আন্তর্জাতিক ডেস্ক: দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে একটি বিষয় সম্প্রতি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে- একদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েন যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিতে চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে আরো গভীরে নিয়ে যাচ্ছে ইসলামাবাদ। শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, বিশ্বজুড়ে নেতৃত্ব দেয়ার লক্ষ্য চীনের। পাক-চীন এই সম্পর্কে চ্যালেঞ্জে পড়েছে বিশ্বব্যাপী মার্কিন নেতৃত্ব।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন ট্রান্স-প্যাসিফিক ভিউয়ের লেখক মার্সি কুওঠ। যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া নীতি নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব টেনিসির হাওয়ার্ড এইচ বেকার জুনিয়র সেন্টার ফর পাবলিক পলিসির রিসার্চ ফেলো হ্যারিসন আকিন্সের সঙ্গে এসব কথা বলেছেন কুও।
তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা বন্ধের কারণ এবং এর প্রভাব ব্যাখ্যা করুন।
কুও বলেন, এর মূল কারণ হলো আফগানিস্তানে তালেবানদের পেছনে পাকিস্তানের সমর্থন। এই তালেবানরা ন্যাটো বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা করছে। এ কারণেই পাকিস্তানের সামরিক সহায়তা বন্ধ করে তাদের ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্সের নজরদারি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে হাক্কানি গ্রুপের মতো সংগঠনের সাথে মূলত আইএসআইয়ের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করে এসেছে, যাতে আফগানিস্তানে কৌশলগত একটা শক্তি থাকে তাদের। ভারতের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণেই এটা করে পাকিস্তান, যাতে পশ্চিম সীমান্তে ভারতের প্রভাব মোকাবেলা করা যায়।
এই বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যকার এই সমস্যাটি বর্তমান মার্কিন প্রশাসনের ভেতরেই সীমাবদ্ধ নয়। এর আগেও এই দুই মিত্রের মধ্যে সমস্যা ছিল। দুই দেশই তাদের নিজস্ব স্বার্থে এই সম্পর্ককে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে কখনও মূলা ঝুলানো হয়েছে, কখনও লাঠি দেখানো হয়েছে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত অভিযান কিংবা পরে মার্কিন আগ্রাসনের সময় নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যই মূলত সামরিক সহায়তা দিয়ে পাকিস্তানকে সহযোগিতা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আবার দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন স্বার্থ যখন কমে এসেছে, যেমন সোভিয়েতরা আফগানিস্তান থেকে সরে যাওয়ার পর পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচির উপর নিষেধাজ্ঞা দিতে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অতীতে যখনই যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহায়তা কাটছাট করেছে, পাকিস্তান অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামাদি কেনার জন্য অন্যান্য বড় শক্তি বিশেষ করে চীনের সাথে সম্পর্ক গভীর করার চেষ্টা করেছে। এটাকে ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার জন্য পদক্ষেপের অংশ হিসেবে দেখা যায়।
কুওকে বলা হয়েছিল, চীন কীভাবে পাকিস্তানের পছন্দের সামরিক অস্ত্রের যোগানদাতা হয়ে উঠলো- সেটা ব্যাখ্যা করুন।
পাকিস্তানকে দেয়া সামরিক সহায়তা বাতিলের সাথে সাথে যখন পাকিস্তানবিরোধী বক্তব্য দেয়া শুরু করলো যুক্তরাষ্ট্র, তখন স্বাভাবিকভাবেই মার্কিন অস্ত্রের ব্যাপারে আস্থা হারিয়েছে পাকিস্তান। এ কারণেই পাকিস্তানের রাজনৈতিক শ্রেণি এটা ভাবতে শুরু করেছেন যে চীন তাদের সব সময়ের মিত্র। তারা যুক্তরাষ্ট্রের মতো নয়। ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্টদের বিজয়ের পর চীনকে প্রথম যারা স্বীকৃতি দিয়েছিল, তাদের মধ্যে পাকিস্তান অন্যতম। পরে ১৯৯৮ সালে পাকিস্তানের প্রথম পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছিল চীন। এ ক্ষেত্রে চীনা বিশেষজ্ঞ এবং তাদের ইউরেনিয়ামের উপর নির্ভর করতে হয়েছিল পাকিস্তানকে। চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপিইসি) এই সম্পর্ককে আরও মজবুত করেছে। সিপিইসি চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর কাশগরের সাথে পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দরকে সংযুক্ত করছে। দুই স্থানের মধ্যে দূরত্ব প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার। চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভের অধীনে সিপিইসিতে চীনা বিনিয়োগের পরিমাণ ২০৩০ সাল নাগাদ ৪৬ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে।
এই সম্পর্ক এখন সামরিক সম্পর্কের দিকে ঘুরে গেছে। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে প্রায় কাছাকাছি পরিমাণে সামরিক সহায়তা দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছিল ৩৯ শতাংশ আর চীন দিয়েছিল ৩৮ শতাংশ। ২০১৬ সালে ৬৩ শতাংশ সহায়তা আসে চীনের কাছ থেকে আর মাত্র ১৯ শতাংশ আসে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। পাকিস্তান এখন চীনা সামরিক সরঞ্জামের সবচেয়ে বড় গ্রাহক। চীনের পুরো অস্ত্র রফতানির ৩৫ শতাংশই যাচ্ছে পাকিস্তানের কাছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় সামরিক ভারসাম্য চীনের দিকে ঘুরে যাওয়ার ফল কী হতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে কুও জানান, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের সামরিক সম্প্রসারণ এর অর্থনৈতিক বিস্তারের সাথে সাথেই হচ্ছে। চীন এখন আগ্রাসীভাবে তাদের প্রভাব বিস্তারের যে চেষ্টা করছে, সেটাকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার এশিয়া নীতির প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখছেন অনেক বিশ্লেষক। চীন আঞ্চলিক দেশগুলো বিশেষ করে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক বাড়াচ্ছে, ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে কারণ চীনের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য সহযোগী দেশ হলো ভারত, এসব কারণে এই অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব শেষ বিচারে কমে আসছে। এমনকি ট্রাম্প প্রশাসন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শাস্তি দেয়ার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন, সেগুলোও তেমন কাজে আসছে না।
কুওয়ের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, পাকিস্তান চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণে আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক অভিযানে কতটা প্রভাব পড়বে?
আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযানের পেছনে পাকিস্তানের সহায়তার দিকটা গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানের ভেতর দিয়েই নিজেদের রসদ পরিবহণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৭ সালের দিকে ন্যাটো বাহিনী প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫ লাখ ৭৫ হাজার গ্যালন জ্বালানি ব্যবহার করেছিল। এর ৮০ শতাংশই এসেছিল পাকিস্তানের পরিশোধনাগারগুলো থেকে। তাছাড়া প্রধান বিমান ঘাঁটিগুলোর সম্মিলিত সংরক্ষণ ক্ষমতা ৩ মিলিয়ন গ্যালনেরও কম। যে কারণে পাকিস্তানের সরবরাহ লাইনের উপর নির্ভর করতে হয়েছে তাদের।
এটার কথা বিবেচনা করেই সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একবার বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানকে যদি ঠিকমতো না পাও, তাহলে আফগানিস্তানে তুমি জিততে পারবে না।’ পাকিস্তানের দিক থেকে কোন ধরনের অসহযোগিতা হলে আফগানিস্তানে মার্কিন মিশন অনেক জটিল ও ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। ২০১১ সালের ২৬ নভেম্বর ন্যাটো বাহিনীর হাতে দুর্ঘটনাক্রমে পাকিস্তানের ২৪ জন সেনা নিহত হওয়ার পর এমনটাই ঘটেছিল। পাকিস্তান সাময়িকভাবে তাদের সরবরাহ লাইন বন্ধ করে দিয়েছিল। ট্রাম্প প্রশাসন পাকিস্তানের সামরিক সহায়তা বাতিল করে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হুমকি দিচ্ছে। আবার একইসাথে আফগানিস্তানে মার্কিন সেনার সংখ্যা বাড়িয়েছে। এ অবস্থায় পাকিস্তান আবার যদি তাদের সরবরাহ লাইন বন্ধ করে দেয়, তাহলে আফগানিস্তানে মার্কিন মিশন ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
এশিয়ার প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির উপর পাকিস্তান-চীন ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কী প্রভাব পড়বে? এতে মার্কিন নীতিতেই বা কী প্রভাব পড়বে- জিজ্ঞেস করলে কুও বলেন, চীন যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে, পাকিস্তান-চীন সম্পর্ক তার সামান্য একটা অংশ মাত্র। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পটি এরই একটা অংশ যেটার মাধ্যমে বিশ্বের অর্থনৈতিক নেতা হতে চায় চীন। এছাড়া সামরিক অস্ত্র কেনার ব্যাপারে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুখ ফিরিয়ে চীনের দিকে ঘুরে যাওয়ায় এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। কারণ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে চীনা সামরিক বাহিনীর প্রভাব পড়বে। এতে দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠবে কারণ ভবিষ্যতেও সামরিক সরঞ্জামাদির জন্য চীনের উপর নির্ভর করতে হবে পাকিস্তানকে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও অতীতে এমনটা ঘটেছিল। এর চূড়ান্ত ফল হিসেবে ভবিষ্যতে পাকিস্তানে মার্কিন সহায়তা বা তাদের চাপ প্রয়োগের কৌশলে কোন কাজ হবে না।