সাহাদাত সাঈদ:: ভারত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে গর্ব করে থাকলেও তারা কি আসলেই ধর্মনিরপেক্ষ। বর্তমানে এমন প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে সবার মনে। বেশ কিছু দিন ধরে ভারতে একের পর এক ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার পর এমন প্রশ্ন বেশি করে উঠছে। ধর্মীয় এই অসহিষ্ণুতার সাধারণ মানুষদের ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বলিউড পাড়ায়ও। আর এই অসহিষ্ণুতার শিকার হয়েছেন খোদ বলিউড কিং শাহরুখ খান, সালমান খান, আমির খান ও জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী এ আর রহমানের মত মুসলীম অভিনেতা ও সঙ্গিত শিল্পীরা।
সালমান খান তার টুইট বার্তায় ইয়াকুব মেননের ফাঁসি সর্ম্পকে মন্তব্য করায়, শাহরুখ খান তার জন্মদিনে ‘ধর্মনিরপেক্ষ না হওয়াই সব থেকে বড় অপরাধ’ বলে মন্তব্য করায়, এ আর রহমানের ইরানী ছবিতে গান গাওয়ায় এবং আমির খান দেশের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতায় সঙ্কিত বলে মন্তব্য করায় সারা ভারত জুড়ে এ অসহিষ্ণুতা আরো বেশি ডানা বেঁধে ওঠে।
ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা তাদেরকে নানাভাবে আক্রমনাত্ত্বক ভাষায় কথা বলছে। কিন্তু এই ভারত ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় এবং একটি নতুন সংবিধান প্রবর্তিত করে। এই সংবিধান অনুযায়ী ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভারত নিজেকে কখনোই ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে প্রমান করতে পারেনি।
বিভাজনের রাজনীতি ও দেশে বাড়তে থাকা অসহিষ্ণুতা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই সরব ছিলেন দেশের শিল্পী, অভিনেতা, পরিচালকরা। দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দ পটবর্ধনসহ ১৩ জন পরিচালক ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তাঁদের জাতীয় পুরস্কার। একাধিক সাহিত্যিক অধ্যাপক কালবুর্গি হত্যার প্রতিবাদে পুরস্কার ফিরিয়ে দেন।
পুরস্কার ফেরান বিজ্ঞানী পি এম ভার্গবও। ওস্তাদ আমজাদ আলি খানের মতো বর্ষিয়ান শিল্পী প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন এ বিষয়ে আরও কড়া হওয়ার জন্য। শর্মিলা ঠাকুর, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো দেশের বর্ষিয়ান শিল্পীরা পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়া পরিচালকদের সমর্থনই জানান।
গত ২ নভেম্বর ২০১৫ ইং ছিল বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খানের ৫০ তম জন্মবার্ষিকী ছিল। তিনি তার জন্মদিনে দেশের অসহিষ্ণু পরিবেশ নিয়ে কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন “ধর্মনিরপেক্ষ না হওয়াই সব থেকে বড় অপরাধ”। আর এমন মন্তব্যরে পরই ভারত জুড়ে তোলপাড় শুরু হয় উগ্রবাদী হিন্দু গোষ্ঠীদের মধ্যে ।
রাত পেরুনের আগেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আক্রমণের লক্ষ্যে পরলেন শাহরুখ খান। ‘শাহরুখ পাকিস্তানের দালাল’ বলে মন্তব্য করেন সাধ্বী প্রাচীর। সাথে সাথে তিনি শাহরুখ খানকে ভারত ছাড়ারও পরামর্শ দেন।
কালবর্গি হত্যাকাণ্ড, গোমাংসের খোঁজে কেরল হাউসে পুলিশের তল্লাশি, মুম্বাইয়ে ওস্তাদ গুলাম আলির অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়াসহ আরও নানান ইস্যুতে দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। একের পর এক পদক ফিরিয়ে দিচ্ছেন দেশের সেরা কলাকুশলীরা। পরিচালক থেকে লেখক-লেখিকা তালিকাটা বেশ লম্বা। ৫০ তম জন্মদিনে শাহরুখ তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘যারা পদক ফেরাচ্ছেন তাদের আমি সম্মান করি’।
আর সেই পদক ফেরানো নিয়ে শাহরুখের মন্তব্যকেও কটাক্ষ করেন সাধ্বী প্রাচীবলেন, ‘শুধু শাহরুখই নয়, যারা যারা পদক ফিরিয়েছেন তারা বিশ্বাসঘাতক’। সাধ্বী আরও বলেন, ‘শাহরুখকে আমাদের দেশের অনেকে ভালবাসেন, তার উচিত হিন্দু ফ্যানদের সম্মান করা’।
স্ত্রীকে সত্যিই ভালোবাসলে হিন্দু ধর্মে রূপান্তরিত হোন। বলিউড অভিনেতা শাহরুখ খান, আমির খান, সাইফ আলি খানকে আক্রমণ করল হিন্দু মহাসভা।
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সাপ্তাহিক পত্রিকা হিন্দু সভা বার্তায় লাভ জিহাদ নিয়ে সরাসরি এই অভিনেতাদের আক্রমণ করলো হিন্দু মহাসভা। শাহরুখ, আমির, সাইফের পাশাপাশি ফারদিন খান এবং ইমরান হাসমিকেও হিন্দু মহিলাদের বিয়ে করার জন্য আক্রমণ করা হয়েছে।
ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার প্রতিবাদে সোমবার ৫০তম জন্মদিনে মুখ খোলায় বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খানকে আক্রমণ শুরু করে বিজেপি ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। শাহরুখকে বিজেপির মহাসচিব কৈলাস বিজয়বর্গীয় মঙ্গলবার দেশদ্রোহী এবং সাধ্বী প্রাচী পাকিস্তানের এজেন্ট বলে কটাক্ষ করেছিলেন।
টুইটারে ভারতের মুম্বাইয়ে ১৯৯৩ সালে ধারাবাহিক বোমা হামলার দায়ে দোষী সাব্যস্ত ইয়াকুব মেমনের ফাঁসির সাজা নিয়ে কথা বলেছিলেন সুপার স্টার সালমান খান। তিনি টুইট বার্তায় লিখেছিলেন, ‘ইয়াকুব মেমনকে নয়, তার ভাই টাইগার মেমনকে ফাঁসি দেয়া উচিত’। তিনি আরো লিখেছিলেন ‘যদি ফাঁসি দিতে হয়, তাহলে টাইগারকে গ্রেফতার করে ফাঁসি দেয়া হোক, তার ভাইকে নয়।’
এই টুইটের পর সারা ভারতে শুরু হয় সমালোচনার সাইক্লোন শুরু হয়, ভারতের সরকারি আইনজীবী উজ্জ্বল নিকম সালমানের টুইটের প্রতিবাদে বলেছিলেন,‘সালমানের টুইট আপত্তিজনক। আদালত যাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে, তাকে নির্দোষ বলা হলে এটা সরাসরি আদালত অবমাননা। আমরা আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছি।’
ভারতে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে মন্তব্য করার পর অভিনেতা আমির খানের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠেছে ভারতে। তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পাশাপাশি, তার বাড়ির সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শনও করা হয়েছে।
সম্প্রতি ভারতে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমির বলেন, সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথাও ভেবেছেন তার স্ত্রী।
বিজেপির মুখপাত্র শাহনেওয়াজ হুসেইন বলেন, “আমরা আমির খানের মন্তব্য পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করছি। তিনি শঙ্কিত নন, তবে জনমনে শঙ্কা ছড়ানোর চেষ্টা করছেন। আমির খান একটা মন্তব্য করলেন আর রাহুল গান্ধী সমর্থন করলেন। এতেই বোঝা যায় যে জাতির ভাবমূর্তি নষ্ট করার একটা ষড়যন্ত্র চলছে।”
“ভারতই তাকে যাবতীয় সম্মানের অধিকারী করেছে। তার ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, ভারতই তাকে তারকা করেছে।”
আরেক বিজেপি সাংসদ ইয়োগি আদিত্যনাথ বলেন, মানুষ ভারত ছেড়ে চলে যেতে চাইলে যেতে পারে, কারণ তাতে দেশের জনসংখ্যা কমবে।
মুম্বইয়ের রাজা অ্যাকাডেমি ইরানের ছবি ‘মুহম্মদ’-এর গানে সুর দেওয়ার তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে। সেই সময় দিল্লি ও উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শেষ মুহূর্তে রহমানের অনুষ্ঠান বাতিল করে দেন। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ তাঁকে ফের হিন্দুত্বে ফেরানোর জন্য আহ্বান জানান।
এ আর রহমান সেই সব সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, সভ্য সমাজে এই ধরনের ঘটনা স্বাভাবিক নয়, কোনো কিছুই হিংস্র হওয়া উচিৎ নয়। আমরা সবাই সভ্য সমাজের বাসিন্দা। আমাদের গোটা বিশ্বকে দেখিবে দেওয়া উচিৎ যে আমরাই সব থেকে বেশি সভ্য।’
সবশেষে এ ধরনের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতায় ভারতের বলিউডে কোন প্রভাব পরতে পারে বলে মনে করছে অনেক শিল্পী, কলা কৌসুলী,প্রযোজক ও বিশিষ্ট জনেরা। তবে ভারত বিশ্বের অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, সেখানে অন্য ধর্মের লোকদের উপর এরকম অসহিষ্ণু আচরন সম্পূর্ণ সংবিধান পরিপন্থি। ভারত স রকারের উচিৎ হবে এধরনের সমস্যার শিগগিরই সমাধান করা।
(তথ্য সূত্র: কলকাতা টোয়েন্টি ফোর, আনন্দবাজার, এবিপি আনন্দ, ইন্টারনেট)