অগ্রদৃষ্টি ডেস্ক: স্বঘোষিত ধর্মগুরু বাবা গুরমিত রাম রহিম সিং’য়ের নির্যাতন আর মেনে নিতে না পেরে ২০০২ সালের মে মাসে ‘ডেরা সাচ্চা সৌদার’ এক নারী ভক্ত তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি বেনামী চিঠি পাঠান। একই সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২৫ তারিখে ‘দেশ সেবক’ নামক পত্রিকায় সেই চিঠিটা প্রকাশ পায়। ওই চিঠির খবর প্রকাশ্যে আসার পরই রাম রহিমের বিরুদ্ধে পঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সিবিআই’কে তদন্তের নির্দেশ দেয়।
যা লেখা ছিল সেই বেনামী চিঠিতে —
‘শ্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী, প্রধানমন্ত্রী নয়াদিল্লী
আমি পাঞ্জাবের মেয়ে। সিরসায় ডেরা সচ্চা সওদার একজন সাধ্বী হিসেবে গত পাঁচ বছর সেবা করছি। আমার মতো আরও কয়েকশো সাধ্বী এখানে আছেন, যারা প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টা করে সেবা করেন। আমরা সবাই এখানে যৌন নির্যাতনের শিকার। নিয়মিত আমাদের ধর্ষণ করেন ডেরা মহারাজ। আমি একজন স্নাতক। ডেরা মহারাজের ওপর আমার পরিবারের অন্ধবিশ্বাস। তার জেরেই আজ আমি সাধ্বী।
সাধ্বী হওয়ার বছর দুয়েক পর একদিন রাত ১০টা নাগাদ হঠাৎ এক মহিলা ভক্ত আমার ঘরে এসে জানান, মহারাজ ডাকছেন। মহারাজ স্বয়ং ডাক পাঠিয়েছেন শুনে খুব উচ্ছ্বসিত হয়েছিলাম। সেটাই তার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ। ঘরে গিয়ে দেখি, টিভিতে ব্লু ফিল্ম দেখছেন। বালিশের পাশে একটা পিস্তল রাখা। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। মহারাজ একটু পরে টিভিটা বন্ধ করে দিলেন। আমাকে নিজের পাশে বসালেন। এক গ্লাস জল দিলেন। তার পর খুব আস্তে আস্তে বললেন, তিনি আমাকে খুব কাছের লোক বলে ভাবেন। তাই ডেকে পাঠিয়েছেন। বলতে বলতে তিনি এক হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে নিজের আরও কাছে টেনে নিলেন। কানের কাছে মুখ এনে বলেন, আমাকে তিনি হৃদয়ের গভীর থেকে ভালবাসেন। আমার সঙ্গে সহবাস করতে চান। বলেন, তার শিষ্যা হওয়ার সময়ই আমার সমস্ত সম্পদ, আমার শরীর এবং আত্মা তাকে উৎসর্গ করেছি। তিনি তা গ্রহণ করেছেন।
তাও আমি বাধা দেওয়ায় তিনি বলেন, ‘আমি ঈশ্বর, এতে তো কোনও সন্দেহ নেই?’
আমি বলি, ঈশ্বর কখনও এ রকম করেন না।
তখন তিনি বলেন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরও ৩৬০ জন গোপিনী ছিল, যাদের সঙ্গে তিনি প্রেমলীলা করতেন। আমিও তার মতোই ঈশ্বর বলে মানে। এতে এত অবাক হওয়ার কিছু নেই।
তার পরেই তিনি বলেন, আমি তোমাকে এখনই এই পিস্তল দিয়ে খুন করতে পারি। তোমার লাশ এখানেই পুঁতে দেব। তোমার পরিবারের সব সদস্য আমার অন্ধ ভক্ত। তুমি খুব ভাল করেই জানো, তারা কখনই আমার বিপক্ষে যাবেন না। সরকারের ওপরেও আমার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। পঞ্জাব, হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী এবং কেন্দ্রের অনেক মন্ত্রীও আমার কাছে আসেন। তারাও আমার ভক্ত। নেতারাও আমার সাহায্য নেন। সুতরাং তারাও আমার বিরুদ্ধে যাবেন না। তোমার পরিবারের যারা সরকারি চাকরি করে, তাদের সবার চাকরি কেড়ে নেব, সেবাদার দিয়ে তাদের খুন করাব। সেই খুনের কোনও প্রমাণও থাকবে না। তুমি খুব ভাল করেই জানো, ডেরা ম্যানেজার ফকিরচাঁদকেও আমি গুন্ডা দিয়ে খুন করিয়েছি। এখনও সেই খুনের কিনারা হয়নি। ডেরার দৈনিক আয় ১ কোটি। এই টাকা দিয়ে আমরা রাজনীতিক নেতা, পুলিশ, এমনকী বিচারকদেরও কিনে নিতে পারি।
এর পরই মহারাজ আমাকে ধর্ষণ করেন। গত তিন বছর ধরে মহারাজ এভাবেই ধর্ষণ করে আসছেন। আমার পালা আসে ২৫ থেকে ৩০ দিন পর পর। আমার মতো যত জন সাধ্বীকে তিনি তলব করেন, তাদের সবাইকে ধর্ষণ করেন। ওঁদের বেশিরভাগেরই বয়স এখন ৩০ থেকে ৪০। বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে। ওদের কাছে এখন ডেরা ছাড়া আর কোনও আশ্রয় নেই। অথচ এই মহিলারা অনেকেই শিক্ষিত। কেউ স্নাতক, কারও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা এই নরকবাস করছেন। কারণ একটাই, মহারাজের ওপর তাদের পরিবারের অন্ধ বিশ্বাস।
আমরা সাদা পোশাক পরি, মাথায় স্কার্ফ বাঁধি, পুরুষদের দিকে চেয়ে দেখি না। পুরুষদের সঙ্গে কথা বলতে হলে ৫–১০ ফুট দূরত্ব বজায় রাখি। সবই মহারাজের ইচ্ছে অনুসারে। তার কথামতোই আমরা চলাফেরা করি। সাধারণ মানুষ আমাদের দেবী ভাবেন। কিন্তু তারা জানেন না, ডেরাতে আমরা আসলে রক্ষিতা। ডেরা এবং মহারাজের আসল সত্যিটা আমি আমার পরিবারকে জানানোর চেষ্টা করেছিলাম। তারা আমাকেই বকাবকি করলেন। বললেন, ডেরায় স্বয়ং ঈশ্বরের বাস। এর থেকে ভাল জায়গা আর নেই।
এখানে কাউকেই অন্যদের সঙ্গে বেশি কথা বলতে দেওয়া হয় না। পাছে ডেরার সত্য ফাঁস হয়ে যায়, টেলিফোনেও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয় না। কোনও সাধ্বী যদি মহারাজের নামে অভিযোগ তোলে, তা হলে তার শাস্তি হয়। কিছুদিন আগে ভাটিন্ডার এক তরুণী মহারাজের নির্যাতনের কথা পরিবারকে জানায়। মহারাজ জানতে পারেন। বাকি সমস্ত সাধ্বী মিলে ওই তরুণীকে বেধড়ক পেটায়। মেরুদণ্ডে গুরুতর চোট নিয়ে সে এখন শয্যাশায়ী। মেয়েটির বাবা ডেরায় কাজ করতেন। তিনি ইস্তফা দিয়ে বাড়ি ফিরে যান। মহারাজের ভয়ে, আত্মসম্মানের কথা ভেবে তিনিও আর মুখ খোলেননি। একইভাবে নির্যাতনের শিকার হন কুরুক্ষেত্রের এক তরুণী। তিনিও ডেরা ছেড়ে বাড়ি চলে যান। সব কথা জানার পর তার ভাইও ডেরার কাজে ইস্তফা দিয়ে চলে যান। পাঞ্জাবের সঙ্গরুর এক তরুণী বাড়ি ফিরে ডেরার ভয়ঙ্কর দিকটা সবাইকে জানিয়েছিলেন। পর দিনই ডেরার অস্ত্রধারী সেবাদারেরা তার বাড়ি পৌঁছে যায়। মুখ খুললে তাকে খুনের হুমকি দেয়। একইভাবে মানসা, ফিরোজপুর, পাতিয়ালা ও লুধিয়ানা থেকে এখানে আসা তরুণীরাও ভয়ে ডেরা নিয়ে কিছু জানাতে চাননি। তারাও ডেরা ছেড়ে চলে গেছেন, কিন্তু মুখ বন্ধ করে আছেন। সিরসা, হিসার, ফতেয়াবাদ, হনুমানগড় এবং মেরঠের তরুণীরাও মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন।
আমিও যদি আমার নাম জানাই, তাহলে আমাকে এবং আমার পরিবারকে খুন করা হবে। সাধারণ মানুষের স্বার্থেই এই সত্য আমি সামনে আনতে চাই। এই মানসিক চাপ আর নির্যাতন সহ্য করতে পারছি না। খুব বিপদে রয়েছি। সংবাদমাধ্যম বা সরকারি কোনও সংস্থা যদি তদন্ত চালায়, তা হলে অন্তত ৪০ থেকে ৫০ জন সাধ্বী এগিয়ে এসে এই সত্য জানাবেন আমি নিশ্চিত। আমাদের ডাক্তারি পরীক্ষা করা হোক। আমরা আদৌ সাধ্বী কি না তা জানা হোক। পরীক্ষায় যদি প্রমাণ হয় যে, আমাদের কুমারিত্ব নেই, তাহলে তদন্ত করে জানা হোক, কে আমাদের সতীত্ব হরণ করেছেন। তাহলেই সত্য বাইরে আসবে। মহারাজ গুরমিত রাম রহিম সিংহই যে আমাদের জীবন নষ্ট করেছেন তার প্রমাণ মিলবে।
অগ্রদৃষ্টি.কম // এমএসআই