অল্প লোকই জানে। সাধারণ আলোচনা ছাড়া তুমি তাদের সম্পর্কে বিতর্ক করবে না এবং তাদের অবস্থা সম্পর্কে তাদের কাউকে জিজ্ঞাসাবাদও করবে না… তাদের উপর তাদের গুহায় তিনশ বছর, অতিরিক্ত আরও নয় বছর অতিবাহিত হয়েছে। বল: তারা কতকাল অবস্থান করেছে, তা আল্লাহই ভালো জানেন। নভোমণ্ডল ও ভুমণ্ডলের অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান তাঁরই কাছে রয়েছে।” [আল কুরআন ১৮:৯-২৬]

এটুকুই কুরআন কাহিনীটি সম্পর্কে জানায়। এ বিষয়ে তাফসিরে রয়েছে অনেক অনেক বক্তব্য। যেমন- ইবনে কাসিরে একটি মতবাদ লিখিত আছে যে, উপরে আয়াতে লিখা ‘রাকীম’ বলতে ফলকে লেখা বোঝায়, গুহার বাইরে কি কোনো ফলকে করে লিখে দেওয়া হয়েছিল? আমরা কিছুক্ষণ পরেই সেটা জানতে পারব। ইবনে কাসিরে এ-ও লিখা আছে যে, যে অত্যাচারী শাসকের তাড়ায় যুবকেরা পালিয়ে যায়, তার নাম ছিল দাকইয়ানুস। তাছাড়া, যে কুকুরটি তাদের সাথে ছিল, সেটি রাজবাবুর্চির কুকুর ছিল, কুকুরের নাম কিতমির। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) নিশ্চিত করে বলেন যে, গুহাবাসীর সংখ্যা সাতজনই ছিল। কোনো কোনো মত অনুযায়ী, তাদের নাম ছিল মুকসালমিনা, তামলিখা, মারতুনিস, সানুনিস, সারিনুনিস, যুনিওয়াস, কাস্তিতিউনিস। নামগুলো দেখে বোঝা যায়, রোমান নামের আরবিকরণ করা হয়েছে।

এবার চলুন আমরা শুনে আসি সেই সিরিয়ার উপকথাটি। পঞ্চম শতকের সিরিয়ান বিশপ জ্যাকব অফ স্যারাগ এর কাছ থেকে আমরা এই ঘটনার বর্ণনা পাই, তিনি আবার সেটা সংগ্রহ করেছেন আরো আগের গ্রিক কোনো সূত্র থেকে, সেই সূত্র কালের বিবর্তনে আজ হারিয়ে গিয়েছে। এছাড়াও আরো কয়েক জায়গায় আমরা এর দেখা পাই।

এ কাহিনী অনুযায়ী, আড়াইশ সালের দিকে রোমান সম্রাট ডিসিয়াস এর শাসনকালে (২৪৯-২৫১) সাতজন তরুণ ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান যুবককে ধর্মত্যাগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পৌত্তলিক রোমান সাম্রাজ্যে তাদের জোর করা হয় পুরনো দেবদেবীদের বিশ্বাসে ফিরে যেতে। তাদের সময় দেওয়া হয় পুরনো বিশ্বাসে ফেরত আসতে, কিন্তু তাঁরা তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং তাদের সকল সম্পদ গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দেন। এরপর তাঁরা পালিয়ে যান অক্লন পাহাড়ের এক গুহায়। সেখানে প্রার্থনা শেষে তাঁরা ঘুমিয়ে পড়েন। বলা আছে, গুহার খবর পাবার পর সম্রাট তাদের সেই গুহা সিলগালা করে দেন, যেন তাঁরা ক্ষুধায় মারা যান।

ডিসিয়াস মারা যান ২৫১ সালে। পৌত্তলিক রোমান সাম্রাজ্যের অত্যাচারিত খ্রিস্টানদের ধর্ম এক সময় রাজ্যের প্রধান ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি পায়, তবে সে অনেক অনেক বছর পরের কাহিনী। কাহিনীর একটি বর্ণনা মোতাবেক, সম্রাট দ্বিতীয় থিওডোসিয়াস (৪০৮-৪৫০) এর আমলে, গুহার সিলগালা ধ্বংস করা হয়। যিনি খুলেছিলেন, তিনি ভাবছিলেন ওটাকে গোয়ালঘর বানাবেন, তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি ভেতরে সাত জন যুবক ঘুমিয়ে। যুবকেরা ঘুম ভেঙে উঠলেন, তাঁরা ভাবলেন এক দিন পুরো ঘুমিয়ে উঠেছেন। তাদের একজনকে বাজারে পাঠানো হলো, সাবধানে বাজার করতে বলা হলো যেন কেউ চিনে না ফেলে তাদের, চিনে ফেললে অত্যাচারী রাজার পৌত্তলিক অনুসারীরা তাদের গ্রেফতার করবেন। কিন্ত শহরে গিয়ে তো যুবক ম্যাল্কাস তো অবাক! আশপাশে ক্রুশ লাগানো দালানকোঠা, লোকে প্রকাশ্যেই যীশুর নাম করছে! আবার দোকানি তাঁর মুদ্রাও নিচ্ছে না, এটা নাকি অনেক পুরনো ডিসিয়াসের আমলের মুদ্রা।

বিশপ তাদের কাছ থেকে ঘটনা শুনলেন। ধর্মপ্রাণ সম্রাট নিজে এসে তাদের সাথে কথা বললেন। সম্রাট তাদের জন্য অনেক কিছু করতে চাইলেন, কিন্তু তাঁরা না করে দিয়ে সেই গুহায় গিয়েই ঘুমালেন এবং এক সময় মারা গেলেন। অর্থোডক্স খ্রিস্টান চার্চ এই সাত মহাপ্রাণকে বছরে দুদিন স্মরণ করে ভোজ করবার রীতি করে- আগস্ট ৪ এবং অক্টোবর ২২ তারিখে।

কুরআনে যে এফিসাস শহরের এই ঘটনাই বলা হচ্ছিল সে ব্যাপারে স্কলারগণ একমত। তবে ট্রাডিশনের জায়গায় জায়গায় রয়েছে কিছু পার্থক্য, কিন্তু অধিকাংশই মিলে যায়। দুটো ঘটনাই নিশ্চিত করে যে, একজন অত্যাচারী শাসক ছিলেন। সিরিয়ার উপাখ্যানে তো নামই বলে দেওয়া আছে। এও বলা আছে, ডিসিয়াসের শাস্তি এত ভয়ংকর ছিল যে, বন্ধু বন্ধুকে ভুলে যেত, পিতা ছেলেকে এবং ছেলে পিতাকে ভুলে যেত!

সিরিয়ান কাহিনীতে বলা আছে, গুহার বাইরে সম্রাট সিলগালা করার পাশাপাশি ফলকে লিখেও দিয়েছিলেন এই বিপথগামীদের কথা। ইবনে আব্বাস (রা) এই মতবাদ সমর্থন করেন।

তবে কুরআনে বলা হয়েছে তাদের ঘুমন্ত থাকবার সময় ৩০০ বছর, সাধারণ সৌর হিসেবে। তবে চান্দ্র হিসেবে অতিরিক্ত ৯ বছর ধরলে, সেটি ৩০৯। তৎকালীন চান্দ্র ক্যালেন্ডার ব্যবহারকারীগণ প্রতি একশ সৌর বছরের তিন বছর যোগ করে নিত। কিন্তু সিরিয়ার কাহিনীতে নিশ্চিত করে সময় বলা নেই। কোনো কোনো মতে সেটি ১৮৪ বছর, কোনো কোনো মতে দু’শো বছরের বেশি, কেউ কেউ বলেন ২০৮ বছর। তবে তাঁরা যে যুবক ছিলেন, সে ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই কোথাও। তাঁরা মনে করেছিলেন, তাঁরা মাত্র একদিনের মতো ঘুমিয়েছেন- এটাও সিরীয় কাহিনীতে বলা আছে। যে যুবক খাবার কিনতে গিয়েছিলেন, তাঁর নাম ম্যাল্কাস এবং তিনি একটি রুপার মুদ্রা নিয়ে গিয়েছিলেন।

 

তাদের নামগুলো ছিল Maximian, Malchus, Marcian, John, Denis, Serapion ও Constantine। ভিন্ন উচ্চারণ ও বানানে তাদের নামগুলো Maximilian, Jamblichus, Martin, John, Dionysius, Antonius এবং Constantine।

এফিসাস শহরের বাইরের সেই গুহার এলাকায় ১৯২৭-১৯৩০ সালের দিকে প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানচালানো হয়, সেখানে ২,০০০ টেরাকোটা ল্যাম্প পাওয়া যায়, যেগুলো চার্চের জন্য উৎসর্গ করা ছিল। কার্বন ডেটিংয়ে সেগুলো চতুর্থ বা পঞ্চম শতকের বলে নির্ধারিত হয়। এর মানে, সেখানে চার্চ বানিয়েছিল স্থানীয়রা। ল্যাম্পগুলোর গায়ে ছিল ক্রুশের ছবি, কোনো কোনোটার গায়ে ছিল আদম-হাওয়া থেকে শুরু করে তাওরাতের মহারথীদের ছবি- যেমন ইব্রাহিম (আ), ইসহাক (আ) এবং সিংহের গুহায় দানিয়েল (আ)। এছাড়াও সামাজিক ছবিও ছিল, যেমন জেলেদের কাজ বা সবাই মিলে কোনো অনুষ্ঠান উপভোগের ছবি। কিন্তু এগুলোর পাশে হারকিউলিস ও সিংহ, জিউস ও আফ্রোদিতি, মন্দিরের ছবি ও দেবতা আত্তিসের মাথার ছবিও ছিল। অর্থাৎ এগুলোর নির্মাতারা নব্য খ্রিস্টান হলেও আদি রোমান সংস্কৃতি ফেলে আসেনি। ঐতিহাসিক বিশ্লেষকগণ অবশ্য এ ঘটনার কোনো নিশ্চয়তা দেন না এবং রিপ ভ্যান উইংকেলের শত বছরের ঘুমের সাথে সাদৃশ্য দেখিয়ে থাকেন। উল্লেখ্য, আসহাবে কাহাফ নিয়ে ইরানে জনপ্রিয় একটি টিভি সিরিজ ‘দ্য মেন অফ অ্যাঞ্জেলোস’ নির্মাণ করা হয়।

তুরস্কের এই শহরটির বাইরে গেলে গুহাটি দেখতে পাওয়া যায়। তবে জর্ডানের আম্মানের কাছেও ১৯৬৩ সালে বের করা আরেকটি জায়গাকে আসহাবে কাহাফের জায়গা বলে দাবি করা হয়। এ জায়গাকে আল রাকীম ডাকা হয়। তবে স্থানীয় বর্ণনা ছাড়া আর কোনো ঐতিহাসিক সূত্র এটির ব্যাপারে পাওয়া যায় না, যার সাথে কোনোভাবে সেভেন স্লিপার্স (খ্রিস্টানরা এ নামেই ডাকে এ ঘটনাকে) এর ঘটনার মিল করা যায়। দাবি করা হয়, এখানে নাকি সাতজনের কঙ্কাল এবং একটি কুকুরের কঙ্কালও পাওয়া গেছে, আর সাথে ছিল কিছু তামার মুদ্রা। তবে সেগুলোর কার্বন ডেটিং করে সময়ের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি। সেই গুহায় চারজনের কবর করবার জায়গা পাওয়া গেছে, যার দ্বারা বোঝা যায়, ওটা সাতজনের কিছু ছিল না।

এসব ছাড়াও অনেক মুসলিম দেশের অনেক স্থানকেই আসহাবে কাহাফের জায়গা বলে দাবি করা হয়েছে- যেমন, তুরস্কের আম্মুরিয়াগ হায হামজা, টারসাস, মিসরের কায়রোতে, এমনকি উত্তর আফ্রিকা কিংবা চীনেও! মূলত পেছনের কাহিনী না জেনে হরহামেশা ধর্মীয় রেলিক পাবার দাবিদাওয়া করবার কারণেই পৃথিবীর নানা প্রান্তে এরকম দেখা যায়। অথচ কুরআনের বর্ণনা মতেই জানা যায় যে, এই ঘটনাটি আরবদের কাছে অজানা হলেও বিদেশি লোকদের অজানা ছিল না, অন্তত যে এফিসাসে কাহিনী হয়েছিল, সেখানে যে সেটি খুবই জনপ্রিয় ছিল, তা তো বলবার অপেক্ষা রাখে না।

 

সংগৃহীত

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» কুয়েতে মুরাদুল হক চৌধুরীকে সম্মাননা

» তাপপ্রবাহ: প্রাথমিক বিদ্যালয় ৭ দিন বন্ধ ঘোষণা

» মালয়েশিয়ায় ই-পাসপোর্ট সেবা উদ্বোধন

» কুয়েতে সংবর্ধিত হলেন মুরাদুল হক চৌধুরী

» সংযুক্ত আরব আমিরাতে ঝড়বৃষ্টিতে মৃত বেড়ে ৪

» তাপদাহ: প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলি বন্ধের নির্দেশ

» কুয়েতে প্রবাসী নারীদের সংগঠন উদযাপন করেছে পহেলা বৈশাখ

» কুয়েত বাংলাদেশ কমিউনিটির ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠিত

» কুয়েতে বাংলাদেশ ভবনে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে প্রবাসীদের শুভেচ্ছা বিনিময়

» মালয়েশিয়ার মিনি ঢাকায় ‘রেস্টুরেন্ট মনির ভাই’ উদ্বোধন

Agrodristi Media Group

Advertising,Publishing & Distribution Co.

Editor in chief & Agrodristi Media Group’s Director. AH Jubed
Legal adviser. Advocate Musharrof Hussain Setu (Supreme Court,Dhaka)
Editor in chief Health Affairs Dr. Farhana Mobin (Square Hospital, Dhaka)
Social Welfare Editor: Rukshana Islam (Runa)

Head Office

UN Commercial Complex. 1st Floor
Office No.13, Hawally. KUWAIT
Phone. 00965 65535272
Email. agrodristi@gmail.com / agrodristitv@gmail.com

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
,

আসহাবে কাহাফ: ঘুমন্ত সেই গুহাবাসীদের কাহিনী

জনাকয়েক পলাতক যুবক, একটি গুহা আর তিন শতাব্দীর নিদ্রা- আসহাবে কাহাফের কাহিনী কেবল মুসলিমদের কাছেই প্রবল জনপ্রিয় একটি ঘটনা নয়, বরং খ্রিস্টানদের কাছেও ছিল খুব জনপ্রিয় ও অলৌকিক ঘটনা। কুরআনে বর্ণিত এই কাহিনীর সাথে সাথে সেই সিরিয়ান উপাখ্যান এবং যে নগরীতে এই ঘটনা ঘটেছিল- সবই আমরা এ লেখায় আলোচনা করার চেষ্টা করব।

শুরুতেই বলে রাখা দরকার, এই ঘটনাটি কুরআনে বর্ণিত বিধায়, মুসলিমদের বিশ্বাস ওতপ্রোতভাবে এর সাথে জড়িত। অনেক পাঠকই অভিযোগ করে থাকেন বিধায়, কুরআনের আয়াত বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করার সময় কেবল ইসলামিক সূত্র ব্যবহার করা হবে, এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে তাফসির ইবনে কাসিরের বঙ্গানুবাদের চতুর্দশ খণ্ড। তবে কুরআনে যে ঘটনার বর্ণনা করা হয়েছে, সেটি কুরআন অবতরণের কয়েক শতাব্দী আগের ঘটনা এবং সেটার বিস্তারিত বিবরণও দেওয়া হবে, সেজন্য আমরা ব্যবহার করব ৫ম শতকের স্থানীয় সিরীয় উপকথা, ঠিক যেমনটা লিপিবদ্ধ ছিল। কাহিনীগুলোর পার্থক্য তখনই প্রতীয়মান হবে। তাহলে প্রথমে শুরু করা যাক কুরআনে বলা ঘটনাটি দিয়ে।

কুরআনের ১৮ নম্বর সুরা ‘সুরা কাহাফ’ মক্কাতে অবতীর্ণ হয়; অর্থাৎ তখনও নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) ও তাঁর অনুসারীরা মদিনায় চলে যাননি। কিন্তু মক্কাতে তখন তাঁর অনুসারীর সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে দেখে কুরাইশরা খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ে। যেহেতু নবী (সা) এমন ধর্ম প্রচার করে চলেছিলেন, যেখানে আগের নবীদের সাথে ইহুদি-খ্রিস্টানদের নবীরা মিলে যায়, তাই কুরাইশ নেতারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, তাঁরা ইহুদি র‍্যাবাইদের (আলেম) সাথে পরামর্শ করবে। নাযার ইবনে হারিস এবং উকবা ইবনে মুয়িত নামের দুজনকে তাঁরা মদিনার ইহুদি র‍্যাবাইদের কাছে প্রেরণ করে এই বলে যে, তাঁরা যেন মুহাম্মাদ (সা) এর ব্যাপারে তাদের মতামত জানায়।

তারা মদিনা পৌঁছালে ইহুদি আলেমরা তাদের কথা শুনে মীমাংসা করার জন্য একটি উপায় বাতলে দেন,

“দেখো, আমরা তোমাদের মীমাংসা করার জন্য একটি কথা বলছি। তোমরা ফিরে গিয়ে তাঁকে তিনটি প্রশ্ন করবে। তিনি যদি উত্তর দিতে পারেন, তবে তিনি যে সত্য নবী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর না দিতে পারলে তিনি মিথ্যেবাদী। প্রথম প্রশ্ন: পূর্বযুগে যে যুবকেরা বেরিয়ে গিয়েছিলেন তাদের ঘটনা বর্ণনা করুন তো? এ এক বিস্ময়কর ঘটনা…”

এরকম আরো দুটি প্রশ্ন তাঁরা করতে বলেন। বাকি ঘটনা এখানে আমরা লিখছি না, তবে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর হিসেবেই অবতীর্ণ হয় সুরা কাহাফ (‘গুহা’)

‘আসহাবে কাহাফ’ অর্থ ‘গুহাবাসী’। এ ঘটনা ঘটেছিল প্রাচীন গ্রিক শহর আনাতোলিয়া বা এফিসাসে (Ephesus)। কাছেই ছিল গ্রিক দেবী আরটেমিসের বিখ্যাত মন্দির। বর্তমানে ভৌগোলিকভাবে শহরটি তুরস্কে পড়েছে। তবে কুরআনে অবশ্য নাম-ঠিকানা উল্লেখ করা নেই।

প্রথমে কুরআনের ভাষ্যতেই কাহিনী শুনে নেয়া যাক।

তুমি কি ধারণা করো যে, গুহা ও রাকীমের অধিবাসীরা আমার নিদর্শনাবলীর মধ্যে বিস্ময়কর ছিল? যখন যুবকেরা পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করে তখন দোয়া করে: “হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদেরকে নিজের কাছ থেকে রহমত দান করুন এবং আমাদের জন্য আমাদের কাজ সঠিকভাবে পূর্ণ করুন।” তখন আমি কয়েক বছরের জন্য গুহায় তাদের ঘুমন্ত অবস্থায় রাখলাম। অতঃপর আমি তাদেরকে পুনরুত্থিত করি, একথা জানার জন্যে যে, দুই দলের মধ্যে কোন দল তাদের অবস্থানকাল সম্পর্কে অধিক নির্ণয় করতে পারে। আপনার কাছে তাদের ইতিবৃত্তান্ত সঠিকভাবে বর্ণনা করছি। তারা ছিল কয়েকজন যুবক। তারা তাদের পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল এবং আমি তাদের সৎপথে চলার শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আমি তাদের মন দৃঢ় করেছিলাম, যখন তারা উঠে দাঁড়িয়েছিল। অতঃপর তারা বলল: “আমাদের পালনকর্তা আসমান ও যমীনের পালনকর্তা, আমরা কখনও তার পরিবর্তে অন্য কোনো উপাস্যকে আহবান করব না। যদি করি, তবে তা অত্যন্ত গর্হিত কাজ হবে। এরা আমাদেরই স্ব-জাতি, এরা তাঁর পরিবর্তে অনেক উপাস্য গ্রহণ করেছে। তারা এদের সম্পর্কে প্রকাশ্য প্রমাণ উপস্থিত করে না কেন? যে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা উদ্ভাবন করে, তার চাইতে অধিক পাপী আর কে?” তোমরা যখন তাদের থেকে পৃথক হলে এবং তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের এবাদত করে তাদের থেকে, তখন তোমরা গুহায় আশ্রয় গ্রহণ কর। তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের জন্যে দয়া বিস্তার করবেন এবং তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের কাজকর্মকে ফলপ্রসু করার ব্যবস্থা করবেন। তুমি সূর্যকে দেখবে, যখন উদিত হয়, তাদের গুহা থেকে পাশ কেটে ডান দিকে চলে যায় এবং যখন অস্ত যায়, তাদের থেকে পাশ কেটে বাম দিকে চলে যায়, অথচ তারা গুহার প্রশস্ত চত্বরে অবস্থিত। এটা আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্যতম… তুমি মনে করবে তারা জাগ্রত, অথচ তারা নিদ্রিত। আমি তাদেরকে পার্শ্ব পরিবর্তন করাই ডান দিকে ও বাম দিকে। তাদের কুকুর ছিল সামনের পা দুটি গুহাদ্বারে প্রসারিত করে। যদি তুমি উঁকি দিয়ে তাদেরকে দেখতে, তবে পেছন ফিরে পলায়ন করতে এবং তাদের ভয়ে আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়তে। আমি এমনিভাবে তাদেরকে জাগ্রত করলাম, যাতে তারা পরস্পর জিজ্ঞাসাবাদ করে। তাদের একজন বলল: “তোমরা কতকাল অবস্থান করেছ?” তাদের কেউ বলল: “একদিন অথবা একদিনের কিছু অংশ অবস্থান করছি।” কেউ কেউ বলল: “তোমাদের পালনকর্তাই ভালো জানেন তোমরা কতকাল অবস্থান করেছ। এখন তোমাদের একজনকে তোমাদের এই মুদ্রাসহ শহরে প্রেরণ কর; সে যেন দেখে কোন খাদ্য পবিত্র। অতঃপর তা থেকে যেন কিছু খাদ্য নিয়ে আসে তোমাদের জন্য; সে যেন নম্রতা সহকারে যায় ও কিছুতেই যেন তোমাদের খবর কাউকে না জানায়। তারা যদি তোমাদের খবর জানতে পারে, তবে পাথর মেরে তোমাদেরকে হত্যা করবে, অথবা তোমাদেরকে তাদের ধর্মে ফিরিয়ে নেবে। তাহলে তোমরা কখনই সাফল্য লাভ করবে না।” এমনিভাবে আমি তাদের খবর প্রকাশ করে দিলাম, যাতে তারা জ্ঞাত হয় যে, আল্লাহর ওয়াদা সত্য এবং কেয়ামতে কোনো সন্দেহ নেই। যখন তারা নিজেদের কর্তব্য বিষয়ে পরস্পর বিতর্ক করছিল, তখন তারা বলল: “তাদের উপর সৌধ নির্মাণ কর।” তাদের পালনকর্তা তাদের বিষয়ে ভালো জানেন। তাদের কর্তব্য বিষয়ে যাদের মত প্রবল হল, তারা বলল: “আমরা অবশ্যই তাদের স্থানে উপাসনালয় নির্মাণ করব।” অজ্ঞাত বিষয়ে অনুমানের উপর ভিত্তি করে এখন তারা বলবে: তারা ছিল তিন জন, তাদের চতুর্থটি তাদের কুকুর। একথাও বলবে, তারা পাঁচ জন। তাদের ছষ্ঠটি ছিল তাদের কুকুর। আরও বলবে, তারা ছিল সাত জন। তাদের অষ্টমটি ছিল তাদের কুকুর। বলুন: আমার পালনকর্তা তাদের সংখ্যা ভালো জানেন। তাদের খবর অল্প লোকই জানে। সাধারণ আলোচনা ছাড়া তুমি তাদের সম্পর্কে বিতর্ক করবে না এবং তাদের অবস্থা সম্পর্কে তাদের কাউকে জিজ্ঞাসাবাদও করবে না… তাদের উপর তাদের গুহায় তিনশ বছর, অতিরিক্ত আরও নয় বছর অতিবাহিত হয়েছে। বল: তারা কতকাল অবস্থান করেছে, তা আল্লাহই ভালো জানেন। নভোমণ্ডল ও ভুমণ্ডলের অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান তাঁরই কাছে রয়েছে।” [আল কুরআন ১৮:৯-২৬]

এটুকুই কুরআন কাহিনীটি সম্পর্কে জানায়। এ বিষয়ে তাফসিরে রয়েছে অনেক অনেক বক্তব্য। যেমন- ইবনে কাসিরে একটি মতবাদ লিখিত আছে যে, উপরে আয়াতে লিখা ‘রাকীম’ বলতে ফলকে লেখা বোঝায়, গুহার বাইরে কি কোনো ফলকে করে লিখে দেওয়া হয়েছিল? আমরা কিছুক্ষণ পরেই সেটা জানতে পারব। ইবনে কাসিরে এ-ও লিখা আছে যে, যে অত্যাচারী শাসকের তাড়ায় যুবকেরা পালিয়ে যায়, তার নাম ছিল দাকইয়ানুস। তাছাড়া, যে কুকুরটি তাদের সাথে ছিল, সেটি রাজবাবুর্চির কুকুর ছিল, কুকুরের নাম কিতমির। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) নিশ্চিত করে বলেন যে, গুহাবাসীর সংখ্যা সাতজনই ছিল। কোনো কোনো মত অনুযায়ী, তাদের নাম ছিল মুকসালমিনা, তামলিখা, মারতুনিস, সানুনিস, সারিনুনিস, যুনিওয়াস, কাস্তিতিউনিস। নামগুলো দেখে বোঝা যায়, রোমান নামের আরবিকরণ করা হয়েছে।

এবার চলুন আমরা শুনে আসি সেই সিরিয়ার উপকথাটি। পঞ্চম শতকের সিরিয়ান বিশপ জ্যাকব অফ স্যারাগ এর কাছ থেকে আমরা এই ঘটনার বর্ণনা পাই, তিনি আবার সেটা সংগ্রহ করেছেন আরো আগের গ্রিক কোনো সূত্র থেকে, সেই সূত্র কালের বিবর্তনে আজ হারিয়ে গিয়েছে। এছাড়াও আরো কয়েক জায়গায় আমরা এর দেখা পাই।

এ কাহিনী অনুযায়ী, আড়াইশ সালের দিকে রোমান সম্রাট ডিসিয়াস এর শাসনকালে (২৪৯-২৫১) সাতজন তরুণ ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান যুবককে ধর্মত্যাগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পৌত্তলিক রোমান সাম্রাজ্যে তাদের জোর করা হয় পুরনো দেবদেবীদের বিশ্বাসে ফিরে যেতে। তাদের সময় দেওয়া হয় পুরনো বিশ্বাসে ফেরত আসতে, কিন্তু তাঁরা তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং তাদের সকল সম্পদ গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দেন। এরপর তাঁরা পালিয়ে যান অক্লন পাহাড়ের এক গুহায়। সেখানে প্রার্থনা শেষে তাঁরা ঘুমিয়ে পড়েন। বলা আছে, গুহার খবর পাবার পর সম্রাট তাদের সেই গুহা সিলগালা করে দেন, যেন তাঁরা ক্ষুধায় মারা যান।

ডিসিয়াস মারা যান ২৫১ সালে। পৌত্তলিক রোমান সাম্রাজ্যের অত্যাচারিত খ্রিস্টানদের ধর্ম এক সময় রাজ্যের প্রধান ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি পায়, তবে সে অনেক অনেক বছর পরের কাহিনী। কাহিনীর একটি বর্ণনা মোতাবেক, সম্রাট দ্বিতীয় থিওডোসিয়াস (৪০৮-৪৫০) এর আমলে, গুহার সিলগালা ধ্বংস করা হয়। যিনি খুলেছিলেন, তিনি ভাবছিলেন ওটাকে গোয়ালঘর বানাবেন, তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি ভেতরে সাত জন যুবক ঘুমিয়ে। যুবকেরা ঘুম ভেঙে উঠলেন, তাঁরা ভাবলেন এক দিন পুরো ঘুমিয়ে উঠেছেন। তাদের একজনকে বাজারে পাঠানো হলো, সাবধানে বাজার করতে বলা হলো যেন কেউ চিনে না ফেলে তাদের, চিনে ফেললে অত্যাচারী রাজার পৌত্তলিক অনুসারীরা তাদের গ্রেফতার করবেন। কিন্ত শহরে গিয়ে তো যুবক ম্যাল্কাস তো অবাক! আশপাশে ক্রুশ লাগানো দালানকোঠা, লোকে প্রকাশ্যেই যীশুর নাম করছে! আবার দোকানি তাঁর মুদ্রাও নিচ্ছে না, এটা নাকি অনেক পুরনো ডিসিয়াসের আমলের মুদ্রা।

বিশপ তাদের কাছ থেকে ঘটনা শুনলেন। ধর্মপ্রাণ সম্রাট নিজে এসে তাদের সাথে কথা বললেন। সম্রাট তাদের জন্য অনেক কিছু করতে চাইলেন, কিন্তু তাঁরা না করে দিয়ে সেই গুহায় গিয়েই ঘুমালেন এবং এক সময় মারা গেলেন। অর্থোডক্স খ্রিস্টান চার্চ এই সাত মহাপ্রাণকে বছরে দুদিন স্মরণ করে ভোজ করবার রীতি করে- আগস্ট ৪ এবং অক্টোবর ২২ তারিখে।

কুরআনে যে এফিসাস শহরের এই ঘটনাই বলা হচ্ছিল সে ব্যাপারে স্কলারগণ একমত। তবে ট্রাডিশনের জায়গায় জায়গায় রয়েছে কিছু পার্থক্য, কিন্তু অধিকাংশই মিলে যায়। দুটো ঘটনাই নিশ্চিত করে যে, একজন অত্যাচারী শাসক ছিলেন। সিরিয়ার উপাখ্যানে তো নামই বলে দেওয়া আছে। এও বলা আছে, ডিসিয়াসের শাস্তি এত ভয়ংকর ছিল যে, বন্ধু বন্ধুকে ভুলে যেত, পিতা ছেলেকে এবং ছেলে পিতাকে ভুলে যেত!

সিরিয়ান কাহিনীতে বলা আছে, গুহার বাইরে সম্রাট সিলগালা করার পাশাপাশি ফলকে লিখেও দিয়েছিলেন এই বিপথগামীদের কথা। ইবনে আব্বাস (রা) এই মতবাদ সমর্থন করেন।

তবে কুরআনে বলা হয়েছে তাদের ঘুমন্ত থাকবার সময় ৩০০ বছর, সাধারণ সৌর হিসেবে। তবে চান্দ্র হিসেবে অতিরিক্ত ৯ বছর ধরলে, সেটি ৩০৯। তৎকালীন চান্দ্র ক্যালেন্ডার ব্যবহারকারীগণ প্রতি একশ সৌর বছরের তিন বছর যোগ করে নিত। কিন্তু সিরিয়ার কাহিনীতে নিশ্চিত করে সময় বলা নেই। কোনো কোনো মতে সেটি ১৮৪ বছর, কোনো কোনো মতে দু’শো বছরের বেশি, কেউ কেউ বলেন ২০৮ বছর। তবে তাঁরা যে যুবক ছিলেন, সে ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই কোথাও। তাঁরা মনে করেছিলেন, তাঁরা মাত্র একদিনের মতো ঘুমিয়েছেন- এটাও সিরীয় কাহিনীতে বলা আছে। যে যুবক খাবার কিনতে গিয়েছিলেন, তাঁর নাম ম্যাল্কাস এবং তিনি একটি রুপার মুদ্রা নিয়ে গিয়েছিলেন।

 

তাদের নামগুলো ছিল Maximian, Malchus, Marcian, John, Denis, Serapion ও Constantine। ভিন্ন উচ্চারণ ও বানানে তাদের নামগুলো Maximilian, Jamblichus, Martin, John, Dionysius, Antonius এবং Constantine।

এফিসাস শহরের বাইরের সেই গুহার এলাকায় ১৯২৭-১৯৩০ সালের দিকে প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানচালানো হয়, সেখানে ২,০০০ টেরাকোটা ল্যাম্প পাওয়া যায়, যেগুলো চার্চের জন্য উৎসর্গ করা ছিল। কার্বন ডেটিংয়ে সেগুলো চতুর্থ বা পঞ্চম শতকের বলে নির্ধারিত হয়। এর মানে, সেখানে চার্চ বানিয়েছিল স্থানীয়রা। ল্যাম্পগুলোর গায়ে ছিল ক্রুশের ছবি, কোনো কোনোটার গায়ে ছিল আদম-হাওয়া থেকে শুরু করে তাওরাতের মহারথীদের ছবি- যেমন ইব্রাহিম (আ), ইসহাক (আ) এবং সিংহের গুহায় দানিয়েল (আ)। এছাড়াও সামাজিক ছবিও ছিল, যেমন জেলেদের কাজ বা সবাই মিলে কোনো অনুষ্ঠান উপভোগের ছবি। কিন্তু এগুলোর পাশে হারকিউলিস ও সিংহ, জিউস ও আফ্রোদিতি, মন্দিরের ছবি ও দেবতা আত্তিসের মাথার ছবিও ছিল। অর্থাৎ এগুলোর নির্মাতারা নব্য খ্রিস্টান হলেও আদি রোমান সংস্কৃতি ফেলে আসেনি। ঐতিহাসিক বিশ্লেষকগণ অবশ্য এ ঘটনার কোনো নিশ্চয়তা দেন না এবং রিপ ভ্যান উইংকেলের শত বছরের ঘুমের সাথে সাদৃশ্য দেখিয়ে থাকেন। উল্লেখ্য, আসহাবে কাহাফ নিয়ে ইরানে জনপ্রিয় একটি টিভি সিরিজ ‘দ্য মেন অফ অ্যাঞ্জেলোস’ নির্মাণ করা হয়।

তুরস্কের এই শহরটির বাইরে গেলে গুহাটি দেখতে পাওয়া যায়। তবে জর্ডানের আম্মানের কাছেও ১৯৬৩ সালে বের করা আরেকটি জায়গাকে আসহাবে কাহাফের জায়গা বলে দাবি করা হয়। এ জায়গাকে আল রাকীম ডাকা হয়। তবে স্থানীয় বর্ণনা ছাড়া আর কোনো ঐতিহাসিক সূত্র এটির ব্যাপারে পাওয়া যায় না, যার সাথে কোনোভাবে সেভেন স্লিপার্স (খ্রিস্টানরা এ নামেই ডাকে এ ঘটনাকে) এর ঘটনার মিল করা যায়। দাবি করা হয়, এখানে নাকি সাতজনের কঙ্কাল এবং একটি কুকুরের কঙ্কালও পাওয়া গেছে, আর সাথে ছিল কিছু তামার মুদ্রা। তবে সেগুলোর কার্বন ডেটিং করে সময়ের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি। সেই গুহায় চারজনের কবর করবার জায়গা পাওয়া গেছে, যার দ্বারা বোঝা যায়, ওটা সাতজনের কিছু ছিল না।

এসব ছাড়াও অনেক মুসলিম দেশের অনেক স্থানকেই আসহাবে কাহাফের জায়গা বলে দাবি করা হয়েছে- যেমন, তুরস্কের আম্মুরিয়াগ হায হামজা, টারসাস, মিসরের কায়রোতে, এমনকি উত্তর আফ্রিকা কিংবা চীনেও! মূলত পেছনের কাহিনী না জেনে হরহামেশা ধর্মীয় রেলিক পাবার দাবিদাওয়া করবার কারণেই পৃথিবীর নানা প্রান্তে এরকম দেখা যায়। অথচ কুরআনের বর্ণনা মতেই জানা যায় যে, এই ঘটনাটি আরবদের কাছে অজানা হলেও বিদেশি লোকদের অজানা ছিল না, অন্তত যে এফিসাসে কাহিনী হয়েছিল, সেখানে যে সেটি খুবই জনপ্রিয় ছিল, তা তো বলবার অপেক্ষা রাখে না।

 

সংগৃহীত

Facebook Comments Box


এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



আজকের দিন-তারিখ

  • বুধবার (সকাল ১১:৩৩)
  • ২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ১৪ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি
  • ১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (গ্রীষ্মকাল)

Exchange Rate

Exchange Rate EUR: বুধ, ২৪ এপ্রি.

সর্বশেষ খবর



Agrodristi Media Group

Advertising,Publishing & Distribution Co.

Editor in chief & Agrodristi Media Group’s Director. AH Jubed
Legal adviser. Advocate Musharrof Hussain Setu (Supreme Court,Dhaka)
Editor in chief Health Affairs Dr. Farhana Mobin (Square Hospital, Dhaka)
Social Welfare Editor: Rukshana Islam (Runa)

Head Office

UN Commercial Complex. 1st Floor
Office No.13, Hawally. KUWAIT
Phone. 00965 65535272
Email. agrodristi@gmail.com / agrodristitv@gmail.com

Bangladesh Office

Director. Rumi Begum
Adviser. Advocate Koyes Ahmed
Desk Editor (Dhaka) Saiyedul Islam
44, Probal Housing (4th floor), Ring Road, Mohammadpur,
Dhaka-1207. Bangladesh
Contact: +8801733966556 / +8801920733632

Email Address

agrodristi@gmail.com, agrodristitv@gmail.com

Licence No.

MC- 00158/07      MC- 00032/13

Design & Devaloped BY Popular-IT.Com
error: দুঃখিত! অনুলিপি অনুমোদিত নয়।