বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে ওই আন্দোলনের নেতার ঘরে জন্ম হওয়ায় বৈরিতার আঁচ ছিল জীবনের শুরুতেই, এরপর সুসময় যখন এল তা হল না দীর্ঘস্থায়ী; মাত্র ১০ বছর ১০ মাসের জীবন শেখ রাসেলকে যে বেদনাবোধ দিয়েছিল তা তুলে ধরলেন বড় বোন শেখ হাসিনা।
বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠপুত্র শেখ রাসেলের ৫৫তম জন্মবার্ষিকীতে শুক্রবার এক আলোচনা সভায় নিজে কোলে-পিঠে করে বড় করে তোলা এই ভাইয়ের হন্তারকদের বিচার চাইতে না পারার সময়ের কথাও বলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
১৯৬৪ সালের ১৮ই অক্টোবর ধানমণ্ডির স্মৃতি-বিজড়িত বঙ্গবন্ধু ভবনে জন্ম শেখ রাসেলের। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার সময় রক্ষা পায়নি এই শিশু। তখন ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিল রাসেল।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, “যে সময় রাসেলের জন্ম হয় তখন আব্বা খুব ব্যস্ত। রাসেল জন্ম হওয়ার পর আমরা তাকে খবর দেই। আমরা…কামাল, জামাল আর রেহানা আমরা চার ভাই-বোন উদ্বিগ্ন হয়ে বসে ছিলাম এই ছোট্ট শিশুর জন্ম মুহূর্তটায়, তাকে কোলে নেওয়া এবং তার পাশে থাকা।”
১৯৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষণার পর মে মাসে বঙ্গবন্ধুকে যখন গ্রেপ্তার করা হয়, সে সময় দুই বছরও পূর্ণ হয়নি রাসেলের। যে বয়সে বাবা-মাকে ঘিরে গড়ে ওঠে শিশুর জগত, তখন কারাগারে বাবাকে দেখতে গিয়ে রাসেল কী করতেন- তা উঠে এসেছে বড় বোনের কথায়।
তিনি বলেন, “আমরা কারাগারে যেতাম আব্বার সঙ্গে দেখা করতে। রাসেল কিছুতেই আসতে চাইত না। সে বাবা ছাড়া আসবে না। সে সময় আমার বাবা বলতে বাধ্য হতেন, এটা আমার বাড়ি আমি থাকি। তুমি মায়ের বাড়িতে যাও।
“তখনও সে (রাসেল) ভালোভাবে কথাও বলতে পারে না। তারপরও সে প্রচণ্ড কান্নাকাটি করত। তাকে অনেক ভুলিয়ে-ভালিয়ে আমাদের নিয়ে আসতে হত।”
কারাগারে বাবাকে দেখে আসার পর প্রতিবারই রাসেল অস্থিরতার থাকতেন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “যেদিন আমরা জেলখানায় দেখা করতে যেতাম সেদিন সে খুব অস্থির থাকত। ভালো মতো ঘুমাতে চাইত না, খেতে চাইত না। আমাদের সবাইকে ডাকত আমরা সব ভাই-বোনরা গিয়ে তার কাছে বসতাম।
“সে কিছু বলতে পারছে না। সে তার মনের ব্যথা জানাতে পারছে না। তার ব্যথা-বেদনা আমরা বুঝতে পারতাম।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এভাবে সে বড় হয়ে ওঠে। এক সময় বাবাকে বাবা বলে ডাকা শুরু করে। কিন্তু আব্বাকে যে ডাকবে, অনেক সময় আমার মা, যখন সে বাবা বলে ডাকত, বলত- আমি তোমার বাবা।
“কারাগারে গিয়ে একবার সে বাবার মুখের দিকে তাকাত আব্বা বলে ডাকত, আবার মায়ের মুখের দিকে তাকাত। মা বলেছিলেন, আব্বা আব্বা বলে কান্নাকাটি করে, আমি বলেছি- আমি তোমার আব্বা। সেজন্য সে জেলখানায় গিয়ে একবার বাবার দিকে তাকায় একবার মায়ের দিকে তাকায়।
“একটা ছোট্ট শিশু পিতৃস্নেহ বঞ্চিত, আমরা তো বঞ্চিত ছিলামই।”
এরপর আবার ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। তখন ছাত্র-যুবাদের আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়ে আসার পর বাবাকে আবার পান রাসেল।
“একটা জিনিস আমরা লক্ষ করতাম, সে খেলার ছলে কিছুক্ষণ পরপর আব্বা কোথায় আছেন দেখতে আসত। মনে হত যেন ওর মধ্যে তখনও একটা ভয়, বাবাকে হারাবার একটা ভয়। সেই ভয়টাই মাঝে মাঝে ওর মধ্যে দেখা দিত।
“এরপর সত্তরের নির্বাচনে পাকিস্তানি শাসকরা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দিল না, মুক্তিযুদ্ধ হল। যখনই জাতির পিতা স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন ২৬ শে মার্চ প্রথম প্রহরে, তখনই তাকে গ্রেপ্তার করে নেওয়া হল। আবার রাসেল পিতৃস্নেহ বঞ্চিত।”
এরপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের গ্রেপ্তার করে রাখা হয় ১৮ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িতে।
সেই সময় ছোট্ট রাসেলের মনোভাব কেমন ছিল, তা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “খুব চাপা স্বভাবের ছিল। সহজে নিজের কিছু বলত না। তার চোখে যখন পানি, চোখে পানি কেন জানতে চাইলে বলত, চোখে যেন কি পড়েছে। ওইটুকু ছোট বাচ্চা, নিজের মনের ব্যথাটা পর্যন্ত কীভাবে লুকিয়ে রাখতে হয়… আমার ভাবতে অবাক লাগে।”
শিশু রাসেলের দায়িত্ববোধের কথাও উঠে আসে বোনের স্মৃতিচারণে: “আমি তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম। পরে জয় এলো। বন্দিখানায় থাকা অবস্থায় যখন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল সেই যুদ্ধের সময় যখন আক্রমণ হত, রাসেল পকেটে সব সময় একটু তুলা রাখত, নিজের কানে দেওয়ার পাশাপাশি ছোট্ট জয়ের কানেও দিয়ে দিত যেন ওই আওয়াজে জয়ের কোনো ক্ষতি না হয়। রাসেল জয়ের প্রতি খুব খেয়াল রাখত। সব সময়ই তার সেদিকে বিশেষ নজর ছিল।
“একতলা বাসা, সেখানে মেশিনগান ফিট করা ছিল, অনবরত গোলাগুলি হত।”
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যখন ফিরে আসেন তখন রাসেল বাবাকে ছাড়তে চাইতেন না জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “স্বাধীনতার পর বিজয়ের পর যখন আব্বা ফিরে এলেন রাসেল কোনোমতেই আব্বাকে ছাড়তে চাইত না, যেখানেই যেত সেখানে সাথে সাথে যেতে চাইত।”
শেখ রাসেলের সেনা কর্মকর্তা হওয়ার ইচ্ছা এবং শিশুদের প্রতি তার ভালোবাসার কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
খুনিদের পুরস্কৃত করেছিল বলেই এখন শিশুর ওপর এই অমানবিকতা: প্রধানমন্ত্রী
তিনি বলেন, “রাসেলের খুব শখ ছিল সে বড় হয়ে আর্মি অফিসার হবে। এবং সেভাবে কিন্তু সে নিজেকেও তৈরি করত। ছোট ছোট গরিব শিশুদের প্রতি তার দরদ ছিল, যখন সে গ্রামে যেত গ্রামের অনেক শিশুদের সে জোগাড় করত। সে কাঠের বন্দুক বানাত। শিশুদের জন্য মাকে বলত কাপড়- চোপড় কিনে দিতে হবে। মা ঠিকই কাপড়-চোপড় কিনে দিতেন। বাচ্চাদের নিয়ে সে প্যারেড করাত। প্যারেড করা শেষে তাদের খাবার-দাবার দিত। সবাইকে এক টাকার নোটের বান্ডল করে টাকাও দিত সে। যখনই যেত সেটা সে করবেই।”
পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের ছয় বছর পর দেশে ফিরে টুঙ্গীপাড়ায় গিয়ে ঘরের আলমারিতে ছোট শিশুদের অনেক কাপড় পাওয়ার কথা জানান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “যখন দেশে আসলাম যখন টুংগীপাড়া যাই সেখানে একটা আলমারি ছিল, সেটার ভেতরে দেখি অনেকগুলো শিশুদের ছোট ছোট জামা কাপড় আছে। জানতাম এগুলো রাসেল গরিব শিশুদের মাঝে সব সময় বিতরণ করত। তাদের আর্থিক সহায়তা করত সেগুলো সেদিনও পেয়েছিলাম। মা সব সময় সেগুলো কিনে রেখে দিত।”
বাবা-মাসহ পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের সাথে অকালে প্রাণ হারানো শেখ রাসেল বেঁচে থাকলে এখন দেখতে কেমন হতেন, সেই আফসোসও ঝরে প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে।
সূত্র, বিডিনিউজ২৪.কম