বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি গান— চুমকি চলেছে একা পথে। ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে ছুটে চলা নায়িকাকে উদ্দেশ্য করে এই গান গাইতে গাইতে বাইসাইকেল চালিয়ে ধাওয়া করে নায়ক। গানের এক পর্যায়ে সাইকেল ফেলে নায়কও চড়ে বসে ঘোড়ার গাড়িতে। এক পর্যায়ে ক্ষুব্ধ মুখ করে থাকা নায়িকাকে জড়িয়ে ধরে।
নারীকে উত্যক্ত করা নিয়ে এ ধরণের আরো অনেক গান বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়েছে। কিন্তু নারীকে হয়রানির এই চিত্রায়ন কি একটি বিনোদনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে?
কারণ সিনেমাতেও প্রায়ই নারীকে শারীরিক হয়রানি বা নিপীড়নের দৃশ্য দেখা যায়।
বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় এবং ব্যবসা সফল সিনেমা ‘মোল্লা বাড়ির বউ’ এ দেখা যায়, সিনেমার মূল নারী চরিত্রের অভিনেতার পরপর দুইবার গর্ভপাত হওয়ায়, তাকে জ্বিনে ধরেছে –ধারণা করে জ্বিন চিকিৎসার জন্য ওঝা নিয়ে আসা হয়। সেই ওঝা এসেই বকুলকে কয়েকটি থাপ্পর দেয়। এরপর পালাক্রমে ঝাড়ু দিয়ে পেটানো, কয়লায় শুকনা মরিচ পুড়িয়ে শোকানো চলতে থাকে।
ঘটনা দেখতে আসে আশেপাশের বহু মানুষ। কিন্তু এই পুরো প্রক্রিয়ায় কোনো একজন মানুষ প্রতিবাদ করে না।
কিন্তু যারা এ ধরণের গান শুনছেন বা সিনেমার দৃশ্য দেখছেন—তারা কী ভাবছেন? জানতে চেয়েছিলাম কয়েকজন দর্শকের কাছে, যারা নিয়মিত সিনেমা দেখেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শকেরা জানিয়েছেন, এ ধরণের দৃশ্য খুবই স্বাভাবিক সিনেমার দৃশ্য। কারণ বাস্তবেও পরিবারে বা সমাজে এমনটা ঘটে, তাই তাদের উদ্ভটও লাগে না।
বাংলাদেশে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা দিনদিন বাড়ছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এক জরিপ বলছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে প্রায় আট হাজার নারী ও শিশু শারীরিক ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, অর্থাৎ দিনে অন্তত ২০জন নারী কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
এর মধ্যে ৮০ শতাংশ নারীর বয়স ১৮ থেকে ৩৫ এর মধ্যে। বাকি ২০ শতাংশ ১৮ বছরের কম বয়েসী, বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী যাদের শিশু বলা হয়। আর এই সংখ্যার অর্ধেকের বেশি নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার, যা বেশিরভাগ সময়ই পরিবারের মানুষের হাতে হয়।
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী যেকোনো বয়সের নারীকে হয়রানি, উত্যক্ত করা এবং নির্যাতন—এসব শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু তারপরও কেন সেটা দর্শকের মনে কোন প্রতিরোধ তৈরি করে না?
চলচ্চিত্র সমালোচক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাবরিনা সুলতানা চৌধুরী বলছিলেন, মানুষ এগুলোকে এখন স্বাভাবিক মনে করছে।
“দীর্ঘদিন ধরে নারীকে দুর্বল, নির্ভরশীলভাবে উপস্থাপনের ফলে এটা হয়েছে। সেই সঙ্গে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। সিনেমা বা নাটকের স্ক্রিপ্ট লেখা থেকে, পরিচালনা, ক্যামেরা চালানো–সবই হয় পুরুষের দৃষ্টিতে। ফলে পুরুষ যেভাবে দেখতে চায়, তেমনটাই দেখানো হয়।”
“এর মধ্যে নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়টি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এটা একদিনে হয়নি, দিনের পর দিন নারীকে ওভাবেই চিত্রায়ন করা হয়েছে।”
মিজ চৌধুরি বলছেন, নাটক সিনেমায় উপস্থাপিত নানা ধরণের ঘটনা বাস্তবে অনুকরণ ও অনুসরনের চেষ্টা করে মানুষ। এর ফলে অনেক সময় পরোক্ষভাবে সমাজে নির্যাতন এবং হয়রানিকে উৎসাহিত করে বলেও তিনি মনে করেন।
কিন্তু যেসব অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা এইসব দৃশ্যে অভিনয় করেন তারা বিষয়টিকে কিভাবে দেখেন? জানতে চেয়েছিলাম চলচ্চিত্র অভিনেত্রী অপু বিশ্বাসের কাছে –
“আমাদের যেভাবে যে চরিত্র করতে বলা হয়, যে ‘অ্যাটিচুড’ করতে বলা হয়, আমরা তাই করি। এই উপস্থাপন কেবলই বিনোদন। তবে সমাজে এ ধরণের চিত্রায়নের প্রভাব পড়ে।”
কিন্তু যারা সিনেমা ও নাটকগুলো দেখছেন, অভিনেতারা তাদের ভক্তদের সামনে যা তুলে ধরছেন, সেটা কি ভক্তদের কোনভাবে প্রভাবিত করে?
সেক্ষেত্রে জনপ্রিয় একজন নায়ক হিসেবে বিষয়টি কতটা ভাবায় একজন অভিনেতাকে? জানতে চেয়েছিলাম অভিনেতা রিয়াজের কাছে।
“কয়েক বছর হলো আমি সচেতন হয়েছি। যেমন আমি পর্দায় সিগারেট খাইনা, মদপান করি না। আমি জানি অনেক মানুষ আমাদের ফলো করে, ফলে আমার একটা দায়িত্ব আছে।”
কিন্তু ব্র্যাকের জরিপ বলছে, ২০১৬ সালে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়েসী মেয়েশিশুদের ৬২ শতাংশ রাস্তায় উত্ত্যক্ত করা, প্রেমে সাড়া না দেয়ায় হুমকি, অপহরণ এবং ধর্ষণের শিকারসহ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
কিন্তু তাহলে প্রশ্ন জাগে, একজন নির্মাতা বা পরিচালক কিভাবে দেখেন পুরো বিষয়টিকে? তাদের এক অংশ মনে করেন, বাস্তবতার প্রতিফলনই দেখানোই তাদের কাজ।
অন্যদিকে, একজন নির্মাতার সামাজিক দায়িত্বও রয়েছে বলেও মনে করেন কেউকেউ।
যেমন এক সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী, এবং বন্ধন ও ডলস হাউজের মত জনপ্রিয় সিরিয়ালের নির্মাতা আফসানা মিমি বলছিলেন “নারীর দুর্বল উপস্থাপন একদিনে হয়নি। সহিংতার প্রচারও একদিনে এখানে আসেনি। আমাদের দায়িত্বে অবহেলাই আজকের এই অবস্থা তৈরি করেছে।”
যদিও আফসানা মিমি বলছেন তিনি নিজে চেষ্টা করেন, যাতে নারীকে অসম্মানজনকভাবে উপস্থাপন না করা হয়। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই তাকে টেলিভিশন চ্যানেল কর্তৃপক্ষের খবরদারির শিকার হতে হয়েছে বলে তিনি বিবিসিকে জানিয়েছেন।
“আমি ২০১৪ সালে যখন ডলস হাউজের পরবর্তী একটি সিরিয়াল বানাচ্ছিলাম, আমাকে চ্যানেল থেকে বলা হলো আপনার নাটকের টিআরপি নাই। এরপর বলা হলো, আপনার নাটকে সুন্দর মেয়ে নাই। আমি ১৫ বছর ধরে নাটক নির্মাণ করছি, আমি তখন বুঝলাম তারা কেমন ধরণের চরিত্র চাইছে।”
কিন্তু, বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল জিটিভি ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমান আশরাফ ফায়েজ দাবি করেছেন, প্রচলিত আইনের বাইরে যাতে নারীকে অসম্মানজনকভাবে উপস্থাপন কিংবা নারীর ওপর নিপীড়ন মূলক দৃশ্য প্রদর্শন না করা হয়, সেজন্য টেলিভিশনের একটি প্রিভিউ কমিটি থাকে।
“আমাদের প্রিভিউ কমিটি দেখে ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা নারীর বিরুদ্ধে সহিংস কোন কন্টেন্ট যাচ্ছে কিনা। সব সময়ই যে সেটি ঠিক থাকে তা বলছি না। কিন্তু আমরা চেষ্টা করি আইনের মধ্যে থাকতে।”
এদিকে, সিনেমা, নাটকসহ বিনোদনের নানা মাধ্যমে নারীকে কিভাবে উপস্থাপন করা হবে, সে বিষয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের পরিষ্কার কোন নীতিমালা নেই। কিন্তু যেসব বিষয় দেখানো যাবে না, তার মধ্যে বলা আছে নারীর ওপর সহিংসতা হচ্ছে এমন কিছু দেখানো যাবেনা।
কিন্তু তাহলে নায়িকার পিছু নেয়া, উত্তক্ত করা কিংবা মারধরের দৃশ্য কিভাবে প্রদর্শিত হয়?
প্রশ্ন রেখেছিলাম সেন্সর বোর্ডের সদস্য ইফতেখার উদ্দিন নওশাদের কাছে।
তিনি বলছেন, সেন্সর বোর্ডের লোকবল ঘাটতির কারণে অনেক সময় জেলায় বা উপজেলায় সেন্সর বোর্ডের কেটে দেয়া অংশ জোড়া লাগিয়ে সিনেমা প্রদর্শন, যাকে ‘কাটপিস কালচার’ বলা হয়, তা চলছে কিনা তা মনিটর করা যায় না অনেক সময়।
যদিও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বলছে, সমাজের বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরার ক্ষেত্রে তারা আইন মেনেই কাজ করছেন।
কিন্তু যেহেতু সিনেমা ও নাটককে বলা হয়, যে কোন সমাজের প্রতিফলন। সেকারণে মিজ চৌধুরির মত চলচ্চিত্র সমালোচকেরা বলছেন, নারী চরিত্র নির্মানে পরিচালকদের আরো সচেতন হতে হবে। এবং সেক্ষেত্রে তাদের তৈরি নাটক ও সিনেমার মধ্য দিয়ে যাতে দর্শকের মননে পরিবর্তন আসে সে বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে।