ধর্মীয় দর্শন ডেস্কঃ একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা। জনৈক ব্যক্তি কোথাও একটি অতি মূল্যবান হীরকখন্ড পেল। সে তা নিয়ে এক জহুরীর নিকট গেল এবং হীরকখন্ডটি সম্পর্কে জানতে চাইল। জহুরী তাকে বলল, এর প্রকৃত মূল্য তখনই হবে যখন এর উপর কারুকার্য খচিত হবে। তবে এ কাজ অত্যন্ত জটিল ও স্পর্শকাতর। এর জন্য মোটা অংকের পারিশ্রমিকও গুণতে হয়। লোকটি জহুরীর কথায় হীরার মূল্য উপলব্ধি করতে পারল এবং এ কাজের জন্য যে কোনো পারিশ্রমিক দিতে রাজি হয়ে গেল। জহুরীকে সাথে করে নিজের বাড়ি নিয়ে এল। জহুরীর একটি গুণ এই ছিল যে, সে গানও জানত। কথাবার্তার এক ফাঁকে লোকটি তাকে একটি গান শোনানোর আবেদন করল। জহুরী একটি গানের সুর ধরে গাইতে শুরু করল। এদিকে দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। গান শেষ করে জহুরী বলল, আমার পারিশ্রমিক দিন, আমার সময় পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। এ কথা শুনে লোকটি অবাক-বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলল, কীসের পারিশ্রমিক? আপনি তো এখনও হীরকখন্ডটি স্পর্শই করেননি! এবার জহুরী বলল, ‘আরে, মূল্য তো সময়ের হয়। আর আমি তা দিয়েছি। সুতরাং আপনাকে এখন তার মূল্য দিতে হবে।’ ফলে বাধ্য হয়েই তাকে এর পারিশ্রমিক পরিশোধ করতে হল। দেখুন, লোকটি হীরার প্রকৃত মূল্য উপলব্ধি করতে পারলেও সময়ের মূল্যের কোনো অনুভূতিই তার ছিল না।
একই অবস্থা আমাদেরও। আমাদের পিছিয়ে পড়ার একটি বড় কারণ এই যে, আমরা সময়ের মূল্য অনুধাবন করতে পারি না এবং সময়ের যথাযথ ব্যবহার করতে জানি না। বর্তমান বিশ্ব যে বুরাকের গতিতে এগিয়ে চলেছে, এক সময় তা কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি এ সবকিছুকেই বাস্তব করে দেখিয়ে দিয়েছে।
বড় পরিতাপের বিষয় যে, বর্তমান সময়ের এসব তাক লাগানো প্রযুক্তি ঐ লোকেরাই ব্যবহার করছে, যারা গোটা বিশ্বকে ধ্বংসের গহবরে নিক্ষেপ করতে চায়। আর গোটা বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়ার কথা যে জাতির, সে জাতি আজ রিক্তহস্ত।
একটি প্রসিদ্ধ ফার্সী উক্তি আছে-
‘যদি একটি মুহূর্ত উদাসীন থাকি, তবে হাজার মাস পিছনে পড়ে যাব।’
এটি একটি বাস্তব সত্য যে, কখনো কখনো মানুষ মুহূর্তের ভুলের কারণে শত বছর পিছিয়ে পড়ে। প্রকৃত বুদ্ধিমান তো সে-ই, যে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে পূর্ণ দৃঢ়তা ও উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে ভবিষ্যতের পথে চলে। এক-একটি মুহূর্ত হিসাব করে খরচ করে আর সময়কে অধিক থেকে অধিকতর ফলপ্রসূ করতে সচেষ্ট হয়।
একটি উর্দূ প্রবাদ হল-
“অদৃষ্টের হাতে সেই জাতি তরবারীসদৃশ, যারা প্রতি মুহূর্তে নিজেদের কাজ-কর্মের হিসাব কষে।”
আলাহ তাআলা সূরা ‘আছর’ এর মধ্যে মানবজাতির ক্ষতিগ্রস্ততার কথা বলার সময় যুগ-সময়ের শপথ করেছেন। তা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, সময় যা মানুষ লাভ করে তা অনেক বড় ও অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর সঠিক মূল্যায়নকারী ও যথার্থ ব্যবহারকারী অনেক কিছুই হতে পারেন। আর যে এর প্রতি উদাসীন, হেলায়-খেলায় যে তা কাটিয়ে দেয় সে মূলত নিজেরই অধঃপতন ডেকে আনে।
এ সময়জ্ঞান সর্বপ্রথম যে জাতির হওয়া উচিত ছিল সে হল মুসলিম জাতি। অথচ আজকের সমাজে সম্ভবত মুসলমানদের মাঝেই এ অনুভূতি সবচেয়ে কম বলে মনে হয়। যখন অন্যান্য জাতি নিজ নিজ লক্ষ্যের পথে জান-প্রাণ দিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে- তাদের উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন্ তখনও কিন্তু মুসলিম জাতি, যাদের সামনে রয়েছে অভিষ্ট লক্ষ্য, তাদের মাঝে এ অনুভূতিই জাগে না যে, সময় নিজের গতিতে বয়ে চলেছে। অথচ তা থেকে কোনো সুফল গ্রহণ করা হচ্ছে না।
এটি একটি ব্যাপক অবস্থা। তবে এর ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। আজকের এ আঁধার রাতে স্থানে স্থানে কিছু প্রদীপ জ্বলছে, কিন্তু তা ঐ আঁধারের জন্য যথেষ্ট নয়। প্রদীপরশ্মির আরো প্রখরতার প্রয়োজন। বিশেষত যখন ঐ প্রদীপগুলো নেভানোর জন্য পাগলা হাওয়ার এলোমেলো ঝাপটা এসে পড়ছে।
ঈমানের বাতি প্রজ্জ্বলন করা, তার আলোকরশ্মিকে আরো প্রখর করা এবং আরো অসংখ্য বাতি জ্বালানোর জন্য প্রয়োজন নিজেকে মোমের মতো বিলীন করে দেওয়ার অনুপ্রেরণা। আঁধারে চারদিক ছেয়ে যাওয়ার এ বর্তমানে আলো-আঁধারের এটি একটি দ্বন্দ মাত্র। এ পরিস্থিতিতে সমষ্টিগত ও ব্যক্তিগতভাবে প্রতিটি ঈমানদারের দায়িত্ব ও কর্তব্য হল, সময়ের প্রকৃত মূল্য অনুধাবন করা এবং একটি মুহূর্তও যেন নষ্ট না হয় সে ব্যাপারে সদা সতর্ক থাকা। আলাহপ্রদত্ত যোগ্যতাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা হলে ঈমানের রশ্মিতে প্রখরতা আসবে। আর যে কোনো আঁধারের মোকাবেলা করা সহজ হবে।
সময়ের সঠিক মূল্যায়নের এটি একটি সাধারণ ফায়দা। ব্যক্তিগতভাবে যদি ভেবে দেখা যায় তাহলে অনুমিত হয় যে, এক একজন মানুষের জন্য সময়ের মূল্য কত অধিক। অথচ তা কীভাবে অপব্যবহার ও বিনষ্ট করা হচ্ছে। কখনো কখনো মাথায় এ ভাবনার উদয় হয় যে, এ কাজটি যদি এখন না করি তাহলে তাতে এমন কী আর এসে যায়? সামনে আরো অনেক সময় আছে। কিন্তু একটি বারের জন্যও এ ধারণা হয় না যে, এখন আর ভবিষ্যতের সময় দুটি তো এক নয়। দুটিই তো নিজ নিজ স্থানে অতি মূল্যবান। যে সময়টুকু চলে গেল তা তো কখনো আসবে না। যদি তা বিনষ্ট হয়ে থাকে তবে তা হাতছাড়া হয়ে গেল। শত ক্রন্দনেও এরপর তা আর ফিরে আসবে না। আর এ জন্যেই ইসলামের একটি শিক্ষা এই যে, মুসলমান নিষ্ফল ও অনর্থক কোনো কাজ করতে পারে না। কেননা, তাকে সময়ের মূল্য বলে দেওয়া হয়েছে এবং সময়কে আরো মূল্যবান করার কৌশলও শেখানো হয়েছে।
সময় অতীব নিকটতম হওয়া স্বত্ত্বেও মানুষ তাকে শুধু অনুভব করতে পারে, প্রত্যক্ষ করতে পারে না। তাই মানুষ কখনো সময়কে অতিক্রম করতে পারে না, সময়ই তাকে অতিক্রম করে চলে যায়।প্রভূ দয়াময় আমাদেরকে সময়ের সঠিক ও যথাযথ ব্যবহারের তাওফীক নসীব করুন । আমীন !!!
লেখকঃ
মোস্তফা কবীর সিদ্দিকী
সিনিয়র লেকচারার , ইসলামিক স্টাডিজ ডিপার্টমেন্ট,
সাউথইস্ট ইউনির্ভাসিটি।
ইমেইলঃ mostafakabir_seu@yahoo.com
অগ্রদৃষ্টি.কম // এমএসআই