গায়ের রং কালো বলে এক তরুণীকে বিয়ের শর্ত হিসেবে বরপক্ষের পরিবার বড় অংকের যৌতুক দাবি করার পর – সেই মেয়েটি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি ওই পাত্রকে বিয়ে করবেন না।
জ্যোতি চৌধুরী নামের ওই তরুণীর পোস্টে ২০ হাজার ‘লাইক’ পড়েছে। ‘ব্ল্যাক ইজ বিউটিফুল’ শিরোনামের ওই পোস্টে তিনি লেখেন, “আমার গায়ের রঙের জন্য টাকা দিতে আমি রাজী নই।”
পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার জ্যোতি চৌধুরীর বাড়ি জামশেদপুর। তিনি বলছেন, গায়ের রঙ নিয়ে এমন মনোভাবের কারণে বোঝা যায় ভারত এখনো অন্য এক যুগে পড়ে রয়েছে। তিনি আরো বলেন, তার একজন স্বামী পেতে অসুবিধে হবে না।
প্রায় ঠিক হয়ে যাওয়া ওই বিয়ের আগে হবু শ্বশুরবাড়ি থেকে তাঁর কালো গায়ের রংয়ের জন্য বাড়তি পণ চাওয়া হয়েছিল। এই ঘটনার কথা জানিয়ে জ্যোতি নিজেই ফেসবুকে একটি ব্লগ লেখেন। ওই লেখা পড়ে বহু মানুষ তাঁর সাহসী পদক্ষেপের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন।
ভারতে পণ হিসাবে অর্থ নেওয়া বা দেওয়া দন্ডনীয় অপরাধ। বিয়ের সময়ে অন্যান্য কী কী দানসামগ্রী দেওয়া হচ্ছে বরপক্ষকে, সেটাও সরকারী আধিকারিকের কাছে লিপিবদ্ধ করানোর আইনও প্রায় ৫০ বছরের পুরণো।
কিন্তু সেই আইনগুলি শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে খুব কম মানুষই মেনে চলেন।
ঝাড়খণ্ড রাজ্যের বাসিন্দা জ্যোতি চৌধুরীর গায়ের রং শ্যামলা। জামশেদপুরের মেয়ে জ্যোতিকে পছন্দও করেছিল পাত্র পক্ষ। মিজ. চৌধুরীর বাবা মা বারে বারেই পাত্রপক্ষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে তাঁদের মেয়ের রঙ শ্যামলা। সেটা জেনেও বিয়েতে রাজী হয়েছিল পাত্রপক্ষ। তবে হঠাৎই পাত্রের বাবা একদিন ফোন করে বরযাত্রীদের খরচের টাকা চেয়ে বসেন, যা ভারতীয় সমাজের একাংশে পণ চাওয়ারই একটা কৌশল।
হবু বরকে ফোন করেন জ্যোতি, সে-ও যখন প্রকারান্তরে তার বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তে মাথা না ঘামানোর কথা বলে পণের পক্ষেই রায় দেয়, তখনই জ্যোতি হবু বরকে ইংরেজীতে গালাগালি দিয়ে চূড়ান্ত হয়ে যাওয়া বিয়েটা নিজেই ভেঙ্গে দেন।
মুম্বইতে কর্মরত জ্যোতি চৌধুরী বিবিসি-কে বলছিলেন, তিনি বিহারী পরিবারের মেয়ে। তাঁদের সমাজে বেশীরভাগ মানুষই পণ দেওয়া নেওয়াটাকে বিয়ের একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলেই মনে করে।
“বাবা মা যখনই সম্ভাব্য পাত্র খুঁজে পান আর প্রথমেই জানিয়ে দেন দেন যে মেয়ের গায়ের রঙ শ্যামলা, তখনই পাত্র পক্ষের কাছ থেকে শুনতে হয় যে ছেলের জন্য একটা সুন্দরী মেয়ে চাই, কারণ পাত্র এই পড়েছে, সেই চাকরী করে! কেউ আবার গায়ের রঙ শ্যামলা শুনে ঘুরিয়ে জিগ্যেস করে মেয়ের বিয়েতে কত খরচ করতে পারবেন তাঁরা, অর্থাৎ কত টাকা পণ দিতে পারবেন বাবা।”
বিয়ের বয়স হওয়ার সময় থেকেই জ্যোতি বুঝে গিয়েছিলেন যে তাঁদের সমাজে শ্যামলা রঙের মেয়েদের বিয়ে দিতে গেলে বাবা-মাকে বরপণ দিতেই হবে।
তখন থেকেই তিনি ঠিক করে নেন যে গায়ের রংয়ের জন্য কোনও টাকা দেবেন না তিনি, সেটা স্পষ্ট করে লিখেও দিয়েছিলেন একটি জনপ্রিয় পাত্র-পাত্রী সন্ধান ওয়েব সাইটে নিজের প্রোফাইল তৈরী করার সময়।
বিয়ে ভেঙ্গে দেওয়ার সাহসিকতার খবরটা আজ একটা স্থানীয় সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় বেরিয়েছে। তাঁর আত্মীয় স্বজনেরা আজ সকাল থেকে উদ্বিগ্ন যে এই মেয়ের তো এখন বিয়েই হবে না।
বাবার কাছে এই খবর পেয়ে মিজ. চৌধুরী আজ সকালেই ফেসবুকে লিখেছেন, পণ দেওয়া নেওয়াটা আগে হত, এখন আর এ জিনিষ চলবে না।
জ্যোতি বিবিসিকে বলছিলেন “এখনকার সবাই কমবেশী পড়াশোনা করেছে। বহু যুগ ধরে সমাজে যে নিয়মটা চলে আসছে – বরপণ দেওয়ার – সেটা বদলানোর সময় এসেছে.. এখনকার ছেলে মেয়েদেরই বদলাতে হবে। যাঁকেই বিয়ে করুন না কেন, তিনি আশা করেন যে সেই ছেলেটিও এইসব পুরণো ধ্যানধারণার বাইরে থাকবে। আর যে পরিবার পণ চাইবে, বিশেষ করে তাঁর গায়ের রঙ শ্যামলা বলে, সেই পরিবারে তো বিয়ে করে যাওয়ার প্রশ্নই নেই।”
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখার্জি জ্যোতির সাহস দেখে খুবই উৎসাহিত।
তিনি বলছিলেন, “ভারতীয় সমাজের একাংশে মেয়ের গায়ের রং কালো বা শ্যামলা হলেই এই একবিংশ শতাব্দীতেও চিন্তায় পড়ে যান বাবা-মায়েরা। মিসেস মুখার্জী বলছিলেন যে আগেকার দিনে যেমন দুধের সর, গোলাপের পাপড়ি, হলুদ, চন্দন এসব মাখিয়ে মেয়েকে বিয়ের জন্য উপযুক্ত করে তোলার চল ছিল, এখন তেমনই গায়ের রঙ ফর্সা করিয়ে দেওয়ার লোভ দেখানো হয় বিভিন্ন ক্রীমের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে – যে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই কালো মেয়ের মুখ ফর্সা হয়ে যাবে – সে বিয়ের জন্য হোক বা ভাল চাকরীর জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠবে।”
“বিজ্ঞাপনের এই দাবীগুলি যে প্রায় পুরোটাই মিথ্যা, তা চিকিৎসকেরা বারবার বলে থাকেন। শহর থেকে গ্রাম – উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত – শিক্ষিত, অশিক্ষিত – বহু মানুষই ফর্সা মেয়ে ঘরের বউ করে আনা বা পণ নেওয়ার মানসিকতা থেকে বেরতে পারেন না” – মন্তব্য রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখার্জীর।