বাংলাদেশে সরকারের নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এক গণ-বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলেছে, ফলমূল সবজি টাটকা রাখতে ফরমালিনের ব্যবহার নিয়ে জনমনে অযথা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে মানুষজনকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে – ফরমালিন শুধুমাত্র প্রাণীজ প্রোটিনের ওপর কার্যকরী, সুতরাং ফলমূল-সবজি টাটকা রাখতে এই রাসায়নিক আদৌ কার্যকরী নয়।
এছাড়া, সাম্প্রতিক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, খাদ্যে ফরমালিন প্রয়োগের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
কেন তারা জনগণকে আশ্বস্ত করার সিদ্ধান্ত নিলেন?
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মনজুর মোর্শেদ আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ফরমালিন নিয়ে জনমনে নানা অস্পষ্টতা এবং বিভ্রান্তির কারণে খাদ্য নিয়ে বহু মানুষের মধ্যে অনর্থক ভীতি তৈরি হয়েছে যেটা ভাঙ্গা প্রয়োজন।
“মানুষজন হরহাশেমা বলেন, ফরমালিনের ভয়ে ফলমূল খাওয়া তারা ছেড়ে দিয়েছেন, এ ধরণের খাদ্য-ভীতি জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এর ফলে ফলমূলে যে অতি-আবশ্যিক পুষ্টিগুণ রয়েছে তা থেকে মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে।”
শুধু তাই নয়, মি আহমেদ মনে করেন, দেশের খাদ্য সম্পর্কে মানুষের আস্থা পোড় খাচ্ছে। “এতে খাদ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, বিদেশে বাংলাদেশের ইমেজ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, পর্যটনের জন্যও খাদ্যের এই ইমেজ খারাপ।”
তাহলে বাংলাদেশে শাক-সবজিতে কি ফরমালিন ব্যবহার হয়না?
মনজুর মোর্শেদ আহমেদ- যিনি একজন মাইক্রো-বায়োলজিস্ট- বলেন, ফরমালিন বা ফরমাল-ডিহাইড্রের দ্রবণ কোনোভাবেই ফলমূল শাক-সবজির ওপর বিক্রিয়া করে না।
তিনি বলেছেন, ফরমালিন শুধু প্রাণীজ প্রোটিন বা আমিষের ওপর কাজ করে, আমিষের সাথে বিক্রিয়া করে এক ধরণের ‘মিথিলিন ব্রিজ’ তৈরি করে যাতে মৃতদেহ পচে না, তাও দীর্ঘ সময় ধরে ফরমালিন দ্রবণে ডুবিয়ে রাখতে হয়।
“সুতরাং শাক-সবজির ওপর ফরমালিন প্রয়োগ করে কোনোই লাভ নেই। এটা কোনো একসময় কেউ করার চেষ্টা করলেও এখন আমরা তার কোনো প্রমাণ দেখতে পাইনা।”
মি. আহমেদ বলেন, জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার সহযোগিতায় সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে শাক-সবজিতে তারা ফরমালিন প্রয়োগের কোনো প্রমাণ পাননি।
তিনি বলেন, এমনিতেই ফল বা সবজিতে প্রাকৃতিক-ভাবেই কিছু ফরমালিন তৈরি হয় যা শরীরের জন্য নিরাপদ।
বাংলাদেশে বর্তমানে বহু মানুষের ধারণা ফলমূলে এখন দেরিতে পচে এবং তাদের বদ্ধমূল ধারণা ফরমালিন প্রয়োগের কারণে এটা হচ্ছে।
কিন্তু মি. আহমেদ বলেন, মানুষের এই আশঙ্কার কোনো ভিত্তি নেই। তিনি বলেন, আপেল এবং বেশ কিছু ফল যেগুলো আমদানি হয়, বিদেশ থেকে আসার আগেই এসব ফলের ওপর মোমের প্রলেপ দেওয় হয়। “রেসপিরেশন (বাতাস ঢোকা বা বেরুনো) আটকে থাকার ফলে আপেলগুলো অনেকদিন পচে না, তাছাড়া আপেল এমন একটি ফল যেটি অনেকদিন ভালো থাকে।”
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের এই বক্তব্য অনেকাংশেই সমর্থন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড নাজমা শাহিন।
বিবিসিকে তিনি বলেন, শাক-সবজি বা ফলের ওপর ফরমালিন প্রয়োগ অর্থহীন কারণ তাতে কোনো লাভ নেই।
“একজন মানুষের প্রতিদিন ৪০০ গ্রাম ফল শাক-সবজি খাওয়া দরকার, কিন্তু অনেক মানুষ অনর্থক আতঙ্কে এগুলো এড়িয়ে চলেন…বহু মানুষ আমাকে জিজ্ঞাসা করেন আপা বলেন তো কী খাবো?..”
তবে মাছ টাটকা রাখতে ফরমালিন এখনো যে ব্যবহারের চেষ্টা হয় না তা হলফ করে বলতে পারলেন না ড শাহিন।
তিনি বলেন – বাংলাদেশে ফরমালিনের ব্যবহার শুরু হয়েছিল যখন মিয়ানমার থেকে মাছ আমদানি শুরু হয়। “ওরা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঠেকাতে ফরমালিন ইনজেক্ট করে দিতো। সেই থেকে বাংলাদেশের মাছ বিক্রেতারাও সেটা শুরু করে দেয়। মুদির দোকানেও ফরমালিন বিক্রি শুরু হয়ে গিয়েছিল।”
তিনি বলেন, এখন সেটা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
২০১৩ সালে খাদ্যে ফরমালিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। একই সাথে খাদ্য সংরক্ষণে যে কোনো অনুনোমোদিত রাসায়নিক প্রয়োগের অপরাধে পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান তৈরি হয়।
পরে ২০১৫ সালে সরকার ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন তৈরি করে এবং খাদ্যে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়।
সূত্র, বিবিসি