অগ্রদৃষ্টি ডেস্কঃ দেশে এ বছর পাটের বাম্পার ফলন হয়েছে। আবাদও এক লাফে বেড়ে গেছে প্রায় এক লাখ হেক্টর। শতকরা হিসাবে পাটের এবার আবাদ বেড়েছে ১১৩ শতাংশ। অতীতে পাট আবাদের ক্ষেত্রে এতো বড় উল্লম্ফন আর দেখা যায়নি। মূলত আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার পাটের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলে পাটের উৎপাদন ৮০ লাখ বেল ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যা গত বছরের চেয়ে ১৩ লাখ বেল বেশি। বাম্পার ফলনের পাশাপাশি কৃষকরাও এবার পাটের বাড়তি দাম পাচ্ছে। ভাল দাম পাওয়ায় এবার পাট কাটা, জাগ দেয়া, আঁশ ছাড়ানো, শুকানো এবং বিক্রির কাজে এখন ব্যস্ত সময় পার করছে কৃষকরা। কৃষি বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এবার বাজারে বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে পাট। দীর্ঘদিন পর পাটের কাক্সিক্ষত দাম না পেয়ে হতাশ কৃষকের মুখে হাসি ফুঠেছে। বর্তমানে মণপ্রতি পাট সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকারও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। মৌসুমে এটাই স্বাধীনতার পর পাটের সর্বোচ্চ দাম। বাজারে নতুন পাট বিক্রির শুরুতেই বাড়তি দামে কৃষকদের মধ্যে উৎসাহের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ গতবার মৌসুমের শুরুতেই কৃষক পর্যায়ে প্রতিমণ পাট বিক্রি হয়েছিল ১ হাজার ৬৫০ টাকায়। কিন্তু এবার এখনই কৃষক পাটের দাম পাচ্ছে ১৮শ’ থেকে দুই হাজার টাকা। তাছাড়া মৌসুমের শুরু থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা মণে বিক্রি হয়েছে পাট। কাঁচাপাট রফতানি নিষিদ্ধ ও ৬টি পণ্যে পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার আইন কার্যকর করায় পাটের সুদিন ফিরে আসতে শুরু করেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সূত্র জানায়, দেশের হাট-বাজারগুলোতে ইতিমধ্যে পুরোদমে পাট উঠতে শুরু করেছে। দেশের বড় পাটের মোকাম নারায়ণগঞ্জে পুরোদমে চলছে পাট কেনাবেচা। মোকামগুলোতে ঈদের পর পাটের আমদানি বেড়েছে। দামের কারণে দেশের প্রায় এক কোটি পাটচাষী মহাখুশি। তারা পাট নিয়ে সুদিনের আশায় আবার বুক বেঁধেছেন। সারাদেশে চাষীরা এখন পাট কেটে তা জাগ দেয়াসহ নানা কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। ইতিমধ্যে ৫০ শতাংশেরও বেশি জমির পাট কাটা হয়ে গেছে। এই বছর পর্যাপ্ত বৃষ্টি থাকায় পাট জাগ দিতে কৃষকের তেমন অসুবিধা হচ্ছে না। চলতি পাট মৌসুমে ৭ লাখ ২০ হাজার ৯৮৭ হেক্টর জমিতে পাট আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ওই জমি থেকে পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এই বছর ৭৭ লাখ বেল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আবাদ হয়েছে ৮ লাখ ১৭ হাজার ৩৮৩ হেক্টর জমিতে। এবছর অতিরিক্ত ৯৬ হাজার ৩৯৬ হেক্টর জমিতে পাট আবাদ বেশি হয়েছে। ফলে এবার পাটের আবাদ ৮০ লাখ বেল ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গতবছর সারাদেশে ৭ লাখ ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে পাট আবাদ হয়েছিল। আর পাট উৎপাদিত হয়েছিল ৭৪ লাখ বেল। তার আগে ২০১৪-১৫ সালে ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৫ হেক্টর জমিতে এবং ২০১৩-১৪ সালে ৬ লাখ ৬৫ হাজার ৭৪৩ হেক্টর জমিতে পাট আবাদ হয়েছিল।
সূত্র আরো জানায়, বিশ্বের মোট পাটের ৯০ শতাংশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতে। দুই দেশই নিজের ব্যবহারের পাশাপাশি চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে। কিন্তু গতবছর পাট কাটা মৌসুমে ন্যায্যমূল্য নিয়ে কৃষকের মধ্যে হতাশা ছিল। ওই বছর পাটের ভরা মৌসুম জুলাই-আগস্টে প্রতিমণ পাটের দাম ছিল ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। অক্টোবরে এসে পণ্যটির দাম হঠাৎ বেড়ে দাঁড়ায় মণে আড়াই হাজার টাকা। কৃষক কম দামে পাট বিক্রি করলেও ফড়িয়ারা লাভ করেছেন মণে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত। মূলত ভরা মৌসুমে বিজেএমসি পাট না কেনায় কৃষক সস্তায় পাট বিক্রি করতে বাধ্য হয়। কিন্তু এবছর পাট মৌসুমেই বিজেএমসি পাট ক্রয়ে মাঠে নেমেছে। এবার পাট ক্রয়ের বিষয়টি সরাসরি তদারক করছেন পাট প্রতিমন্ত্রী। ইইতিমধ্যে তিনি বিজেএমসিতে কর্মকর্তাদের উদ্দেশে পাট ক্রয়ে গুণগত মান বজায় রাখার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, আগে খোলা আকারে পাট কেনা হতো। তাতে গুণগত মান নিয়ে সন্দেহ থাকত। তাই বেল আকারে পাট কিনতে হবে। যাতে গুণগত মান বজায় থাকে। বেল আকারে পাট কিনলে গুণগত মানে নিয়ে কোন সংশয় থাকবে না।
এদিকে কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতীতে কোনো ফসলের আবাদ এক লাফে এক লাখ হেক্টর বেড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। মূলত গত বছর মৌসুমের শেষদিকে পাটের দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষক পাট চাষে বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে। ওই কারণেই এবার পাটের আবাদ এতো বেশি বেড়ে গেছে। অন্যান্য বছর পাটের বাম্পার ফলনেও কৃষকের মাঝে দাম নিয়ে শঙ্কা থাকে। এবছর ঠিক তার উল্টো ঘটনা ঘটছে। সুপার বাম্পার ফলনেও কৃষক মৌসুমে ভাল দাম পাচ্ছে। আর তা সম্ভব হয়েছে ছয়টি পণ্যে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করায়। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় আরো ১২ পণ্যে পাটের মোড়ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে যাচ্ছে। তা হলে দেশে পাটের ব্যাগের চাহিদা দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। তখন পাটের দাম কৃষক আরো বেশি পাবে। তাছাড়া বর্তমান সরকার দেশে পাটের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তারমধ্যে পাটের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের আওতায় উচ্চ ফলনশীল (উফশী) পাট ও পাটবীজ উৎপাদন এবং উন্নত পাট পচন শীর্ষক প্রকল্প নেয়া হয়েছে। দেশের পাট উৎপাদনকারী ৪৪ জেলার ২শ’ উপজেলাকে ওই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় প্রতিবছর পাট উৎপাদনের জন্য ২ লাখ এবং পাটবীজ উৎপাদনের জন্য ৫০ হাজার মোট ২ লাখ ৫০ হাজার চাষীকে বিনামূল্যে ভিত্তি ও প্রত্যায়িত পাটবীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক, হ্যান্ড স্প্রেয়ারসহ প্রতিবছর ২০ হাজার চাষীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। সনাতন পদ্ধতিতে পাটের একরপ্রতি ফলন ছিল ১৮-২০ মণ। বর্তমানে প্রকল্প এলাকায় আধুনিক প্রযুক্তি এবং উচ্চ ফলনশীল পাটবীজ ব্যবহার করায় পাটের একরপ্রতি ফলন ৩০-৩৫ মণে উন্নীত হয়েছে। তাছাড়াও গত ৫ বছরে পাটজাতীয় ফসল অর্থাৎ কেনাফ, মেস্তার ৫ জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। যান্ত্রিক রিবনার আধুনিকায়ন করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে ইতিপূর্বে দেশে গড় ৪ দশমিক ৫ থেকে ৫ লাখ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ করে ৪৫ থেকে ৫০ লাখ বেল পাট উৎপাদিত হতো। বর্তমানে দেশে গড়ে ৭ থেকে ৭ দশমিক ৫ লাখ হেক্টর জমিতে পাট আবাদ হয়ে ৭৫ থেকে ৮০ লাখ বেল পাট উৎপাদিত হচ্ছে।
অন্যদিকে এবার কৃষককে পাটের ন্যায্যমূল্য দিতে ও পাট ক্রয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি কমাতে চলতি মৌসুম থেকে বিজেএমসি মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে পাট কিনবে বলে জানিয়েছে। এমনকি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কৃষককে পাট বিক্রির অর্থও পরিশোধ করা হবে। সেজন্য পাটচাষীদের জন্য একটি ডাটাবেজও তৈরি করা হয়েছে। চলতি মৌসুমে পাইলট প্রকল্প হিসেবে সিরাজগঞ্জকে বেছে নেয়া হয়েছে। সে লক্ষ্যে বিজেএমসি সারাদেশে ৫৬ পাট ক্রয়কেন্দ্র চালু করেছে। ইতিমধ্যে পাট কেনার জন্য শর্তসাপেক্ষে বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনকে (বিজেএমসি) ২৬০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অবশ্য বিজেএমসির পক্ষ থেকে চলতি মৌসুমে পাট কেনার জন্য ৮শ’ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছিল। আর বিজেএমসি চলতি বছর পৌনে ২৬ লাখ কুইন্টাল পাট কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। ওই পরিমাণ কেনার জন্য সংস্থাটির দরকার পড়বে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম জানান, পাটের বস্তার চাহিদা সৃষ্টির কারণে দেশে পাটের চাহিদা বেড়ে গেছে। ফলে কৃষক তাদের উৎপাদিত পাটের ভাল দাম পাচ্ছে। আর ভাল দাম পাওয়ার কারণে কৃষক এখন পাট চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এবছর দেশে পাটের উৎপাদন একলাফে ২০ শতাংশ বেড়ে গেছে। আর গত বছরের চেয়ে প্রায় এক লাখ হেক্টর জমিতে এবার পাটের আবাদ বেশি হয়েছে।