সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২তম সমাবর্তনে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য একথা বলেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত কোর্স ছাড়াও বিভিন্ন বাণিজ্যিক কোর্স পড়ে প্রতিবছর হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে। এতে ডিগ্রিধারীদের লাভ নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এক শ্রেণির শিক্ষক ঠিকই লাভবান হচ্ছেন।
“তারা নিয়মিত নগদ সুবিধা পাচ্ছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করছেন। ফলে শিক্ষার পরিবেশের পাশাপাশি সার্বিক পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এখন দিনে সরকারি আর রাতে বেসরকারি চরিত্র ধারণ করে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সন্ধ্যায় মেলায় পরিণত হয়। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।”
কিছু শিক্ষক নিয়মিত কোর্স পড়ানোর বিষয়ে অনেকটাই উদাসীন মন্তব্য করে আচার্য বলেন, “কিন্তু ইভিনিং কোর্স, ডিপ্লোমা কোর্স ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার বিষয়ে তারা খুবই সিরিয়াস। কারণ এগুলোতে নগদ প্রাপ্তি থাকে।”
সান্ধ্যকালীন কোর্সের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান তুলে রাষ্ট্রপতি বলেন, সন্ধ্যার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ থাকে না। একটা সাবজেক্ট আছে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস- ২২টা কোর্স। প্রতি কোর্সে সাড়ে ১০ হাজার টাকা।
“২ লাখ ৩০ হাজার না কত যেন হয়। শুনছি এর অর্ধেক শিক্ষকরা পায় আর বাকি অর্ধেক ডিপার্টমেন্ট পায়। ডিপার্টেমেন্টের টাকা কি হয় জানি না। যারা সিনিয়র টিচার শুধু তারাই ক্লাস নেয়।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জবাবদিহিতার কথা স্মরণ করিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, “মনে রাখবেন বিশ্ববিদ্যালয় চলে জনগণের টাকায়। সুতরাং এর জবাবদিহিও জনগণের কাছে। জনগণের এই অর্থে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের যেমন ভাগ আছে তেমনি ভাগ আছে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা পয়সা সততার সঙ্গে সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার দায়িত্ব উপাচার্য ও শিক্ষকদের।””
পদ-পদবী পেয়ে শিক্ষকরা নিজেদের কাজ ভুলে যাচ্ছেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, কোনো কোনো উপাচার্য ও শিক্ষকের কর্মকাণ্ড দেখলে মনে হয় তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল কাজ কি তা ভুলে গেছেন।
“বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শুধু জ্ঞানদান করা নয়। বরং অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগানোই হচ্ছে আসল কাজ। গবেষণা হচ্ছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক কাজ।”
গবেষণার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে রাষ্ট্রপতি বলেন, পদোন্নতির জন্য গবেষণা, না মৌলিক গবেষণা তাও বিবেচনায় নিতে হবে। অনেক বিভাগেই এখন অন্যান্য পদের শিক্ষকের চেয়ে অধ্যাপকের সংখ্যা বেশি।
“অনেক শিক্ষকই প্রশাসনিক পদ-পদবি পেয়ে নিজে যে একজন শিক্ষক সে পরিচয় ভুলে যান।”
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ‘অমানবিক ও অনভিপ্রেত’ ঘটনা বিশ্ববিদ্যাল ও শিক্ষার্থীদের সুনাম ক্ষুণ্ন করেছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “ছাত্রছাত্রীরা লেখাপড়া করে জ্ঞান অর্জনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, লাশ হয়ে বা বহিষ্কৃত হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য নয়।
“কর্তৃপক্ষ সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ নিলে এসব ঘটনা অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব হতো। তাই কর্তৃপক্ষ এর দায় একেবারে এড়াতে পারে না। আমি আশা করব, ভবিষ্যতে কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে সময়মত সঠিক পদক্ষেপ নেবে।”
মা-বাবার আশা-আকাঙ্ক্ষা, কষ্ট ও ত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি বলেন, “তোমাদের মূল দায়িত্ব হলো লেখাপড়া করা এবং দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলা। তোমরা এমন কোনো কাজ করবে না যাতে তোমাদের পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের সম্মান ক্ষুণ্ন হয়।”
উচ্চশিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে অহেতুক উদ্বেগ ও অর্থ ব্যয় থেকে শিক্ষার্থী ও পরিবারকে রেহাই দিতে ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমন্বিত গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা’ পদ্ধতি চালু করার আহ্বান জানান তিনি।
রাষ্ট্রপতি বলেন, “প্রথম যখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় রেজাল্ট দিয়ে দেয়। শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে চান্স পাবে কী পাবে না এই চিন্তা থেকে আগে কলেজে ভর্তি হয়ে যায়। সরকারি কলেজে ভর্তি হতে গেলে প্রায় ৫ হাজার টাকা লাগে বেসরকারি কলেজে ২০-২৫-৩০ হাজার টাকা লাগে।
“পরে অনেকেই ঢাকাসহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে যায়। পরে যেখানে ভর্তি হয়ে আছে, সেখানকার ভর্তি বাতিল করতে টাকা লাগে। অনেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় অনেক টাকা দিয়ে। ওই ছেলে বা মেয়ে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায় তখন সেটা বাতিল করে আসে। তখন মূল মার্কশিট, সনদ ফেরত আনতে ২০-২৫ হাজার দিতে হয়।
সেজন্য ডিসেম্বরের মধ্যে সব পরীক্ষা শেষ করে ১ থেকে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে ভর্তির ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, “তাহলে শিক্ষার্থীরা তাদের চান্স পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দমত ভর্তি হবে। অনর্থক অর্থদণ্ড থেকে মুক্তি পাবে। হয়রানি থেকে রক্ষা পাবে।”
‘ডাকুস নেতাদের কথা যা শুনি ভালো লাগে না’
রাষ্ট্রপতি বলেন, “ডাকসু নির্বাচন হলো, আশা করছিলাম, এই ডাকসু নেতারা কথাগুলো বলবে। দাবি-দাওয়া করবে। আমি কেন বলবো? আমি চ্যান্সেলর। আমাকে কেন বলতে হবে? ছাত্রনেতাদের এসব কথা বলা উচিত। তারাতো এ ব্যাপারে কোনো কথা বলে না। বরং তাদের ব্যাপারে অন্য এমনসব কথা শুনি, যেগুলো আমার ভালো লাগে না। এর বেশি কিছু বলে আমি কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চাই না। তাদের কর্মকাণ্ড আমার ভালো লাগে না। ছাত্রদের কল্যাণ তাদের টপ প্রোয়োরিটি দেওয়া উচিত।
“এই ছেলেরা যদি বলতো, আপনিতো আমাদের ইউনিভার্সিটিতে চান্সই পাননি। ছাত্র খারাপ ছিলেন, আপনার কাছ থেকে ডিগ্রি নিতাম না। এই কথা বললে অযৌক্তি হবে না, এটা সত্য। এ কথা বললে আমি কইতাম, আমি আর আইতাম না। ভবিষ্যতে কোন পণ্ডিত-গুণী-জ্ঞানী-ব্যক্তিকে পাঠায়া দিয়া বলতাম সভাপতিত্ব করে ডিগ্রি দিয়া আসেন। এই দাবি করলেও মানতে অসুবিধা নেই। তারা মনে করতে পারে, আমি ম্যাট্রিক থার্ড ডিভিশন, ইন্টারে লজিক রেফার্ড পাইছি। এই ধরণের ছাত্রে কাছ থেকে ডক্টরেট-পিএইচডি নেওয়া কি শোভা পায়? এই ধরণের কথা যৌক্তিক ছিল। তাদের দাবি একসেপ্ট করব।”
ভেজাল ওষুধ: ছাত্রদের এগিয়ে আসার আহ্বান
রাষ্ট্রপতি বলেন, “আজকে এমবিবিএস আর ফার্মেসি সার্টিফিকেট দিছি। ডাক্তার সাহেবরা সমানে প্রেসক্রিপশন দেয়। মফস্বলে যে মেডিসিন দেয় তা মেয়াদ উত্তীর্ণ থাকে। আমি অনুরোধ করবো, ডাক্তার-ফার্মাসিস্ট এ বিষয়টি দেখবেন। নিজে ওষুধগুলো পরীক্ষা করে দেখবেন। মেয়াদ পার হয়ে গেলে বিষ হয়ে যায়।
“ওষুধ নাকি ২-৩ রকমের হয়, বেস্ট কোয়ালিটি বিদেশে যায়। এক প্রকার ঢাকায় আর মফস্বলে খারাপ কোয়ালিটিরটা যায়। ছাত্র সমাজকে এ বিষয়টি রুখে দিতে হবে। এ নিয়ে সজাগ থাকা দরকার। ভেজাল ওষুধ নিয়ে সতর্ক থাকা দরকার। জাতি হিসেবে না হয় পঙ্গু হয়ে যাব।”
অনুষ্ঠানে সমাবর্তন বক্তা ছিলেন জাপানের টোকিও ইউনিভার্সিটির স্পেশাল প্রফেসর ২০১৫ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল জয়ী তাকাকি কাজিতা। সমাবর্তনে প্রফেসর কাজিতাকে সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব সায়েন্স’ ডিগ্রি দেয়া হয়।
কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে অনুষ্ঠিত সমাবর্তনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান এবং উপ-উপাচার্য মুহাম্মদ সামাদও বক্তব্য দেন।
সমাবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয় এবং অধিভুক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ২০ হাজার ৭১৭ জনকে ডিগ্রি দেওয়া হয়। কৃতিদের মধ্যে ৯৮টি স্বর্ণ পদক দেওয়া হয়।
সূত্র, বিডিনিউজ২৪