মো: আলী আজম : কথিত আছে প্রায় দেড়শত বছর আগে কালিগঞ্জের জমিদার কালি পোদ্দার বাবু তাঁর মায়ের গঙ্গাস্নান যাত্রার উদ্দেশ্যে কালিগঞ্জ থেকে কালিঘাট পর্যন্ত রাস্তা নির্মান করেন এবং পথচারীদের এইপথ ভ্রমন আরামদায়ক করতে তার দুধারে ছায়াপ্রদ দেবদারু বৃক্ষ রোপন করেন। ইতিহাস বলে- মধ্য ষোড়শ শতাব্দীতে এই পথ পাঞ্জাব থেকে সোনার গাঁও পর্যন্ত গ্রান্ডট্রাংক রোড’র অংশ, নির্মান করেন শের শাহ।এই পথেই জিন্দাপীর আওরংজেবের তাড়া খেয়ে তার বড়ভাই শাহ সুজা আরাকানে পালিয়েছিলেন।আবার ইংরেজদের হাতে বন্দী শেষ মোগল বাহাদুর শাহ রেঙ্গুনে নির্বাসিত হয়েছিলেন এই পথ বেয়ে।
ইতিহাসের মোড়ে মোড়ে রাজা বাদশাদের হাসিকান্নার সাথেসাথে, এই পথে জনহিতৈষনায় শেরশাহ্র ইতিহাসের সাথে কালিপদের জনশ্রুতির কোন বিরোধ নেই। দ্বন্ধ নেই আমরা সুবিধাভোগীদের কান্নাকাটিতেও যখন হালে, বৈষয়িক উন্নয়নের কোপে পড়তে বসেছে ইতিহাসের এই নীরব সাক্ষী, বৃক্ষরাজি।
আমরা বৃক্ষের জন্যে কাঁদি, আমরা সড়কের জন্যে কাঁদি আমাদের কাঁদার শেষ নেই; জীবন সাহিত্যে আমাদের জন্যেই প্রবাদ রচিত হয়েছে ‘কাঁদতে জানে বাঙালি হাসতে জানেনা’। সাম্প্রতিক সময়ে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের কাঁদার উপলক্ষ্য হয়ে এসেছে যশোর রোডের শতবর্ষী ছায়াদার বৃক্ষ। সড়ক প্রশস্তকরণ যজ্ঞে কালের সাক্ষী এই বৃক্ষ শ্রেণী কাটা পড়বে জেনে আমাদের কলিজায় ঘা পড়ছে। আমাদের বলতে আমিও এই বেদনায় সামিল।কেন ? অনেক কুন্ঠা নিয়ে, একান্ত ব্যক্তিগত সে কারণ জানাতে খানিকটা পিছিয়ে যাই।
বাঙ্গালির জাতমারা জেনারেলের কল্যাণে স্রেফ সৌন্দর্য বর্ধনের তাগিদে ঢাকা শহরের শতবর্ষী বৃক্ষসমুহ তখন অকাতরে কোপ খাওয়া সারা। ইতিহাস যেখানে ভুলুন্ঠিত সেখানে ইতিহাসের নীরবসাক্ষী খাড়া থাকে কী করে? অতএব, ইতিহাসের যুগলবন্দী এ্যলেন গিন্সবার্গ আর জর্জ হ্যারিসনের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ তখন কানে বাজলেও আর মর্মে পশেনা। পত্র-পত্রিকায় দেখা শরনার্থীর ঢল চোখ ভেজালেও দেশে তখন প্রিস্নেসদের উদ্বাহু নৃত্য কায়েম হয়েছে।আমরা মজেছি। নিকট অতীতের ক্ষতাক্ত ইতিহাস পথ ছেড়ে দিয়েছে চলমান বর্তমানে।
মনে পড়ে সেই প্রথম আমার যশোর রোডে পা। বলাবাহুল্য প্রথম দর্শনেই সীমান্তের এপার উপারে বৃক্ষরাজির ছায়াবিন্যাসে হাল্কা, ঘনত্বে আক্ষেপ করে বলেছি, ‘ দাও ফিরে সে অরণ্য লহ এই নগর’। সেই শেষবিকেলে আদিগন্ত বিস্তৃত হলুদ-সবুজের সমারোহে চোখ ভিজিয়ে শতবর্শী দেবদারুতে ঠেস দিয়ে বসেছি।তার পাশেই মাঠ চিরে কোন সুদূরে হারিয়ে যাওয়া টেলিগ্রাফের তারে বসে একটা ফিঙ্গে মনের আনন্দে দোল খাচ্ছে। টং দোকানী অনেক্ষন সময় নিয়ে কেটলীর নলে চা’পাতার পুটলি ভিজিয়ে এক কাপ চা করে দিয়েছে। চা’র সাথে একশলা সিগ্রেট- তো আমি আর এই দুনিয়ায় নাই। দক্ষিণা হাওয়ায় দোল খেতে খেতে গাছে বাঁধা বারোয়ারী দিয়াশলাই, জ্বলন্ত রশিখানা কখন যে আমার লুঙ্গিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ঠের পাইনি।জীবনের সাথে প্রকৃতির এই খুনসুটি উপভোগ করতে করতে আজো জীবনের পথ চলি। সামান্যজনের সামান্য স্মৃতি কিন্তু আমার কাছে চোখবুঁজামাত্র এই সামান্যটুকুই হয়ে উঠে অসামান্য ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙ্গা মাটির পথ’।
আজ আবার কৈশোর-যৌবনের সন্ধিতে চিত্তহরা ওই দৃশ্যপট সমানে সামনে। গাছকাটা বিরোধী আন্দোলন প্রচারমাধ্যমে জমজমাট। ওই আন্দোলনে কি আমিও নেই? গাছগুলো বাঁচিয়ে প্রশস্ত পথ হলে কার ক্ষতি? এসব ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে- সেই শেরশাহর আমল থেকে আজ শেখ হাসিনার সময়কাল পর্যন্ত পাঁচশতাধিক বছরব্যাপী, আজকের ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তে অতিমাত্রায় গুরুত্বপুর্ন এই পথ প্রশস্ত করা কিংবা তার বিকল্প রাস্তা তৈরীর কথা কেউ ভাবলেন না কেন ? অন্যত্র, এই গ্রান্ডট্রাংক রোডেরই আরেক অংশ ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক যে পাঁচশত বছর পরে মহিয়সী শেখ হাসিনার ছোঁয়ায় চার লেইনে উন্নীত হল তার দুইপাশে, আমরা যারা বৃক্ষের জন্যে কাঁদি- ক’টা চারা লাগিয়েছি।
কালিপোদ্দার কিংবা শের শাহ হওয়া আমাদের বরাতে নেই, চারা লাগিয়ে বৃক্ষপ্রেমী হতে আমাদের কে মানা করেছে? আসুন এবার একটু বসে কাঁদি।আর হাত লাগাই।