স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী আজ মঙ্গলবার (১৭ মার্চ)। তার জন্মশতবার্ষিকীর এই ক্ষণ থেকেই শুরু হবে ‘মুজিববর্ষ’। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে উদযাপন করা হয়। এবারও দিনটি বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন তথা জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে উদযাপন করা হবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টার জন্মশতবার্ষিকীর পুরো বছরটি সরকার ‘মুজিববর্ষ’ হিসেবে পালন করার ঘোষণা দিয়েছে। সে অনুযায়ী ১৭ মার্চ, ২০২০ থেকে ২৬ মার্চ ২০২১ সাল পর্যন্ত ‘মুজিববর্ষ’ উদযাপন করা হবে।
রাত আটটায় বঙ্গবন্ধুর জন্মক্ষণে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আতশবাজির মধ্যদিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর কর্মসূচির উদ্বোধন করা হবে। রাষ্ট্রপতি তার ভাষণের পরপর আতশবাজির মাধ্যমে জন্মশতবার্ষিকীর কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ রাত আটটায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা শেখ সায়েরা খাতুন। লুৎফর-সায়েরা দম্পতির এ সন্তানই পরে এ দেশের মানুষের মুক্তির ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হন। শতবর্ষ পূর্বে পরাধীনতার নিকষ অন্ধকারে নিমজ্জিত বাঙালি জাতির ভাগ্যাকাশে মুক্তির প্রভাকর রূপে জন্ম নেওয়া ‘খোকা’ নামের সেই শিশুটি শিক্ষা-দীক্ষা মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, মহত্তম জীবনবোধ সততা, সাহস, দক্ষতা ও দূরদর্শী নেতৃত্বে হয়ে ওঠেন বাংলাদেশ নামক স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্রের মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।
জাতির পিতার জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার একদিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। মুজিববর্ষের উদ্বোধন উপলক্ষে ব্যাপক কর্মসূচির প্রস্তুতি থাকলেও করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে তা সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করলেও তার অধিকাংশই কাটছাঁট করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তার বাণীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় পরিণত করতে অঙ্গীকার নিতে সবার প্রতি আহবান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে আমাদের ভবিষ্যৎ ‘শিশুদের’ কল্যাণে বর্তমানকে উৎসর্গ করার আহবান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আসুন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করি। দলমত নির্বিশেষে সকলে মিলে বঙ্গবন্ধুর ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতামুক্ত স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলি।
কর্মসূচি
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। সকাল সাড়ে ৬টায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু ভবন ও দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে স্থাপিত জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করা হবে। সকাল ১০টায় আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ হবে। পরে সেখানে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
বিশেষ প্রার্থনা
বাদ জোহর দেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের পাশাপাশি দেশের সব মসজিদে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া দেশের সব ধর্মের উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনা করা হবে। এর অংশ হিসেবে সকাল ৮টায় তেজগাঁও গির্জায়, সকাল ৯টায় মিরপুর ব্যাপ্টিস্ট চার্চ (৩/৭-এ সেনপাড়া, পবর্তা, মিরপুর-১০)-এ খ্রিস্টান সম্প্রদায়, সকাল ১০টায় রাজধানীর মেরুল বাড্ডা আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহারে বৌদ্ধ সম্প্রদায় এবং সকাল সাড়ে ১১টায় ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে হিন্দু সম্প্রদায় প্রার্থনা সভার আয়োজন করা হবে।
এতিম ও দুঃস্থ মানুষের মাঝে খাবার ও মিষ্টি বিতরণ
দুপুর ১২টায় আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক উপ-কমিটির উদ্যোগে আজিমপুর এতিমখানায় অসহায়, দুস্থ ও এতিমদের মাঝে খাবার, বস্ত্র ও করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে ব্যবহার্য সামগ্রী বিতরণ করা হবে। দুপুর ১টায় ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বনানী করাইল বস্তিতে এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এতিম ও দুস্থ মানুষের মাঝে খাবার ও মিষ্টি বিতরণ করা হবে। এছাড়া বাদ আসর রাজধানীর প্রতিটি ওয়ার্ডে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ খাবার ও মিষ্টি বিতরণ করবে। সারাদেশে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অনুরূপ কর্মসূচি পালন করা হবে।
আতশবাজি ও আলোকসজ্জা
রাত ৮টায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মক্ষণ উপলক্ষে সারাদেশে একযোগে আতশবাজি প্রদর্শনী ও ফানুস উত্তোলন। আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ধানমন্ডি ৩২-এ বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে, ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবর, হাতিরঝিল, সোরাওয়ার্দী উদ্যান, টিএসসি ও জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় আতশবাজি প্রদর্শনী হবে। এছাড়া আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়কে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের জেলা-উপজেলায় ইতোমধ্যে বর্ণিল সাজ-সজ্জা করা হয়েছে। রাত ৮টার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী জাতীয় ও বাস্তবায়ন কমিটির আয়োজনে একযোগে সব গণমাধ্যমে প্রচারিত অনুষ্ঠান ঘরে বসে দেখার জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্কুলজীবনেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। কৈশোরে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকাবস্থায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে প্রথমবারের মতো কারাবরণ করেন। ম্যাট্রিক পাসের পর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের মতো রাজনৈতিক নেতাদের সান্নিধ্যে আসেন। এ নেতাদের সাহচর্যে তিনি নিজেকে ছাত্র-যুব নেতা হিসেবে রাজনীতির অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করেন।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর পরই ঢাকায় ফিরে নতুন রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা নিয়ে অগ্রসর হন বঙ্গবন্ধু। সহকর্মীদের নিয়ে ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ গঠন করেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন তৎকালীন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠিত হলে তরুণ নেতা শেখ মুজিব দলটির যুগ্ম সম্পাদক পদ পান। পরে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে দলের নামকরণ করা হয় আওয়ামী লীগ।
বঙ্গবন্ধু বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, আটান্নর আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনসহ পাকিস্তানি সামরিক শাসনবিরোধী সব আন্দোলন-সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাঙালির অধিকার আদায়ের এসব আন্দোলনের কারণে বারবার কারাগারেও যেতে হয় তাকে। বঙ্গবন্ধু ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রিসভায় স্থান পান। আওয়ামী লীগ প্রধান হিসেবে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন তথা বাঙালির মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুসহ নেতৃত্বে স্থানীয় ব্যক্তিদের নামে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করে তাদের কারাগারে পাঠান। ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাঙালি শেখ মুজিবকে কারামুক্ত করে। এ সময়ে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করা হয়।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নানা চক্রান্ত করে বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। এরপর বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে প্রথমে স্বাধিকার আন্দোলন এবং চূড়ান্তপর্বে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ দেন। এ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় একাত্তরের মার্চে নজিরবিহীন অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এরই ধারাবাহিকতায় ২৬ মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু বেশিদিন দেশ গঠনের কাজ করে যেতে পারেননি। তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে নিজ বাসভবনে ক্ষমতালোভী ঘাতকদের হাতে সপরিবারে নিহত হন। স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর জীবনাবসান ঘটে।
সূত্র, বাংলা ট্রিবিউন