২০০৪ সালের জুন মাসে সাদ্দাম হোসেনকে ইরাকি অন্তবর্তী সরকারের কাছে তুলে দেয়া হয় বিচারের জন্য। এর আগের বছর ডিসেম্বর মাসে মার্কিন বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে। জীবনের শেষ দিনগুলোতে তাকে পাহারা দিয়েছিলেন ১২ জন মার্কিন সৈন্য। বিবিসি হিন্দি’র জন্য সেই সময়ের দিকে ফিরে তাঁকিয়েছেন রেহান ফজল:
গ্রেফতার হওয়ার আগে তাঁরা যে সাদ্দাম হোসেনের ‘বন্ধু’ ছিলেন, সেটা মোটেই নয়।
কিন্তু ওই ১২ জন আমেরিকান সৈন্য সাদ্দামের শেষ সময়ের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। আক্ষরিক অর্থেই শেষ মুহূর্ত অবধি তাঁরাই ছিলেন সাদ্দামের সঙ্গে।
মার্কিন ৫৫১ নম্বর মিলিটারি পুলিশ কোম্পানির ওই ১২ জন সেনাসদস্যকে ‘সুপার টুয়েলভ’ বলে ডাকা হতো।
তাঁদেরই একজন, উইল বার্ডেনওয়ার্পার একটি বই লিখেছেন, ‘দা প্রিজনার ইন হিজ প্যালেস, হিজ অ্যামেরিকান গার্ডস, অ্যান্ড হোয়াট হিস্ট্রি লেফট আনসেইড’ নামে। বাংলা করলে বইটির নাম হতে পারে ‘নিজের প্রাসাদেই এক বন্দী, তাঁর আমেরিকান প্রহরী – ইতিহাস যে কথা বলেনি’।
বইটি জুড়ে রয়েছে সাদ্দাম হোসেনকে তাঁর শেষ সময় পর্যন্ত সুরক্ষা দেওয়ার অভিজ্ঞতা।
মি. বার্ডেনওয়ার্পার স্বীকার করেছেন যে তাঁরা যখন সাদ্দাম হোসেনকে জল্লাদদের হাতে তুলে দিলেন ফাঁসির জন্য, তখন তাঁদের ১২ জনেরই চোখে পানি এসে গিয়েছিল।
দাদুর মতো দেখতে লাগত সাদ্দামকে
বার্ডেনওয়ার্পার তাঁরই এক সেনা-সঙ্গী রজারসনকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন, “আমরা কখনও সাদ্দামকে মানসিক বিকারগ্রস্ত হত্যাকারী হিসাবে দেখিনি। তাঁর দিকে তাকালে নিজের দাদুর মতো লাগত অনেক সময়ে।”
ইরাকের জেলে জীবনের শেষ সময়টুকু কাটানোর সময়ে সাদ্দাম হোসেন আমেরিকান গায়িকা মেরি জে ব্লাইজার গান শুনতেন নিয়মিত।
নিজের এক্সারসাইজ বাইকে চড়তে পছন্দ করতেন সাদ্দাম। ওটার নাম দিয়েছিলেন ‘পনি’।
মিষ্টি খেতে খুব ভালবাসতেন। মাঝেমধ্যেই মাফিন খেতে চাইতেন।
বার্ডেনওয়ার্পার লিখেছেন, নিজের জীবনের শেষ দিনগুলোতে সাদ্দাম তাঁদের সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করতেন। ওই ব্যবহার দেখে বোঝাই যেত না যে সাদ্দাম হোসেন কোনও এক সময়ে একজন অত্যন্ত নিষ্ঠুর শাসক ছিলেন।
কাস্ত্রো তাঁকে সিগার খেতে শিখিয়েছিলেন
সাদ্দামের ‘কোহিবা’ সিগার খাওয়ার খুব নেশা ছিল। মনে করা হয় কিউবার সিগারের মধ্যে এই ‘কোহিবা’ সবার চেয়ে সেরা সিগারগুলোর অন্যতম।
ভেজা ওয়াইপে জড়িয়ে একটা বাক্সের মধ্যে রাখা থাকত সিগারগুলো।
সাদ্দাম নিজেই বলেছিলেন যে বহু বছর আগে ফিদেল কাস্ত্রো তাকে সিগার খাওয়া শিখিয়েছিলেন।
সিগার ছাড়াও বাগান করা আরেকটা শখ ছিল সাদ্দাম হোসেনের।
জেলের ভেতরে অযত্নে ফুটে থাকা জংলী ঝোপঝাড়গুলোকেও তিনি একটা সুন্দর ফুলের মতো মনে করতেন।
খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে খুবই সংবেদনশীল ছিলেন সাদ্দাম
সকালের নাস্তাটা তিনি কয়েকটা ভাগে খেতেন – প্রথমে অমলেট, তারপর মাফিন আর শেষে তাজা ফল।
ভুল করেও যদি তাঁর অমলেটটা টুকরো হয়ে যেত, সেটা তিনি খেতে অস্বীকার করতেন।
বার্ডেনওয়ার্পার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে লিখেছেন: একবার সাদ্দাম তার ছেলে উদয় কতটা নিষ্ঠুর ছিল, সেটা বোঝাতে গিয়ে বীভৎস একটা ঘটনার কথা বলেছিলেন। ওই ব্যাপারটায় সাদ্দাম প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন।
উদয় কোনও একটা পার্টিতে গিয়ে গুলি চালিয়ে দিয়েছিল – তাতে বেশ কয়েকজন মারা গিয়েছিলেন। গুলিতে আহত হয়েছিলেন আরও কয়েকজন।
সাদ্দাম ব্যাপারটা জানতে পেরে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে উদয়ের সবক’টা গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিতে। ওই ঘটনাটা বলতে গিয়ে সেনা প্রহরীদের সাদ্দাম ভীষণ রেগে গিয়ে শুনিয়েছিলেন যে উদয়ের দামী রোলস রয়েস, ফেরারি, পোর্শা গাড়িগুলোতে তিনি আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ
সাদ্দাম হোসেনের নিরাপত্তার জন্য নিযুক্ত আমেরিকান সেনারাই তাঁকে একদিন জানিয়েছিলেন যে তাঁর ভাই মারা গেছেন। যে সেনাসদস্য খবরটা দিয়েছিলেন, সাদ্দাম তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, “আজ থেকে তুমিই আমার ভাই।”
আরেকজন প্রহরীকে বলেছিলেন, “যদি আমার সম্পত্তি ব্যবহার করার অনুমতি পাই, তাহলে তোমার ছেলের কলেজে পড়তে যা খরচ লাগবে, সব আমি দিতে রাজী।”
এক রাতে বছর কুড়ি বয়সের সেনা প্রহরী ডসন বাজে মাপে কাটা একটা স্যুট পড়ে ঘুরছিল। জানা গেল যে ডসনকে ওই স্যুটটা সাদ্দাম উপহার হিসাবে দিয়েছেন।
বার্ডেনওয়ার্পারের কথায়, “বেশ কয়েকদিন আমরা সবাই ডসনকে নিয়ে হাসাহাসি করছিলাম ওই স্যুটটার জন্য। ওটা পড়ে ও এমন ভাবে হাঁটাচলা করত, যেন মনে হতো কোনও ফ্যাশন শো’য়ে ক্যাটওয়াক করছে ডসন।”
সাদ্দাম আর তাঁর প্রহরীদের মধ্যে বন্ধুত্ব বেশ ঘন হয়ে উঠছিল, যদিও তাদের ওপরে কড়া নির্দেশ ছিল যে সাদ্দামের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টাও যেন কেউ না করে।
সাদ্দাম হোসেনকে মামলা চলা চলার সময় দুটো জেলে রাখা হয়েছিল।
এক জেল ছিল আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের কয়েদখানা, আর অন্যটা উত্তর বাগদাদের সাদ্দামেরই একটা প্রাসাদে।
ওই প্রাসাদটা ছিল একটা দ্বীপে। একটা সেতু পেরিয়ে ওই দ্বীপে যেতে হতো।
“আমরা অবশ্য সাদ্দামকে এমন কিছু দিইনি, যেটা তিনি পাওয়ার অধিকারী ছিলেন না। কিন্তু ওঁর অহংবোধে কখনও আঘাত করতাম না আমরা,” লিখছেন বার্ডেনওয়ার্পার।
স্টিভ হাচিনসন, ক্রিস টাস্করের মতো কয়েকজন প্রহরী ওই প্রাসাদেরই একটা স্টোর রুমে সাদ্দামের দপ্তর তৈরি করে দিয়েছিল।
সাদ্দামের দরবার
সাদ্দাম হোসেনকে একটা চমক দেওয়ার ইচ্ছা ছিল সবার।
পুরনো, ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র থেকে একটা ছোট টেবিল আর চামড়ার ঢাকনা দেওয়া একটা চেয়ার নিয়ে আসা হয়েছিল। টেবিলের ওপরে ইরাকের একটা ছোট পতাকাও রাখা হয়েছিল।
“আমরা চেষ্টা করেছিলাম জেলের ভেতরেই সাদ্দামের জন্য শাসনকাজ পরিচালনার মতো একটা অফিস তৈরি করতে। যখন সাদ্দাম ওই ঘরটায় প্রথমবার গিয়েছিলেন, একজন সেনা সদস্য হঠাৎই খেয়াল করে যে টেবিলের ওপরে ধুলো জমে আছে। সে ধুলো ঝাড়তে শুরু করেছিল,” লিখছেন বার্ডেনওয়ার্পার।
ওই আচরণটা সাদ্দামের নজর এড়ায়নি। চেয়ারে বসতে বসতে তিনি মুচকি হেসেছিলেন।
তারপর থেকে তিনি রোজ ওই চেয়ারে এসে বসতেন। তাঁর নিরাপত্তার জন্য নিযুক্ত সেনাপ্রহরীরা সবাই সামনের চেয়ারগুলোতে বসতেন। যেন সাদ্দাম নিজের দরবারে বসেছেন।
নিরাপত্তা রক্ষীরা চেষ্টা করত সাদ্দামকে খুশী রাখতে। তার বদলে সাদ্দামও সকলের সঙ্গে হাসি-মস্করা করতেন।
কয়েকজন রক্ষী পরে বার্ডেনওয়ার্পারকে বলেছিলেন যে তারা বিশ্বাস করতেন ‘যদি তাদের কোনও ঝামেলায় পড়তে হয়, তাহলে সাদ্দাম তাদের বাঁচানোর জন্য নিজের জীবনও বাজি রেখে দিতে পারেন’।
যখনই সময়-সুযোগ পেতেন, তখনই সাদ্দাম হোসেন পাহারার দায়িত্বে থাকা রক্ষীদের পরিবারের খোঁজখবর নিতেন।
বার্ডেনওয়ার্পারের বইটাতে সবথেকে আশ্চর্যজনক যে বিষয়টার উল্লেখ রয়েছে, সেটা হল সাদ্দামের মৃত্যুর পরে তাঁর প্রহরীরা রীতিমতো শোক পালন করেছিলেন, যদিও তিনি আমেরিকার কট্টর শত্রু ছিলেন।
প্রহরীদেরই একজন, অ্যাডাম রজারসন উইল বার্ডেনওয়ার্পারকে বলেছিলেন, “সাদ্দামের ফাঁসি হয়ে যাওয়ার পরে আমার মনে হচ্ছে আমরা ওর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। নিজেদেরই এখন তার হত্যাকারী বলে মনে হচ্ছে। এমন একজনকে মেরে ফেললাম আমরা, তিনি যেন আমাদের খুব আপনজন ছিলেন।”
সাদ্দামের ফাঁসির পরে যখন তাঁর মরদেহ বাইরে নিয়ে আসা হয়েছিল, তখন সেখানে জমা হওয়া লোকজন মৃতদেহের ওপরে থুতু ছিটিয়েছিল।
ওই ঘটনা দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল আমেরিকান সেনারা
বার্ডেনওয়ার্পার লিখছেন, ওই নোংরামি দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন তারা সকলে, বিশেষ করে যে ১২ জন তাঁর শেষ সময়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন।
তাদেরই মধ্যে একজন ওখানে জমা হওয়া লোকজনের কাছে হাত জোড় করে তাদের থামাতে চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু দলের বাকিরা তাকে টেনে সরিয়ে নেয়।
ওই ১২ জনের অন্যতম, স্টিভ হাচিনসন সাদ্দামের ফাঁসির পরেই আমেরিকার সেনাবাহিনী থেকে ইস্তফা দেন।
হাচিনসন এখন জর্জিয়ায় বন্দুক চালনা আর ট্যাকটিক্যাল ট্রেনিং দেওয়ার কাজ করেন। তাঁর মনে এখনও ক্ষোভ রয়েছে, কারণ সেদিন যেসব ইরাকী সাদ্দামের মৃতদেহকে অপমান করছিল, তাদের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে না পড়ার আদেশ দেওয়া হয়েছিল তাঁদের।
সাদ্দাম হোসেন কিন্তু শেষ দিন পর্যন্ত আশা করতেন যে তাঁর ফাঁসি হবে না।
একজন রক্ষী, অ্যাডাম রোজারসন বার্ডেনওয়ার্পারকে বলেছিলেন, কোনও নারীর সঙ্গে প্রেম করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন সাদ্দাম। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে আবারও বিয়ে করার ইচ্ছাও হয়েছিল তাঁর।
২০০৬ সালের ৩০শে ডিসেম্বর তিনটে নাগাদ ঘুম থেকে ডেকে তোলা হয়েছিল।
তাঁকে জানানো হয়েছিল যে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাঁসি দেওয়া হবে। এই কথাটা শোনার পরে সাদ্দামের ভেতরের সব বিশ্বাস ভেঙ্গে পড়েছিল। তিনি চুপচাপ গোসল করে ফাঁসির জন্য তৈরি হয়ে নিয়েছিলেন।
সেই সময়েও তাঁর একটা ভাবনা ছিল। জানতে চেয়েছিলেন, ‘সুপার টুয়েলভের সদস্যরাও কি ঘুমোচ্ছে?’
ফাঁসির কয়েক মিনিট আগে স্টিভ হাচিনসনকে কারাকক্ষের বাইরে ডেকে পাঠান সাদ্দাম হোসেন। লোহার শিকগুলোর মধ্যে দিয়ে হাতটা বের করে নিজের রেমন্ড ওয়েইল হাতঘড়িটা দিয়ে দেন স্টিভকে।
হাচিনসন আপত্তি করেছিলেন। তবে সাদ্দাম কিছুটা জোর করেই ঘড়িটা স্টিভের হাতে পরিয়ে দেন।
জর্জিয়ায় হাচিনসনের বাড়ির একটা সিন্দুকে রাখা ঘড়িটা এখনও টিক টিক করে চলেছে।
সূত্র, বিবিসি বাংলা