বাংলাদেশে চলতি বছর দেশের বিভিন্ন এলাকায় নানা পর্যায়ে প্রশ্ন-ফাঁস আর অনিয়মের মাঝেই এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। এরপর এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের পর পরিস্থিতি এতটাই জটিল রূপ নেয় যে সরকারের পক্ষ থেকে প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িতদের ধরিয়ে দিতে ৫ লাখ টাকা পুরস্কারেরও ঘোষণা দেয়া হয়।
এছাড়া ফাঁস টেকাতে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় । তবে এসব ঘটনায় এখনও পর্যন্ত যাদের আটক করা হয়েছে তাদের বেশিরভাগই কোন না কোন পর্যায়ের শিক্ষার্থী। ফলে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, মূল যারা অপরাধী তারা কি আড়ালেই থেকে যাচ্ছেন? নাকি কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা হচ্ছে?
‘পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে শুনি প্রশ্ন ফাঁস হইছে‘
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি জেলার শিক্ষার্থী তাজওয়ার (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হওয়ায় ছদ্মনাম ব্যবহার করা হচ্ছে)। তার সাথে ফোনে কথা হচ্ছিল সোমবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরে। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এই পরীক্ষাটির প্রশ্ন-ফাঁস প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তার কণ্ঠে স্পষ্টই হতাশা।
“এক-একটা পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে শুনি প্রশ্ন ফাঁস হইছে। আমরা তো পড়েই পরীক্ষা দিচ্ছি। কোনও কোনও ছাত্রদের ধরা হচ্ছে। ছাত্ররা এই প্রশ্ন নিয়ে অনৈতিক কাজ করেছে ঠিকই কিন্তু যারা সেগুলো তাদের হাতে পৌঁছে দিয়েছে তারাই মূল অপরাধী। তারা কোথায়?”
এই শিক্ষার্থীর আশঙ্কা, “যেটা হচ্ছে সেটা ভাল হচ্ছে না। পরবর্তীতে ভর্তি থেকে শুরু করে অন্যান্য ক্ষেত্রে সবাইকে সাফার করতে হবে”।
বিষয়টি নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যেও উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তা। তাদের প্রশ্ন, আসল অপরাধী কি আদৌ ধরা পড়ছে?
‘এবার সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে‘
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের একজন অভিভাবকের সাথে কথা হচ্ছিল যার যমজ দুই কন্যা এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। এই মা শিক্ষার্থীদের আটকের প্রসঙ্গ বলছিলেন, “মূল অপরাধী তারা না, মূল অপরাধ তো ওপর থেকে হয়ে আসছে। এত ব্যবস্থা নেয়ার পরও কেন এগুলো হচ্ছে?”
তিনি বলেন, “এবার তো সবচেয়ে বেশি ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। আমি যা বুঝি আমার তো মনে হয় প্রেস থেকে বা ছাপার পরই প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। যারা প্রশ্ন পাচ্ছে তারা শতভাগ উত্তর দিতে পারছে। আমার টুইন দুই মেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে। তাদের মধ্যে হতাশা আর আতঙ্ক । ওরা বলে ‘আম্মু আমরা তো প্রশ্ন পেলাম না’। অন্যরা তো লেখাপড়া না করে শুধু প্রশ্ন পেয়ে ভালো রেজাল্ট করবে”।
‘এই ফাঁসের পেছনে অবশ্যই একটি বড় চক্র আছে‘
ঢাকার মিরপুর এলাকার একজন অভিভাবক রাশেদা হাসান। চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষা শুরুর পর থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্নফাসের বিষয়টি তাকে এবং তার ছেলের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
বিবিসি বাংলাকে এই অভিভাবক বলছিলেন, “বাংলা সেকেন্ড পেপার পরীক্ষা শুরুর ২৫ মিনিট আগে প্রশ্ন বাতিল হয়ে যায়। আর এটা জানতে পারি পরের দিন। একটা পরীক্ষার প্রশ্ন বাতিল হলে বাচ্চাদের পরের পরীক্ষাগুলোতে মানসিক চাপ থাকে যে পরীক্ষা বাতিল হলে আবার পরীক্ষা দিতে হবে কি-না সে নিয়ে ।”
তিনি বলেন, “এখন যেভাবে ধরপাকড় করা হচ্ছে তাতে ভুক্তভোগী হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কিন্তু মনে হয় এই ফাঁসের পেছনে অবশ্যই একটি বড় চক্র আছে”।
‘শিক্ষার্থীরা তো প্রশ্ন আউট করেনি। তারা আউট করা প্রশ্ন পেয়েছে‘
প্রশ্ন-ফাঁসকে ঘিরে অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌছায় যে প্রশ্ন-ফাঁস রোধে ব্যর্থতার জন্য সম্প্রতি দেশের জাতীয় সংসদে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগেরও দাবি তোলেন একজন সদস্য।
প্রশ্নফাঁসে জড়িতদের ধরিয়ে দিতে গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারি পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কারের কথাও ঘোষণা করেন শিক্ষামন্ত্রী। কেন্দ্রের আশপাশে ২০০ মিটারের মধ্যে মোবাইল ফোন বহন করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
কিন্তু এসবের পরও প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানো যায়নি । সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ্যে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে পোস্ট দেয়া হয়। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাত আটক হয় শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষা গবেষক ও জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, “কোনও অবস্থাতে এভাবে প্রশ্ন-ফাঁস বন্ধ করা সম্ভব নয়। যারা শিক্ষার্থী তারা তো প্রশ্ন আউট করেনি। তারা আউট করা প্রশ্ন পেয়েছে। যারা ফাঁস করছে তাদের ধরতে না পারলে তো ফাঁস ঠেকানো যাবেনা”।
অধ্যাপক রহমান বলেন, বিষয়টি অনেকটাই মাদকের মতো। মাদক যারা ব্যবসা করে তাদের না ধরে ব্যবহারকারীকে ধরলে তো হবে না। মূল হোতাদের খুঁজতে হবে, ধরতে হবে। কোত্থেকে ফাঁস হচ্ছে সেটা চিহ্নিত করতে হবে। কিন্তু তা না করে ভুল পথে অগ্রসর হচ্ছে প্রশাসন।
তিনি মনে করেন, যে ব্যবস্থা নেয়ার দরকার সেটি আসলে হচ্ছে না। “এটা কোনভাবেই সমাধান না। কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করলো কিন্তু এরপরে অন্য ছাত্ররা প্রশ্ন পাবে। কতজনকে গ্রেপ্তার করতে পারবে ?”
এই শিক্ষা গবেষকের মতে, দেশের গোয়েন্দা বাহিনী আছে, আইন-শৃঙ্খলা সদস্যরা আছেন। চাইলে অবশ্যই এর সাথে জড়িতদের ধরা সম্ভব । তবে ধরার উদ্দেশ্য কতটা রয়েছে সেটাই প্রশ্ন।
‘শিগগিরই গোয়েন্দা বিভাগ মূল টার্গেটে পৌঁছে যাবে‘
এ বিষয়ে ঢাকা বোর্ডের কন্ট্রোলার তপন কুমার বিশ্বাস বিবিসিকে বলেছেন, মূল অপরাধীদের ধরতে গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। এটা যেহেতু অনেক গভীরে চলে গেছে, যারা ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্নগুলো দিচ্ছে তাদের মাধ্যমে হয়তো একটা পর্যায়ে মূল অপরাধীদের আটক করা সম্ভব। আমাদের তথ্য আছে খুব শিগগিরই গোয়েন্দা বিভাগ মূল টার্গেটে পৌঁছে যাবে”।
এত ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হচ্ছে, তারপরও কেন ঠেকানো যাচ্ছেনা প্রশ্ন ফাঁস?
এই প্রশ্নে মি: বিশ্বাস বলেন, মূল জায়গাটিতে যাওয়া গেলেই সেটি সম্ভব হবে। যারা প্রশ্ন ফাঁস করছে তারা হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে তারা বিভিন্ন ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। এভাবে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা তৈরি করছে অন্য শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে। তাই মূলে পৌঁছাতে সময় লাগবেই।