অগ্রদৃষ্টি ডেস্কঃ গুলশানের জঙ্গি হামলার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে নিখোঁজ যে ১০ যুবকের তালিকা দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে জুন্নুন শিকদার ও মোহাম্মদ বাসারুজ্জামান লেখাপড়া করেছেন ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
জুন্নুনদের বাসা রাজধানীর জিগাতলায়। ২০১৪ সালে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসীমউদ্দিন রাহমানীর সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়ে তিনি এক বছর কারাগারে থাকার পর জামিনে মুক্ত হয়েছিলেন তিনি।
তার বাবা ওয়াহিদুর রহমান খোকন মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,প্রায় আট মাস আগে বাসা থেকে বেরিয়ে যান জুনুন। কয়েকদিন পরে ফোনে মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা জানিয়েছিল।
“তারপর থেকে তার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ নেই।”
অন্যদিকে বাসারুজ্জামান রাজশাহীর তানোর উপজেলার লালপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সিরাজ উদ্দিনের ছেলে। সিরাজ উদ্দিন তানোর উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য।
মামা তালন্দ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম বলছেন, ২০০৭ সালে বাসারুজ্জামান নর্থ সাউথের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর থেকে বাড়ির সঙ্গে তার যোগাযোগ কমে গিয়েছিল। বছর দুই আগে ঢাকায় বিয়ে করার পর তা আরও কমে যায়।
গণমাধ্যমে ছবিসহ সংবাদ প্রকাশের পর বাবার বাড়ির লোকজন বাসারুজ্জামানের নিখোঁজ থাকার বিষয়টি জানতে পারেন বলে তার মামার ভাষ্য।
গত ১ জুলাই গুলশানে হামলাকারী যুবকদের সবাই বেশ কয়েক মাস ধরে নিখোঁজ ছিলেন, যাদের মধ্যে নিবরাজ ইসলাম ছিলেন নর্থ সাউথ ইউনিভারসিটির ছাত্র।
এর এক সপ্তাহের মাথায় শোলাকিয়ায় হামলা চালাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত আবীর রহমানও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনিও চার মাস আগে নিখোঁজ হন বলে পরিবারের ভাষ্য।
নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তানরা বাড়ি পালিয়ে জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হওয়ার তথ্য আসতে থাকায় সরকারের পক্ষ থেকে অভিভাবকদের কাছে তথ্য চাওয়া হয়। বেশ কিছুদিন ধরে নিখোঁজ রয়েছেন এমন ১০ যুবকের নাম ও ছবি প্রকাশ করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।
ওই তালিকা দেখেই ছেলে নিখোঁজ থাকার কথা জানতে পারে লক্ষ্মীপুরের এ টি এম তাজউদ্দিন কাউসারের পরিবার। থানায় জিডি করে তার স্কুলশিক্ষক মা দাবি করেন, তার অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ছেলে যে নিখোঁজ তা তিনি এতদিন জানতেন না।
প্রায় একই রকম কথা বলছেন রাজশাহীর বাসারুজ্জামানের স্বজনরা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ঢাকার তেজগাঁওয়ের মনিপুরি পাড়ায় তার যে ঠিকানা দিয়েছে, সেটি তার শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা। নিখোঁজ হওয়ার আগে ওই বাসাতেই তিনি ছিলেন বলে তার মামার ভাষ্য।
তবে মনিপুরি পাড়ার ওই বাসায় এ নামে কেউ ছিলেন না বলে দাবি করেন ২৭ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি আবু সাদেক।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,“বাড়িটি আমাদের। বাসারুজ্জামান নামে কেউ এ বাসায় ছিলেন না, এখনো নেই। তবে আমার বড় ভাইয়ের নাম বাসার। তিনি ঠিকাদারি করেন। এক সময় ছাত্রলীগের হয়ে তিতুমীর কলেজের ভিপি ছিলেন।”
তবে আবুল কাশেম বলছেন, জোতদার পরিবারের সন্তান বাসারুজ্জামান দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড়। সংবাদমাধ্যমে ছবি আসার পর তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, গত ছয় থেকে সাত মাস ধরে শ্বশুরবাড়ির কারও সঙ্গেও তার যোগাযোগ নেই।
বাসারুজ্জামান দুই বছর আগে একটি বিদেশি কোম্পানিতে চাকরি নেন বলে শুনেছেন তার মামা। তবে সেই কোম্পানির নাম তিনি জানাতে পারেননি।
আবুল কাশেম জানান, গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসি পাস করার পর রাজশাহী নিউ ডিগ্রি সরকারি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়েন বাসারুজ্জামান। রাজশাহী নগরীর শিরোইল এলাকার বাড়িতে থেকেই কলেজে লেখাপড়া করেন তিনি।
“চাকরি পাওয়ার পর ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতেই ও থাকত। বিয়ের পর গ্রামের বাড়ি এসেছিল কেবল একবার।”
আবুল কাশেম জানান,ছয় থেকে সাত মাস আগে তার ভাগ্নে দুই মাসের জন্য অফিসের কাজে মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা বলে শ্বশুরবাড়ি থেকে বের হয়। এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি, পরিবারের সঙ্গেও সে যোগাযোগ করেনি।
বাসারুজ্জামান ‘আওয়ামী লীগ পরিবারের ছেলে’ হয়ে জঙ্গিবাদে জড়াবে, তা ‘বিশ্বাস করতে পারছেন না’ বলে মন্তব্য করেন তার মামা।
এ বিষয়ে বাসারুজ্জামানের বাবা সিরাজ উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
মা বানিসা বেগম বানু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছোট থেকেই বাসার লাজুক ছিল। গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে তেমন মিশত না। বন্ধু-বান্ধব ছিল না বললেই চলে। ঢাকায় যাওয়ার পর থেকে বাড়িতে খুব কম আসত।”
তানোর থানার ওসি আব্দুস সালাম বলেন, ঈদের আগে বাসারুজ্জামানের শ্বশুর তেজগাঁও থানায় জিডি করেছেন শোনার পর তারা গ্রামের বাড়িতে খোঁজ খবর নিয়েছেন।
“ছবি দেখে তার বাবা-মা নিশ্চিত করেছেন যে, সে তাদের ছেলে এবং ৬/৭ মাস ধরে তার সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই।”
বাসারুজ্জামান বিদেশে গেছেন না দেশেই আত্মগোপন করে আছেন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান ওসি আব্দুস সালাম।
তবে বাসারুজ্জামানের বিষয়ে ঢাকার তেজগাঁও থানায় কোনো জিডি হয়নি বলে ওই থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম জানিয়েছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জিডির খবর পেয়ে গত এক বছরের নথি তারা পরীক্ষা করেছেন। কিন্তু ওই নামে কারও জিডির তথ্য পাননি।
এদিকে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জিগাতলায় জুন্নুনদের বাসায় গিয়ে প্রধান ফটকে তালা লাগানো দেখা যায়। পরে ফটকে ‘ভাড়া হবে’ নোটিশে লেখা নম্বরে ফোন করা হলে এক ব্যক্তি ধরেন। তার থেকে জুন্নুনের বাবার নম্বর পাওয়া যায়।
তার বাবা ওয়াহিদুর রহমান খোকন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এক বছর কারাভোগের পর জুন্নুন ছাড়া পেলে গোয়েন্দা পুলিশ কয়েক দফায় তাকে নিয়ে কথা বলে ছেড়ে দেয়।
“ঘন ঘন ডেকে নেওয়া নিয়ে তার সাথে আমার বেশ কথা কাটাকাটি হয়। প্রায় আট মাস আগে এ সব বিষয় নিয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে সে রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে যায়।”
তার প্রায় ১৫ দিন পর ফোন করে জুন্নুন জানায়,সে মালয়েশিয়া আছে।
জুন্নুনরা দুই ভাই-বোন জানিয়ে ওয়াহিদুর বলেন, তারা দুজনই নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। জুন্নুন ষষ্ঠ সেমিস্টার পর্যন্ত সেখানে পড়েছে।
জসিমউদ্দিন রাহমানির সঙ্গে তার ছেলের ভাল সম্পর্ক ছিল জানিয়ে তিনি বলেন,“জসিমউদ্দিন যেখানে ইমামতি করত, সেখানে জুন্নুন প্রতি শুক্রবার জু্মার নামাজ পড়তে যেত।
“নিয়মিত নামাজ পড়া ছাড়াও কোনো হাদিস না বুঝলে জসিমউদ্দিন রাহমানির কাছে গিয়ে সেটা বুঝে নিত।”