‘মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ মনে করে যে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানই সাংবাদিক জামাল খাসোগজিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন’ – এমন খবর বেরুনোর পর অনেকের মনেই এ প্রশ্ন উঠছে যে – এর পর যুবরাজের পরিণতি কি হতে পারে?
মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, সিআইএ তাদের হাতে থাকা তথ্য-উপাত্তগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করেই এ ধারণায় উপনীত হয়েছে বলে একটি সূত্র তাদের জানিয়েছেন।
অবশ্য এসব প্রমাণ যে শতভাগ নিশ্চিত তা কেউ বলছেন না। ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্টের পর মার্কিন কর্মকর্তারা এখন বলছেন এ ব্যাপারে বহু প্রশ্নেরই উত্তর এখনো অজানা। সৌদি আরব নিজেরাও এ ঘটনার একটি তদন্ত করছে।
বিবিসির বিশ্লেষক ফ্রাংক গার্ডনার বলছেন, তদন্তের ফল যাই হোক – যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সুনামের ওপর ইতিমধ্যেই এর গুরুতর প্রতিক্রিয়া পড়েছে।
এর ফলে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান – যাকে অনেকে বর্ণনা করেন এমবিএস বলে – তার কি পরিণতি হতে পারে?
তার আগে দেখা দরকার যে জামাল খাসোগজি খুনের ঘটনা কি ভাবে সৌদি আরবের ভেতরে যুবরাজের অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
তরুণদের আশার প্রতীক?
যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের বয়স মাত্র ৩৩।
তাকে দেখা হয় লক্ষ লক্ষ তরুণ সৌদির ভবিষ্যতের আশার প্রতীক হিসেবে। মনে করা হয় তিনি প্রযুক্তি, কর্মসংস্থান, এবং সার্বিক প্রগতির মাধ্যমে সৌদি আরবকে একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে দেবেন।
খাসোগজি খুনের ঘটনার পর যুবরাজ মোহাম্মদেন সেই অবস্থান কি আর থাকবে?
এই সেদিনও পশ্চিমা দেশগুলোর নেতা থেকে শুরু করে হলিউড পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে বন্দিত হচ্ছিলেন প্রিন্স মোহাম্মদ – কিন্তু এখন অনেকেই গভীরভাবে সন্দেহ করছেন যে এ হত্যাকান্ডের পেছনে হয়তো তার হাত ছিল।
এর ফলে সৌদি আরবের নেতৃত্ব ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার পর সবচাইতে গুরুতর রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েছে।
কূটনৈতিক সংকট:
সৌদি আরবের সরকার এখন ইয়েমেনের যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর প্রচন্ড চাপের মুখে পড়েছে। এতে দেশটিতে প্রাণহানি হয়েছে ব্যাপক, দেখা দিয়েছে গুরুতর মানবিক সংকট।
ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের পরাভূত করার জন্য সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্র এবং কিছুটা যুক্তরাজ্যের ওপর নির্ভরশীল।
প্রতিবেশী কাতারের সাথে বৈরিতার অবসান ঘটানোর জন্যও সৌদি আরবের ওপর চাপ বাড়ছে। কাতারে রয়েছে মার্কিন-নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশনের এক বিশাল ঘাঁটি – যা এ অঞ্চলে মার্কিন কৌশলগত স্বার্থের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এ ঘাঁটিতে ১৭টি দেশের লোক কাজ করে। তাই যুক্তরাষ্ট্র চায় কাতার-সৌদি বৈরিতার দ্রুত অবসান।
কি হতে পারে এমবিএসের?
বিবিসির বিশ্লেষক ফ্রাংক গার্ডনার বলছেন, সৌদি সরকার হয়তো এটা প্রকাশ্যে স্বীকার করবে না।
কিন্তু এটা খুবই সম্ভব যে কোনোভাবে তার ডানা কেটে দেয়া হবে, অর্থৎ তার ক্ষমতা ও প্রভাব অন্তত কিছুটা খর্ব করা হবে।
তিনি কি তার বর্তমান পদে থাকবেন?
মোহাম্মদ বিন সালমান ‘যুবরাজ’ অর্থাৎ বর্তমান বাদশার উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন ২০১৭ সালের জুন মাসে।
বিবিসির ফ্রাংক গার্ডনার বলছেন, তাকে যদি তার পদ থেকে একেবারেই সরিয়ে দেয়া হয় – সেটা হবে খুবই নাটকীয় ও বিস্ময়কর।
বরং মনে করা হচ্ছে, তার উপাধি ও মর্যাদা হয়তো অপরিবর্তিতই থাকবে। কারণ তিনি এখনো তার পিতা বাদশা সালমানের প্রিয় পুত্র।
তবে তার হাতে থাকা কিছু ক্ষমতা হয়তো চুপিসারে অন্যদের হাতে তুলে দেয়া হবে। এর ফলে অনেকটা আগের মতোই ক্ষমতার ভাগাভাগির ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা হবে। এতে হয়তো দেশটিতে একটা স্থিতিশীলতা আসবে।
হয়তো এর ফলে যুবরাজ সালমানের শত্রু-সমালোচকের সংখ্যাও কমে আসতে পারে।
রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় এমন আরো সৌদিদের নিয়ে আসা হবে।
কারণ, গত বছর জুন মাস থেকে সৌদি আরবে কার্যত এক ব্যক্তির শাসন চলছে।
ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্ট কতটা নিশ্চিত?
একদিন আগে মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টে রিপোর্ট বেরোয় যে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানই আসলে সাংবাদিক জামাল খাসোগজিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে সিআইএ বিশ্বাস করে।
ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, খাসোগজিকে হত্যার নির্দেশ যে সরাসরি সৌদি যুবরাজের কাছ থেকে এসেছে, সেটি সিআইএ ধারণা করছে অংশত একটি ফোন কলের ভিত্তিতে।
যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ভাই প্রিন্স খালেদ বিন সালমান, যিনি যুক্তরাষ্ট্রে সৌদি রাষ্ট্রদূত, তিনি নাকি জামাল খাসোগজিকে ফোন করেছিলেন।
যুবরাজের নির্দেশেই নাকি তিনি খাসোগজিকে ফোন করে আশ্বাস দেন যে, ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে তিনি যেতে পারেন, তার কোন বিপদ হবে না।
সিআইএ’র ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, তারা এর প্রমাণগুলো পরীক্ষা করে দেখেছে। মার্কিন কর্মকর্তাদের ধারণা, এমন একটি হত্যাকান্ড কেবলমাত্র যুবরাজ মোহাম্মদের অনুমতি নিয়েই হতে পারে।
বিবিসির ফ্রাংক গার্ডনার বলছেন, হত্যাকান্ডের দিনে ঘাতক দলটি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তিকে ফোন করেছিল বলে গোয়েন্দারা তথ্য পেয়েছেন। তিনি বলছেন, এসব তথ্য অত্যন্ত গুরুতর কিন্তু এতেও একেবারে নির্ভুলভাবে কিছু প্রমাণ হয় না।
তবে রাষ্ট্রদূত প্রিন্স খালেদ বিন সালমান দাবি করছেন, জামাল খাসোগজির সঙ্গে এক বছর ধরে তার কোন যোগাযোগ হয়নি
তবে সৌদি আরব এরকম দাবিকে মিথ্যা বলে বর্ণনা করেছে। তারা বলছে, যুবরাজ এই হত্যা পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না।
পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র হিদার নোয়ার্ট বলছেন, মার্কিন সরকার এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌছেছে এমন ইঙ্গিত দিয়ে যেসব খবর বেরুচ্ছে -সেগুলো নির্ভুল নয়।
তিনি বলেন হোয়াইট হাউস এ ঘটনার ব্যাপারে দোষী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা এবং ‘প্রাসঙ্গিক তথ্য’ বের করার জন্য কাজ করে যাবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ ব্যাপারে সিআইএ’র শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছেন বলে জানিয়েছে হোয়াইট হাউস।
সূত্র, বিবিসি