এত বছরে এত ঘটনা, এত বেড়ানো, এত অভিজ্ঞতা – কোনটা যে আগে লিখব আর কোনটা পরে ভেবে পাচ্ছিনা।
আগে বরং কয়েকটা কথা ক্লিয়ার করে দিই :
এক :
পৃথিবীতে ইসলামিক রাষ্ট্র অনেক। কুয়েত তার মধ্যে একটি। সব দেশের সংবিধান আলাদা। কুয়েতেরও। জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি, আইনকানুন সবার আলাদা আলাদা ; কুয়েতেরও। আমি কেবলমাত্র কুয়েতের কথাই লিখছি। কুয়েত মানে কাতার ওমান সৌদি দুবাই পাকিস্তান কি কাবুল ইত্যাদি নয়। ওসব দেশের কথা আমি জানিনা । খামোখা অন্যান্য দেশের সঙ্গে কুয়েতকে গুলিয়ে ফেলবেননা।
দুই :
এখানে আমি কোন ধর্মীয় আলোচনা করছিনা। সে যোগ্যতাই আমার নেই। ধর্মবিদ্বেষ প্রভোকও করছিনা। তথাপি আমার লেখায় কারুর বিশ্বাস আঘাত পেলে খুব দুঃখ পাব। যদি অপ্রীতিকর তর্কাতর্কী শুরু হয়, আশা করব সবার সক্রিয় হস্তক্ষেপে সেটা মিটে যাবে।
গল্পে আসি। প্রথম প্রথম এদেশে এসে অবাক হয়ে যেতাম, এত বড়োলোকও হয় ! জিনিসের প্রাইস ট্যাগ দেখেনা, টপাটপ একগাদা কাপড়চোপড় হাবিজাবি তুলে নিয়ে ক্যাশ কাউন্টারে যায় সব। আর আমি দুই কেডির একটা চামচ তুলে ভারতীয় মূল্যে কত হচ্ছে হিসেব করে নেড়েচেড়ে কলকাতায় কিনব ভেবে যথাস্থানে রেখে দিই। কর্তা বলেন এইভাবে সব জিনিস টাকায় তুলনা করলে জীবনেও এদেশে শপিং করতে পারবনা। তাও কিনিনা তা নয়।খেজুর নিয়ে যাই সবার জন্য। আলমারাইয়ের নানাবিধ ফলের রস, আতর, কতরকম সুগন্ধি এয়ার ফ্রেশনার আর বাবার জন্য বুকরাগ, মানে বইয়ের জন্য কার্পেট কাপড়ের পেজমার্ক।মুসলিম স্বজনদের জন্য কম্পাস দেওয়া জায়নামাজ, তসবী নিয়ে যাই ।
অনেকে আমায় জিজ্ঞাসা করেন এতবছরে সোনাদানা কত কি কিনলাম। ভেবে পাইনা কেন কিনব ! সেই তো দ্য দামাসের জয়জয়কার। মালিক আমাদের দেশের ; নীরব মোদী। দামও কিছু কম নয় এখানে। আর দেশে তো সোনা পরার জো নেই বাপু ; পুতি মাটি কাঠ সুতো পিতল এইসব তো পরে বেড়াই। সোনার লোভে কে কান টানবে, কে গলা কাটবে । লকারে রাখার জন্য গয়না না কিনে সে পয়সায় ঘুরে বেড়ানো ভালো।
এদেশে এসে একটা কথা হাড়েহাড়ে বুঝেছি, জাত দুরকম ; ধনী আর দরিদ্র। কুয়েতিরা সবাই ধনী। কর্তা মজা করে বলেন এদের সবার বাড়ির উঠোনে একটা করে তেলের চৌবাচ্চা আছে। তাই এরা সবাই জাতে ধনী। ফিলিপাইনস, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান – কুয়েতিদের চোখে এরা সব জাতে দরিদ্র। গরীব দেশের হিন্দু মুসলমান এদেশে “এক দেহে হল লীন” । তাই বাংলাদেশী মুসলমান অপরিচিত ট্যাক্সি ড্রাইভার যখন আমার সিঁথিতে সিঁদুর দেখে বাঙালী বুঝে আপা বলেন, আমার ছেলেকে ভাগ্না বলেন বড়ো মধুর লাগে ; আত্মিক যোগ খুঁজে পাই। ফোন নম্বর রেখে দিই, ডাকলে হাজার কাজ ফেলেও বাংলা ভাষার টানে ছুটে আসেন।
কুয়েতে মহিলাদের হিজাব, বোরখা বা পুরুষদের ডিসডাসা বাধ্যতামূলক নয়। এঁরা নিজের ঐতিহ্যকে ভালোবেসে পরেন। বোধহয় চড়া রোদের জন্যও পরেন। অনেকে আবার পরেননা। বোরখার তলায় থাকে জিন্স টিশার্ট। মস্ত মস্ত গাড়ি চালিয়ে মহিলারা দিব্যি অফিস কাছারি যান। ওয়াটার পার্কে গেলে চেঞ্জিং রুমে এঁদের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই। বঙ্কিমচন্দ্রের নায়িকা যেন সব। পাকা গমের মত গায়ের রং, মাখনের মত মোলায়েম ত্বক, কাটাকাটা মুখ চোখ, চাঁপার কলির মত আঙুল। কিন্তু লাবণ্যের বড্ড অভাব ; একটু যেন কঠোরও। পুরুষরাও অপরূপ সুন্দর।
এখানে সব জায়গায় প্রেয়ার রুম থাকে। মাঠে গামছা পেতে নামাজ পড়তে হয়না। নারী পুরুষের আলাদা আলাদা নামাজ ঘর। এয়ারপোর্ট, পার্ক, শপিং মল সর্বত্র।তবে আজান শুনলেই নামাজ পড়তেই হবে এমন কিন্তু নয়। যার যার নিজস্ব ভক্তি, বিশ্বাস এবং ইচ্ছে। পার্কে বসে নিজের চোখে দেখেছি আজান শুনে অনেকে প্রেয়ার রুমে গেলেন, অনেকে আবার বসে বসে পপকর্ন কফি খাচ্ছেন। দেখে শান্তি পাই যে, এদেশে অন্ততঃ ইসলাম এঁদের স্বেচ্ছায় ধর্মাচরণের স্বাধীনতা দিয়েছেন।
লেখক:
গার্গী চক্রবর্তী (ভারত)
চলবে……