আমার আব্বা আম্মার বিয়ে হয় ১৯৬৪ সালে। আমার দাদা বাড়িতে দাদী আর আম্মা ছাড়া কোন মহিলা ছিল না। আমার বাবার কোনো বোন ছিলো না। আশেপাশের মেয়েরা এসে আম্মার সাথে গল্প গুঁজব করে। এর মধ্যে আমার এক প্রতিবেশী ফুফুর সাথে আম্মার খুব ভাব হয়ে যায়। যখনই সুযোগ পায় দুই জনে গল্প করে কাটায়। এই ভাবে আম্মার দিন যায়। তখন আব্বা একটা স্কুলে চাকুরি করতেন। ১৯৬৪ সালে আব্বার পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে চাকুরি হয় এবং ট্রেনিং এর জন্য পাকিস্তান চলে যায়। তখন আম্মা দাদা ও নানা বাড়ি দুই জায়গাতেই থাকতেন। দাদা বাড়ি থাকলে অবশ্যই ফুফু আম্মার সাথে থাকতেন। ১৯৭০ সালে আব্বার ট্রেনিং শেষ হলে আব্বা আম্মাকে পাকিস্তান নিয়ে যাওয়ার জন্য আসে। যখন আম্মা পাকিস্তান চলে যায় তখনও ফুফুর বিয়ে হয়নি। দুই বান্ধবী অনেক কান্না কাটি করে বিদায় নেয়।
১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় আব্বা-আম্মা পাকিস্তানে। পাকিস্তানে যাওয়ার সময় শুধু আমার বড় বোন ছিল। পাকিস্তানে আমরা তিন বোন জন্ম নিই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে আব্বা-আম্মা বাংলাদেশে ফিরে আসে আমাদের চার বোনকে নিয়ে। আব্বা এসেই বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যোগ দেয়। কিন্তু আমার আম্মার জন্য অনেক বড় একটা ধাক্কা অপেক্ষা করছিল। আম্মা সবার কাছে আম্মার বান্ধবী অর্থাৎ ফুফুর কথা জানতে চাইছিল। কিন্তু কেউ কোন উত্তর দিচ্ছিলো না। পরে আম্মা জানতে পারে ফুফুকে পাকিস্তানী আর্মিরা ধরে নিয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হলে ফুফু গ্রামে ফিরে আসে। কিন্তু কেউ তাকে মেনে নেয়নি। ফুফু মনের কষ্টে কোথায় চলে গেছে কেউ বলতে পারেনি।
প্রায় ২৪ বছর পর একদিন সকালের ট্রেনে আম্মা, আমার স্বামী, দুই মেয়ে, ছোট বোন সহ আমরা ঢাকা আসছি। হঠাৎ আম্মা এক মহিলাকে দেখে ফুফুর নাম বলল। কিন্ত উনি না বলে। আম্মা অনেক ভাবে উনাকে চিনাতে চাইছিল কিন্তু উনি কাউকে চিনতে পারছিল না। আম্মাও উনার দিকে তাকিয়ে ছিল উনিও আম্মার দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ ফুফু আম্মাকে জড়াইয়া ধরে এত জোরে কান্না শুরু করছে কামরার সব মানুষ উনাদের দিকে তাকিয়ে আছে। যখন শুনল আব্বা মারা গেছেন ফুফু আরো জোরে কান্না শুরু করে।
২৭ বছরের জমানো কান্না যেন থামতেই চায় না। ফুফুতো আমাদের কখনো দেখেননি। আমাদের জড়ায় ধরে আব্বার কথা বলে অনেক কান্নাকাটি করল। পরে ফুফুর মুখেই শুনলাম দেশ স্বাধীন হলে ফুফু গ্রামে ফিরে আসলে কেউ ওনাকে মেনে নেয়নি। ফুফু মনের কষ্টে অন্য জেলায় গিয়ে নতুন করে সব শুরু করে। জীবনে ফুফু অনেক কষ্ট করেছেন। আর কখনো ফুফু নিজ গ্রামে ফিরে আসেননি। এমন অনেক ফুফুর বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। সালাম জানাই এইসকল বীরাঙ্গনাদের।