বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এই সিরিজ আলাদা জায়গা পেয়ে আছে আগেই। শেষ ম্যাচে নিশ্চিত হয়ে গেল, অস্ট্রেলিয়াও এই সিরিজ সহজে ভুলবে না! হতাশার সফরে তাদের শেষটা হলো বিভীষিকার মতো। বিশ্ব ক্রিকেটের প্রতাপশালী দলটি গুটিয়ে গেল টি-টোয়েন্টিতে নিজেদের সর্বনিম্ন রানে। দাপুটে জয়ে বাংলাদেশ সমাপ্তি টানল অবিস্মরণীয় এক সিরিজের।
শেষ ম্যাচে সোমবার অস্ট্রেলিয়াকে ৬০ রানে হারিয়ে পাঁচ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ ৪-১ ব্যবধানে জিতে নিল বাংলাদেশ। অথচ এই সিরিজের আগে টি-টোয়েন্টিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একটিও জয় ছিল না বাংলাদেশের।
৬০ রানের এই ব্যবধানও চমকে যাওয়ার মতোই। টি-টোয়েন্টিতে এই ব্যবধান যে কোনো সময়ই অনেক বড়। আর রান খরার এই সিরিজের প্রেক্ষাপটে তো বিশাল জয়!
নাহ, বাংলাদেশ বড় কোনো স্কোর গড়তে পারেনি। যথারীতি উইকেট ছিল মন্থর ও টার্নিং। ব্যাটিংয়ের শুরুটা দারুণ হলেও সিরিজের ধারা মেনে ২০ ওভারে স্কোরবোর্ডে জমা হয় ১২২ রান। সিরিজ জুড়ে ব্যাটিংয়ে বারবার খাবি খাওয়া অস্ট্রেলিয়া সবচেয়ে ভোগান্তির শিকার হলো শেষ ম্যাচেই। তাদের ইনিংস ১৩.৪ ওভারে শেষ ৬২ রানেই!
টি-টোয়েন্টিতে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে কম রান ও সবচেয়ে কম ওভারে অলআউট হওয়া এটিই। বাংলাদেশের বিপক্ষেও এটি টি-টোয়েন্টিতে কোনো দলের সর্বনিম্ন রান।
বাংলাদেশের বোলিং নায়ক সাকিব আল হাসান। আগের ম্যাচে ওভারে ৫ ছক্কার হতাশা পেছনে ফেলে এবার তার শিকার স্রেফ ৯ রানে ৪ উইকেট।
এই পরিক্রমায় অসাধারণ এক কীর্তিও গড়া হয়ে যায় তার। দ্বিতীয় উইকেটটি ছিল তার শততম টি-টোয়েন্টি উইকেট। এই সংস্করণের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে অর্জন করলেন একশ উইকেট ও ১ হাজার রানের ডাবল।
তার এই মাইলফলকের দিনটি আরও উজ্জ্বল হলে রইল ম্যান অব দা ম্যাচ ও ম্যান অব দা সিরিজ হয়ে।ম্যাচের শুরুটা বাংলাদেশের ছিল চমকপ্রদ। টানা তৃতীয় ম্যাচে টস জিতে ব্যাটিং বেছে নেন মাহমুদউল্লাহ। আগের চার ম্যাচে ব্যর্থ সৌম্য সরকারকে একাদশে রাখলেও ওপেন করানো হয়নি। মোহাম্মদ নাঈম শেখের সঙ্গে ইনিংস শুরু করেন মেহেদি হাসান। নতুন এই জুটি বাংলাদেশকে এনে দেন অভাবনীয় শুরু।
তিন বিশেষজ্ঞ স্পিনার নিয়ে নামা অস্ট্রেলিয়া দুই প্রান্তে স্পিন দিয়ে শুরু করে আক্রমণ। টি-টোয়েন্টিতে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার দুই স্পিনার দিয়ে শুরু করল তারা। আগেরবারও ছিল মিরপুরেই, ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে।
তবে অস্ট্রেলিয়ার এই কৌশল কাজে দেয়নি। আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশকে ঝড়ো সূচনা এনে দেন নাঈম ও মেহেদি। প্রথম ৩ ওভারেই দুজন তোলেন ৩৩ রান।
মেহেদি পরে আউট হয়ে যান ১২ বলে ১৩ রান করে। তবু ২৭ বলে ৪২ রানের যে জুটি, দুই দল মিলিয়েই তা সিরিজের সেরা উদ্বোধনী জুটি।
তবে অমন শুরুটাকে কাজে লাগাতে পারেনি দল। নাঈম ২৩ বলে ২৩ করে আউট হন ড্যান ক্রিস্টিয়ানকে রিভার্স ব্যাটে খেলতে গিয়ে। সাকিব আল হাসান ধুঁকতে ধুঁকতে করতে পারেন ২৪ বলে ১১।
চারে নেমে সৌম্য সরকার একটি ছক্কা মারতে পারলেও শেষ পর্যন্ত আউট হন ১২ রানেই। সিরিজে প্রথমবার অবশ্য দুই অঙ্কের দেখা তিনি পেলেন! অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহও একটি ছক্কার পর এগোতে পারেননি বেশিদূর (১৪ বলে ১৯)।
ব্যাটিং দুরূহ উইকেটে এই সিরিজে সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ ছিলেন যিনি, সেই আফিফ হোসেনকে বিস্ময়করভাবে সাতে নামায় বাংলাদেশ। ততক্ষণে শেষ প্রায় ১৫ ওভার!
প্রথম বলেই ক্রিস্টিয়ানকে ডাউন দা উইকেটে ছক্কা মারেন আফিফ চোখধাঁধানো শটে। তবে দ্রুত রানের চেষ্টায় তিনিও ফেরেন ১০ রানেই।
দুই পেসার ন্যাথান এলিস ও ক্রিস্টিয়ান একের পর এক স্লোয়ার ও কাটার করে আটকে রাখেন বাংলাদেশের রান। শেষ ৫ ওভারে মাত্র ২০ রান তুলতে পারে বাংলাদেশ, বাউন্ডারি আসে ১টি।
তবে উইকেটের যা অবস্থা ছিল, ১২৩ রান তাড়া করতে হলে অস্ট্রেলিয়াকে করতে হতো দারুণ কিছু। অভাবনীয় কিছু তারা পারেওনি।
আগের ম্যাচে সাকিবের ওভারে ৫ ছক্কা মারা ক্রিস্টিয়ানকে এবার ওপেনিংয়ে নামায় অস্ট্রেলিয়া। নাসুম আহমেদ তাকে বোল্ড করে দেন দ্বিতীয় ওভারেই। এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান পরে ফেরান সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার সেরা ব্যাটসম্যান মিচেল মার্শকে।
দুই ছক্কা মেরে হুমকি হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ম্যাথু ওয়েড। আক্রমণে এসে দ্বিতীয় বলেই তাকে থামান সাকিব। এরপর কেবল একের পর এক ব্যাটসম্যানের আসা-যাওয়া।
অ্যাশটন টার্নারকে ফিরিয়ে তিনি স্পর্শ করেন শততম উইকেট আর দারুণ ডাবল। সিরিজে প্রথমবার খেলতে নেমে মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিনের শিকার ৩ উইকেট। সাকিব পরে এক ওভারে দুই উইকেট নিয়ে ইতি টানেন ম্যাচের। শেষ হয় অস্ট্রেলিয়ার দুঃসহ অভিযান।
জয়টা এতটাই একপেশে, বাংলাদেশের জয়োৎসবও তেমন একটা জমল না। তাদের উদযাপনে বরং ফুটে উঠল, ‘এ আর এমন কী!’
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ১২২/৮ (মেহেদি ১৩, নাঈম ২৩, সাকিব ১১, সৌম্য ১৬, মাহমুদউল্লাহ ১৯, সোহান ৮, আফিফ ১০, মোসাদ্দেক ৪*, সাইফ ০, মুস্তাফিজ ০*; টার্নার ২-০-১৬-১, অ্যাগার ৪-০-২৮-১, জ্যাম্পা ৪-০-২৪-১, এলিস ৪-০-১৬-৩, ক্রিস্টিয়ান ৪-০-১৭-২, সোয়েপসন ২-০-১৪-০)।
অস্ট্রেলিয়া: ১৩.৪ ওভারে ৬২ (ক্রিস্টিয়ান ৩, ওয়েড ২২, মার্শ ৪, ম্যাকডারমট ১৭, কেয়ারি ৩, হেনরিকেস ৩, টার্নার ১, অ্যাগার ২, এলিস ১, সোয়েপসন ১*, জ্যাম্পা ৪; মেহেদি ৩-০-২০-০, নাসুম ২-০-৮-২, মুস্তাফিজ ১-০-৩-০, সাইফ ৩-০-১২-৩, সাকিব ৩.৪-০-৯-৪ , মাহমুদউল্লাহ ১-০-৯-১)।
ফল: বাংলাদেশ ৬০ রানে জয়ী।
সিরিজ: ৫ ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশ ৪-১ ব্যবধানে জয়ী।
ম্যান অব দা ম্যাচ: সাকিব আল হাসান।
ম্যান অব দা সিরিজ: সাকিব আল হাসান।